Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
State News

কংগ্রেসের পরে তৃণমূলও, চ্যালেঞ্জ ছুড়তে সেই গেরুয়া ময়দানেই পা

গোটা ভারতে স্বীকৃতি আদায়ের প্রশ্নে বার বারই ওই হিন্দুত্ব বিজেপির পথের সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ মে ২০১৯ ১০:৩৪
Share: Save:

জলের ভাগাভাগি পরে হবে, প্রবাহটাকে আগে বইয়ে দেওয়া যাক চেনা খাতে। বিজেপির প্রাথমিক কৌশল ছিল এটাই। গত কয়েক বছর ধরে গোটা ভারতে সেই আবহ তৈরি করার চেষ্টা চলছিল ক্রমান্বয়ে। সর্বাগ্রে আপোসটা করল কংগ্রেস। হিন্দুত্ব বিজেপির একার নয়, এই বার্তা দেওয়ার চেষ্টা শুরু করলেন রাহুল গাঁধী। পরে তৃণমূলও গেল সেই পথে। প্রায় প্রত্যেকটা ভাষণে হিন্দুত্ব বা ধর্মনিরপেক্ষতা প্রসঙ্গে অনেকটা করে সময় ব্যয় করতে শুরু করলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আর পাঁচ দফা ভোট হয়ে যাওয়ার পরে আরও এক ধাপ এগিয়ে সরাসরি হিন্দুত্বের ক্রিজে নেমেই বিজেপির উইকেট নেওয়ার চেষ্টা শুরু করল তৃণমূল। ‘বাঙালি হিন্দুর বিরোধী বিজেপি’— এই ভাষাতেই আক্রমণে নামলেন দলের জাতীয় মুখপাত্র ডেরেক ও’ব্রায়েন।

একের পর এক নির্বাচনে হিন্দুত্ব বিজেপির কাছে খুব বড় অস্ত্র হয়ে উঠেছে ঠিকই। কিন্তু গোটা ভারতে স্বীকৃতি আদায়ের প্রশ্নে বার বারই ওই হিন্দুত্ব বিজেপির পথের সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সব জেনেও বিজেপি কিন্তু অসহায়। দিল্লির মসনদে মোদী সরকার বছর দুয়েক কাটাতে না কাটাতেই দেশ জুড়ে ফের শুরু হয়ে গিয়েছিল হাওয়ার গতি নির্ধারণের চেষ্টা। হিন্দুত্ব বা হিন্দু বিরোধিতা— গোটা রাজনৈতিক চর্চাকে এই দুই মেরুতে বেঁধে দেওয়ার চেষ্টা শুরু করেছিল বিজেপি। মোদী-শাহের খাসতালুক গুজরাতে লড়তে গিয়ে কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গাঁধী প্রথম বার স্পষ্ট ভাবে পা রাখলেন বিজেপির তৈরি করা সেই ময়দানে। মন্দির থেকে প্রচার শুরু করলেন, প্রচারের ফাঁকে ফাঁকে মন্দিরে মন্দিরে মাথা ঠুকে বেড়ালেন।

মোদী-শাহের গড় ধসাতে পারেননি সে বার রাহুল, কিন্তু গুজরাতে কংগ্রেসের ফল আগের চেয়ে অনেক ভাল হয়েছিল। শুধু মাত্র নরম হিন্দুত্বের কারণেই তা হয়েছিল, এমন নয়। কিন্তু নরম হিন্দুত্বের অবদান যে কিছুটা হলেও থাকতে পারে, এ বিশ্বাস সম্ভবত কংগ্রেস নেতৃত্বের মধ্যে দৃঢ় ভাবে জন্মে গিয়েছিল। তাই কর্নাটক, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, ছত্তীসগঢ়— প্রত্যেকটা রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারে রাহুল গাঁধী ঘুরেছেন মন্দিরে মন্দিরে। সেই কারণেই হোক বা অন্য অনেক কারণে, তিন রাজ্যেই বিজেপি-কে ক্ষমতাচ্যুতও করেছেন। তাই প্রিয়ঙ্কা গাঁধীও রাজনীতিতে পা রেখেই দেখা দিয়েছেন ছোট-বড় নানা মাপের হিন্দু তীর্থে।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

বিজেপি তথা সঙ্ঘ পরিবার কিন্তু ঠিক এটাই চাইছিল। গোটা টুর্নামেন্টটাকে খুব চেনা একটা মাঠে এনে হাজির করাটাই কিন্তু তাঁদের লক্ষ্য ছিল। বিজেপির মাঠে গিয়ে বিজেপি-কে গোল দেওয়ার আত্মবিশ্বাস থেকেই হোক বা নিজেদের রাজনৈতিক ঘরানায় অবিচল থেকে বিরাট হিন্দু জনগোষ্ঠীর সমর্থন ধরে রাখতে পারার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী না হতে পেরে, কংগ্রেস পা রাখল বিজেপির সেই মাঠেই। আর কোন রাজনৈতিক বিশ্লেষক এ কথা জানেন না যে, রাজনৈতিক চর্চার প্রবাহটা নিজের মতো করে বেঁধে দিতে পারেন যে পক্ষ, এগিয়ে যান তাঁরাই।

কংগ্রেসকে ‘হিন্দু বিরোধী’ তকমা দেওয়ার সঙ্ঘীয় চেষ্টা ব্যর্থ করতে বিজেপির ছোড়া চ্যালেঞ্জ যে দিন গ্রহণ করেছেন রাহুল-প্রিয়ঙ্কা, সে দিনই গেরুয়া ময়দানে পা-টা ফেলে দিয়েছেন তাঁরা। এই ময়দানে খুব বেশি এগিয়ে খেলা কংগ্রেসের পক্ষে অসম্ভব। আবার এই মুহূর্তে ময়দানটা ছেড়ে বেরিয়ে আসাও খুব কঠিন।

কংগ্রেসের এই দ্বিধাদ্বন্দ্ব বাইরে থেকে দেখে নেওয়ার সুযোগ অনেকটাই পেয়ে গিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সুতরাং বিজেপির চোরা হাতছানিতে সাড়া না দেওয়াই তাঁর বা তৃণমূলের উচিত ছিল। পশ্চিমবঙ্গে নিজেদের পায়ের তলায় জমি খুঁজতে যে তৃণমূলকে ‘হিন্দু বিরোধী’ হিসেবে বিজেপি চিহ্নিত করতে চাইছিল অনেক দিন ধরেই, সে কথা ঠিক। গেরুয়া শিবিরের সেই প্রচারকে ভোঁতা করে দেওয়া অত্যন্ত জরুরি ছিল তৃণমূলের জন্য। কিন্তু কংগ্রেসের পথে হেঁটে নয়, অন্য কোনও কৌশলে সেটা করা উচিত ছিল।

আরও পড়ুন: বিদ্রুপে ভরা ঘাটালে ব্যতিক্রমী দেব

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু কংগ্রেসের পথটাই ধরলেন। মন্দিরে মন্দিরে তিনি ঘুরছেন না ঠিকই। কিন্তু নির্বাচনী জনসভাগুলো থেকে তাঁকে বার বার মন্ত্রোচ্চারণ করতে শোনা যাচ্ছে। কোন কোন মন্দিরের উন্নতিকল্পে তিনি কী কী করেছেন, সে ফিরিস্তি তুলে ধরতে হচ্ছে। দুর্গোৎসবের সময়ে ক্লাবগুলোকে অনুদান দেওয়ার কথা মনে করিয়ে দিতে হচ্ছে।

তবে শুধু মমতাতেই সীমাবদ্ধ থাকল না হিন্দুত্বের চর্চা। তৃণমূল হিন্দু বিরোধী নয়— এমন একটা সাফাই তুলে ধরার মতো রক্ষণাত্মক লাইনেও সীমাবদ্ধ থাকল না। তৃণমূল এ বার পাল্টা আক্রমণের কৌশল নিল। বিজেপি হল বাঙালি হিন্দুর বিরোধী একটি রাজনৈতিক দল— সরাসরি এই ভাষাতেই আক্রমণ করলেন দলের জাতীয় মুখপাত্র ডেরেক ও’ব্রায়েন।

আরও পড়ুন: ফাঁকা মাঠে ভারতীর প্রশংসায় অমিত শাহ

#আউটসাইডপার্লামেন্ট— এই শিরোনামে ধারাবাহিক ভাবে ছোট ছোট ভিডিয়ো সোশ্যাল মিডিয়ায় ছাড়ছে তৃণমূলের আইটি সেল। মঙ্গলবার সেই সিরিজের যে ভিডিয়োটি প্রকাশ করা হয়েছে, তাতে রাজ্যসভায় তৃণমূলের দলনেতা তথা দলের জাতীয় মুখপাত্র ডেরেক ও’ব্রায়েন বেনজির ভাষায় আক্রমণ করেছেন বিজেপি-কে। ৩ মিনিট ২৬ সেকেন্ডের ভিডিয়োয় তাঁর সুনির্দিষ্ট বক্তব্য— বিজেপি হল বাঙালি হিন্দুর ঘোর বিরোধী। এই বক্তব্যের স্বপক্ষে চারটি যুক্তিও তুলে ধরেছেন তৃণমূল সাংসদ।

এক) রাজ্যের ২৮ হাজার ক্লাবকে দুর্গোৎসবের জন্য ১০ হাজার টাকা করে অনুদান দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তা রুখতে বিজেপি-ই আদালতে টেনে নিয়ে গিয়েছিল রাজ্য সরকারকে। দুই) ৪০টি বড় পুজো কমিটিকে আয়কর বিভাগ এবং ইডি হেনস্থা করছে এবং সবাই জানেন আয়কর বিভাগ এবং ইডি কাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তিন) অসমে এনআরসি থেকে বাদ পড়েছে ২২ লক্ষ বাঙালি হিন্দুর নাম। চার) এনআরসি থেকে নাম বাদ পড়ায় আত্মহত্যা করেছেন ৩৫ জন বাঙালি হিন্দু।

এই চারটি বিষয় উল্লেখ করে তৃণমূল মুখপাত্রের দাবি, বিজেপি বাঙালি হিন্দুর ঘোর বিরোধী। তবে এই বিষয়টি নিয়ে তাঁকে কোনও এ ভাবে কথা বলতে হবে, তা তিনি কখনও ভাবতে পারেননি— ভিডিয়োয় এমন আক্ষেপও প্রকাশ করেছেন ডেরেক।

বিজেপির অস্ত্রকে ভোঁতা করার লক্ষ্যে তৃণমূলের এই আক্রমণ অবশ্যই নতুন ধাঁচের। উপস্থাপনাও নজরকাড়া। কিন্তু খেলাটা তো চলতে থাকল সেই বিজেপির বেছে দেওয়া মাঠেই। বিজেপি যে মাঠটাকে নিজের বলে দাবি করছে, আসলে সে মাঠটা বিজেপির নয়— তৃণমূলের নতুন প্রচার কৌশলে এই বার্তা দেওয়ার চেষ্টা রইল ঠিকই, কিন্তু সে তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠা করার মতো যথেষ্ট সময় কি আর রয়েছে হাতে? ভোটের মরসুম তো শেষ পথে।

কোন তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা পেল, বোঝা যাবে ২৩ মে। কিন্তু গোটা নির্বাচনী মরসুমটায় বিজেপির বেঁধে দেওয়া রাগেই যে নানা রকমের সুর ভাঁজলেন বিরোধীরা, সে কথা অস্বীকার করার উপায় নেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE