ভোট মিটলে আসুন বলল থানা।
তিন দিন নিখোঁজ থাকার পরে সন্ধান মেলে মেয়ের। বছর ষোলোর ওই কিশোরী বাড়িতে জানায়, তাকে তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করা হয়েছে। বাড়িতে নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। মেয়ে এ বার মাধ্যমিক দিয়েছে। আজ বাদে কাল রেজাল্ট। ভয় পান বাড়ির লোকজনও, ‘‘এ সব জানাজানি হলে মুখ পুড়বে যে!’’ কিশোরীর এক গোঁ, ‘‘পুড়ুক! কিন্তু ওর শাস্তি চাই।’’
মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে প্রথমে মা ছুটলেন রঘুনাথগঞ্জ থানায়। সেখানে জানানো হল, ‘জঙ্গিপুর মহিলা থানায় চলে যান’। মা-মেয়ে ফের ছুটলেন জঙ্গিপুরে। মহিলা আইসিকে দেখে নিঃসঙ্কোচে সব কথা খুলে বলল ওই কিশোরী। তিন জনের বিরুদ্ধে অপহরণ ও ধর্ষণের লিখিত অভিযোগও জমা দেওয়া হল। কিন্তু সেখানে তাঁদের শুনতে হল, ‘‘অভিযোগ জমা নেওয়া থাকল। এখন লোক নেই। ভোটের পরে আসুন। তখন দেখা যাবে।’’
তার পরে কেটে গিয়েছে ১৭ দিন। মা-মেয়ে তার পরে আরও দু’বার মহিলা থানায় গিয়ে বসে থেকেছেন। কিন্তু প্রতি বারই শুনতে হয়েছে, ‘‘যা হওয়ার ভোটের পরে হবে।’’ জঙ্গিপুরের ভোট শেষ হয়েছে ২৩ এপ্রিল। অথচ রবিবার বিকেল পর্যন্ত অপহরণ ও ধর্ষণের মামলা রুজু করেনি পুলিশ। হয়নি ওই কিশোরীর মেডিক্যাল পরীক্ষা ও গোপন জবানবন্দিও! ভোট বড় বালাই! তাই বলে এমন গুরুতর মামলাও পুলিশ রুজু করবে না?
জঙ্গিপুর মহিলা থানার আইসি সাফারি মণ্ডলের গলায় স্পষ্ট ঝাঁঝ, ‘‘কী ভাবে থানা চলছে, তা তো আপনি জানেন না! ভোটের জন্য প্রায় কেউই থানায় ছিলেন না। সেই জন্যই ওদের ভোটের পরে আসার কথা বলেছিলাম। ওদের সোমবার থানায় আসতে বলুন। ব্যবস্থা নেব।’’
কিন্ত আপনি নিজেও তো এফআইআর নিতে পারতেন? আইসি সাফারির জবাব, ‘‘এফআইআর হলেই তো মেডিক্যাল পরীক্ষা করাতে হত। লোক পাব কোথায়?’’ কিন্তু এত দিন পরে কি আর মেডিক্যালেও কিছু পাওয়া যাবে? সে প্রশ্নের অবশ্য সদুত্তর মেলেনি আইসির কাছে।
বিষয়টি জানতে পেরে চমকে উঠেছেন জঙ্গিপুরের এসডিপিও প্রসেনজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলছেন, ‘‘ধর্ষণের মতো অত্যন্ত গুরুতর মামলা এ ভাবে ফেলে রাখা যায় নাকি! এখনই খোঁজ নিচ্ছি। প্রয়োজনে আমি নিজে ওই কিশোরীর বাড়িতে গিয়ে যা করার তা করব।’’
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, রঘুনাথগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা ওই কিশোরী গত ১৪ এপ্রিল গিয়েছিল পড়শির বাড়িতে। সেখান থেকেই নিখোঁজ হয় সে। ১৭ এপ্রিল বিধ্বস্ত অবস্থায় বাড়ি ফেরে। ওই কিশোরীর অভিযোগ, তাকে সাগরদিঘির মালিয়াডাঙায় তুলে নিয়ে গিয়ে একটি ঘরে আটকে রেখে টানা তিন দিন ধর্ষণ করে ওই পড়শির এক আত্মীয়। বাধা দিলে তাকে মারধরও করা হয়।
ওই কিশোরীর মা বলছেন, ‘‘মেয়ে ও আমাদের পরিবারের উপর দিয়ে যে কী ঝড় বইছে তা কেবল আমরাই জানি। মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে তিন-তিন বার থানায় গেলাম। ওই অফিসারও তো নিজেও মহিলা। অথচ এমন গুরুতর বিষয়টিকে পাত্তাই দিলেন না। অভিযুক্তও ধরা পড়ল না। এর পরে আর কোন ভরসায় থানায় যাব?’’
সাগরদিঘির বোখারা ১ গ্রাম পঞ্চায়েতের উপপ্রধান তৃণমূলের সাইদুল ইসলাম বলেন, “ওই কিশোরীর পরিবারের লোকজন আমাকেও গোটা বিষয়টি জানিয়েছিলেন। আমিই তাঁদের বলি, আপনারা পুলিশের কাছে যান। কিন্তু এখনও পর্যন্ত পুলিশ যে এফআইআর করেনি তা তো ভাবতেই পারছি না!’’
জঙ্গিপুর আদালতের সরকারি আইনজীবী আফজাল উদ্দিন ওই কিশোরীর পরিবারের পরিচিত। সেই সূত্রেই তিনি নিজের পরিচয় দিয়ে জঙ্গিপুরের মহিলা থানার আইসিকে ফোন করেন। আফজাল উদ্দিন বলছেন, “ওই আইসি আমাকেও একই কথা শুনিয়েছেন! এ দিকে, আদালতেও কর্মবিরতি চলছে। সেখানে যাওয়ারও উপায় নেই।” মুর্শিদাবাদের পুলিশ সুপার মুকেশ কুমার বলেন, ‘‘মামলা শুরু হয়েছে। এসডিপিও-র তত্ত্বাবধানে তদন্ত হবে। দেরি করে এফআইআর করার ঘটনায় অভিযুক্ত অফিসারের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy