কালীঘাটের বাড়িতে সাংবাদিক বৈঠক মুখ্যমন্ত্রীর। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য
বিজেপির নির্দেশে বাংলার গণতন্ত্রকে লুট করছে নির্বাচন কমিশন। এই পরিকল্পিত প্রতিহিংসা ও ষড়যন্ত্রের কাছে মাথা নত করব না— রাজ্যে প্রচারপর্ব ছাঁটার নির্দেশ আসার পরেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নির্বাচন কমিশনকে এ ভাবেই কড়া আক্রমণ করলেন। তাঁর মন্তব্য, ‘‘এটা করে বিজেপিকে বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙার পুরস্কার দেওয়া হল।’’
বুধবার রাত ন’টায় কালীঘাটের বাড়িতে জরুরি সাংবাদিক বৈঠক ডাকেন মমতা। সেখানে তিনি বলেন, ‘‘এমন অসাংবিধানিক অনৈতিক ও রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট নির্বাচন কমিশন আগে কখনও দেখিনি। রাজ্যের আইনশৃঙ্খলার কোনও রকম অবনতি হয়নি। ভোটের সময় যেটুকু গন্ডগোল হয়েছে তা কেন্দ্রীয় বাহিনীর জন্যই হয়েছে।’’ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং বিজেপি সভাপতি অমিত শাহের নির্দেশে কমিশন বাংলায় এই সিদ্ধান্ত বলবৎ করল বলে অভিযোগ করেছেন মমতা। তাঁর মন্তব্য, ‘‘এ ভাবে কি কমিশন বিজেপিকে জেতাতে পারবে? এত অসম্মানিত কোনও দিনও হইনি। সুবিচারের আশায় গণতন্ত্র আজ কাঁদছে।’’ কমিশনের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ভোটের পরে সুপ্রিম কোর্টে যেতে পারেন বলে মমতা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘‘আমি সুপ্রিম কোর্টে যেতে পারতাম। কিন্তু আপাতত জনাদেশের উপর ভরসা রাখছি। মানুষই যোগ্য জবাব দেবে। ভোট মিটে গেলে সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার কথা ভাবব।’’
এ দিনই মুখ্য নির্বাচন কমিশনারকে দু’পাতার কড়া চিঠি পাঠিয়ে তাঁর ক্ষোভ লিখিত ভাবে জানান মমতা। এর পিছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে, এমন অভিযোগও তিনি ওই চিঠিতে সরাসরি উল্লেখ করেছেন। মমতা বলেন, ‘‘কমিশনের এই সিদ্ধান্ত গণতান্ত্রিক অধিকারের পরিপন্থী। কারণ, প্রার্থীদের নিজেদের কথা বলা এবং মানুষের সে সব কথার নির্ধারিত যে সময়সূচি রয়েছে, তা থেকে বঞ্চিত করা হল। এটা কখনই গণতন্ত্রসম্মত নয়।’’
দেখুন সাংবাদিক বৈঠকে কী বললেন মমতা
কমিশনের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে আজ, বৃহস্পতিবার রাজ্যজুড়ে কালো পতাকা নিয়ে, মোমবাতি নিয়ে প্রতিবাদ মিছিল করার আবেদনও জানিয়েছেন তৃণমূল নেত্রী। একই সঙ্গে, দেশের যে ২৩টি আঞ্চলিক দল মমতার ডাকা ব্রিগেড সমাবেশে এসেছিল, তাদেরও সমবেত ভাবে বিজেপি-বিরোধিতায় সরব হতে অনুরোধ জানিয়েছেন। শুক্রবার সাধারণ ভাবে প্রচারের শেষ দিন ছিল। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মমতা তাঁর নির্ধারিত শেষ দিনের কর্মসূচিগুলি আজ বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত ঘুরে শেষ করে নেবেন। তাই আজ তিনি মথুরাপুর এবং ডায়মন্ড হারবারে দু’টি সভা এবং বেহালা ও দক্ষিণ কলকাতায় দু’টি পদযাত্রা করবেন।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
উত্তর কলকাতায় মঙ্গলবার শাহর মিছিলের শেষলগ্নে বিদ্যাসাগর কলেজে বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙাকে কেন্দ্র করে যে গোলমাল ঘটেছিল, সেই প্রসঙ্গ তুলে মমতা অভিযোগ করেন, ‘‘অমিত শাহ কলকাতায় এসেছিলেন দাঙ্গা করতে। হামলা করে গেলেন। তাঁকে শোকজ করা হল না কেন?’’ কলকাতার ওই ঘটনা বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরের গণ্ডগোলের চেয়েও ভয়াবহ বলে দাবি করেছেন মমতা। রজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে যে রয়েছে, তা বোঝাতে মমতা বলেন, ‘‘রাজ্যে তো মোদী, শাহ-সহ বিজেপি নেতারা একের পর এক সভা করেছেন। কোথাও তাঁদের উপর কোনও রকম হামলা হয়েছে?’’
রাজ্যের স্বরাষ্ট্র সচিব অত্রি ভট্টাচার্য এবং এডিজি সিআইডি রাজীব কুমারকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়ার প্রসঙ্গে মমতা এ দিন বলেন, ‘‘স্বরাষ্ট্র সচিব কী অপরাধ করেছিলেন? তিনি রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী অফিসারকে একটি চিঠি দিয়েছিলেন। কেন্দ্রীয় বাহিনী সব এলাকা চেনে না। তাদের সঙ্গে রাজ্য পুলিশ রাখার আবেদন ছিল সেই চিঠিতে। এটা অপরাধ?’’ একই ভাবে রাজীব কুমার প্রসঙ্গে মমতার প্রশ্ন, ‘‘মুকুল রায় এবং বিজেপির চম্বলের ডাকাতরা হোটেলে বসে বসে কি ভয় পাচ্ছেন? ভোট কিনতে কোটি কোটি টাকা নিয়ে আসা হচ্ছে। রাজীব হাওয়ালার টাকাগুলো ধরবে বলেই কি ওঁকে সরিয়ে দেওয়া হল?’’ তাঁর অভিযোগ, ‘‘আমি জানি, গদ্দারের(মুকুলকে বোঝাতে চেয়েছেন) কথায় কলকাতা ও বিধাননগরের পুলিশ সুপার বদল হয়েছে। ডায়মন্ড হারবার এবং বীজপুরের পুলিশ অফিসারের বদলি হয়েছে।’’ বিজেপি নেতা মুকুল রায়ের পাল্টা বক্তব্য, ‘‘আমার বিরুদ্ধে একটাও অভিযোগ প্রমাণ করতে পারলে আমি রাজনীতি ছেড়ে দেব। কিন্তু প্রমাণ করতে না পারলে উনি কি মুখ্যমন্ত্রিত্ব ছাড়বেন?’’
বিদ্যাসাগর কলেজের ঘটনার পরে মুখ্যমন্ত্রী কলকাতার পুলিশ কমিশনারকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, শহরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে এবং বহিরাগত হামলাকারীদের গ্রেফতার করতে হবে। মঙ্গলবার রাত থেকেই ব্যাপক ধরপাকড় শুরু করেছে পুলিশ। বুধবার একই ভাবে বিধাননগরের পুলিশ কমিশনারকেও মুখ্যমন্ত্রী নির্দেশ দেন, হোটেলগুলিতে নজরদারি চালিয়ে আশ্রিত বহিরাগতদের বার করে দিতে হবে।
নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে বাম পরিষদীয় নেতা সুজন চক্রবর্তীও বলেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গের প্রশাসন কী দেখছে? এ রাজ্যের আইনশৃঙ্খলাকে কোন জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে? এটা রাজ্যের অপমান।’’ সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরিও কমিশনের সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেন, ‘‘কমিশনের বহু নির্দেশই যে বাংলায় মানা হচ্ছে না, তা তাদের বহু বার জানিয়েও সাড়া মেলেনি। এখন তৃণমূল ও বিজেপি-র সংঘর্ষের পর অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে হঠাৎ প্রচার বন্ধ করে দেওয়া হল!’’ যাদবপুরের পিডিএস প্রার্থী অনুরাধা পূততুণ্ডের প্রশ্ন, ‘‘দু’দলের মারামারির জন্য অন্য দলগুলিকে কেন মাসুল দিতে হবে? নিষেধাজ্ঞা হলে মারপিট করা দল দু’টির উপরে হওয়া উচিত ছিল।’’
প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি সোমেন মিত্র অবশ্য বলেন, ‘‘গত কাল যা ঘটেছে, তার পর কমিশনের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত না জানিয়ে উপায় নেই।’’ বিজেপিও কমিশনের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে। বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ বলেন, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাস্তায় নেমে আইন ভাঙছেন, হুমকি দিচ্ছেন, তৃণমূলের কর্মীরা আক্রমণ করছে, আমাদের সভাপতির রোড শো-তেও হামলা হয়েছে। এর পর প্রশাসনের উপর জনগণ এবং কমিশন— কারও আস্থা নেই। তাই কমিশন এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy