Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

কার কত নুন দরকার, বলে দেয় বিএসএফ

এ সব জায়গায় শহর থেকে আসা উটকো রিপোর্টারের কথা বলতে নেই। শুধুই চুপচাপ দৃশ্যের জন্ম দেখে যেতে হয়। দৃশ্য যে কত!

চর বালাভুতে গ্রামবাসীদের তৈরি সেই বাঁধ। ছবি: শুভ কর্মকার।

চর বালাভুতে গ্রামবাসীদের তৈরি সেই বাঁধ। ছবি: শুভ কর্মকার।

গৌতম চক্রবর্তী
তুফানগঞ্জ শেষ আপডেট: ৩১ মার্চ ২০১৯ ০৪:০৭
Share: Save:

‘‘নুন! তিন কেজি! কেন রে?’’ বিএসএফ জওয়ানটি বৃদ্ধ সাজাহান আলির বাজারের ব্যাগ থেকে নুনের প্যাকেট বার করতে করতে দাঁত খিঁচিয়ে উঠলেন, ‘আমাদের তো এক কেজিতে তিন মাস চলে যায়। তোর ধান্দাটা কী?’

সাজাহান বিড়বিড় করল, ‘‘বাড়িতে গরু আছে। গরু খায়।’’ ‘‘ওখানে,’’ সীমান্তরক্ষী বাহিনীর জওয়ানটি এক সহকর্মীকে আঙুল তুলে দেখালেন, ‘‘রেখে দে। এক কেজির বেশি নিতে দিবি না। গরু খায়, না বাংলাদেশে পাচার হয়, জানা আছে।.....আরে, তোর ব্যাগে তো শুঁটকিও দেখছি। কত আছে?’’

ভয়ার্ত সাজাহান বললে, ‘‘দু’কেজি।’’ জওয়ান বললেন, ‘‘বাজারে ফেরত দিয়ে আয়। পাঁচশোর বেশি নেওয়া যাবে না।’’

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

দু’এক জন গ্রামবাসী বলল, ‘‘না, শুঁটকি তো প্রায়ই লাগে। যেতে দেন, কত্তা।’’

জওয়ান আরও কড়া হলেন, ‘‘যেতে দেব? অসম দেখেছিস, ঠিক হয়ে গিয়েছে। মোদীজিকে আর এক বার আসতে দে, ঠিক হয়ে যাবি।’’

এ সব জায়গায় শহর থেকে আসা উটকো রিপোর্টারের কথা বলতে নেই। শুধুই চুপচাপ দৃশ্যের জন্ম দেখে যেতে হয়। দৃশ্য যে কত! নৌকোয় কালজানি নদী পেরিয়ে চর বালাভূত গ্রামে যাওযার আগে বিএসএফ আমার আধার কার্ডটিও জমা নিয়ে রেখে দিয়েছিল। গ্রাম থেকে ফের নদী পেরিয়ে এ পারের ক্যাম্পে এসে সেই কার্ড ফেরত পেয়েছি। লাদাখ থেকে অরুণাচল কোত্থাও যেতে এ ভাবে আধার বা ভোটার আইডি জমা রাখতে হয় না, এই জায়গাটাই ব্যতিক্রম।

ব্যতিক্রমী এই চর বালাভূত গ্রামটা পাকিস্তানে নয়, ভারতেই। কোচবিহার জেলার তুফানগঞ্জ থেকে চল্লিশ মিনিট গাড়িতে এসে তার পর নৌকোয় নদী পেরোনো। ১৮০০ ভোটারের বাস, প্রত্যেকেই মুসলমান। বাজারহাট, হাসপাতাল যাতায়াতে নৌকোই ভরসা। গ্রামে পাকা রাস্তা নেই, নেই বিদ্যুৎ। সন্ধ্যার পর আজও হ্যারিকেনই ভরসা। সরকারি প্রচেষ্টায় কয়েক বছর আগে হাসপাতালের নতুন বাড়ি হয়েছে, সেখানে ডাক্তার নেই। প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি ভাঙনের ফলে নদীগর্ভে। সপ্তাহে দু’দিন দাতব্য চিকিৎসালয়ে এক কম্পাউন্ডারবাবু বসেন, বিপদেআপদে তিনিই ভরসা। রাতবিরেতে মেয়েদের প্রসববেদনা উঠলে ডাক্তারের পাশাপাশি বিএসএফকে জানাতে হয়। বিএসএফ অনুমতি দিলেই তো রাতে নৌকো এ পারে আসবে!

গ্রামে রবিউল ইসলামের মুদির দোকানের মাসকাবারি খাতাটি কলমের দাগে শতচ্ছিন্ন। লেখা ছিল, তিন কেজি তালমিছরি। সেটি কেটে এক কেজি। তিন পিস সাবান কেটে এক পিস। মোদীজির ভয় দেখানো, কথায় কথায় দেশবাসীর মধ্যে স্মাগলার খোঁজা বিএসএফ-ই কাটাকুটি করে মুদিখানার চূড়ান্ত তালিকা বানিয়ে দিয়েছে। ‘‘বিয়ে-শাদিতে লোক খাওযাতে আগে গোমাংস আনা যেত, এখন সেটাও আনা যায় না,’’ বলছিলেন এক গ্রামবাসী। গ্রামে পালাপার্বণে, ধর্মীয় উৎসবে জামাত বা ইসলামি শিক্ষার আসর বসাতেও ক’জন আসবেন, তাঁদের গ্যারান্টার কারা থাকবেন সব বিএসএফকে জানাতে হয়। গণতান্ত্রিক দেশে আমার ইচ্ছামাফিক যা খুশি খেতে, পরতে পারি, যেখানে ইচ্ছা যেতে পারি গোছের কথা পাঠ্য বইয়ে থাকে, চর বালাভূতের জীবনে নয়।

বিএসএফের বক্তব্য, বাংলাদেশ-লাগোয়া এই গ্রাম থেকেই গরু ও নানা জিনিস পাচার হয়। গ্রামবাসীরা বলছেন, বাইরের লোক যদি বালাভূত গ্রামে এসে পাচার করে, সে দায় আমরা কেন নেব? তাঁরা আরও বলছেন, সীমান্তে বিএসএফের টহলদারির জন্য রাস্তা আছে। তাঁরা সেখানে পাহারা না দিয়ে এই নদীর ধারেই বা কেন থাকেন? তিতিবিরক্ত গ্রামবাসীরা এ বিষয়ে তুফানগঞ্জের সাবডিভিশনাল ম্যাজিস্ট্রেটকে স্মারকলিপি দিয়েছেন, এক দিন নৌকোঘাটও বন্ধ রাখা হয়েছিল।

যে গ্রাম বিএসএফের উপস্থিতি নিয়ে এত ক্ষিপ্ত, তারা নিশ্চয় ‘অ্যান্টি ন্যাশনাল’! নদী পেরেনোর পর গ্রামের মিজানুর রহমান তাঁর বাইকে চাপিয়ে আমাকে নিয়ে গেলেন অন্য দিকে। নদীতে আধডোবা কয়েকটি কাঠের খুঁটি। গ্রামের লোক নিজেরাই পঞ্চায়েতের নেতৃত্বে প্রায় ৬ লক্ষ টাকা চাঁদা তুলে নদীতে বাঁধ দিয়েছেন।

এর নাম ভারতবর্ষ!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE