Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

বিজেপি নই, ছেলেও নয়, কবুল মঞ্জুলকৃষ্ণের

হাতের সামনে মঞ্জুলকৃষ্ণ ঠাকুরকে দেখে নেহাতই কুশল বিনিময়ের চেষ্টা। তৃণমূলের প্রাক্তন মন্ত্রী এখন বিজেপির টিকিটে ‘ছেলেকে দাঁড় করিয়ে’ চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন সাবেক দলকে।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

অনমিত্র চট্টোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ মে ২০১৯ ০৪:৩২
Share: Save:

কেমন আছেন?

হাতের সামনে মঞ্জুলকৃষ্ণ ঠাকুরকে দেখে নেহাতই কুশল বিনিময়ের চেষ্টা। তৃণমূলের প্রাক্তন মন্ত্রী এখন বিজেপির টিকিটে ‘ছেলেকে দাঁড় করিয়ে’ চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন সাবেক দলকে।

কপাল কুঁচকে খয়েরি প্যান্টের ওপর ছাই রঙা টি-শার্টের জবাব— ‘‘আমি বাইট-টাইট দিই না!’’

পূর্ব আলাপের খেই ধরিয়ে দিতে ধপ করে বসে পড়লেন দরজার সামনে কেয়ারি করা গদি আঁটা সেগুন কাঠের চেয়ারে। আমন্ত্রণের তোয়াক্কা না করেই উল্টো দিকে জানলার ধাপিতে বসে ছুড়ে দেওয়া গেল প্রশ্ন— তৃণমূলের সর্বোচ্চ মহল থেকে নাকি ফোন এসেছিল? সত্যি নাকি?

বাইরের দিকে তাকিয়ে জবাব, ‘‘ও সব নিয়ে ভাবছি না। লোকসভা ভোটে এখন নজর। ছেলেটাকে জেতাতে হবে। মুখের মতো জবাব দিতে হবে ওই লোকটাকে। মস্ত বড় নেতা! ভারী তো মন্ত্রী। অমন মন্ত্রী আমিও ছিলাম।’’ হাতের ফোনের বোতাম টিপে একটু বিরতি। কাউকে জানালেন কলকাতার সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলছেন, বলাটা খুব দরকার। তার পরে তাঁর কাছে জানতে চাইলেন, ‘‘তুই কোথায়? ও, চৌরঙ্গিতে প্রচার করছিস? বাড়িতে আসছিস তো?’’ বোঝা গেল বিজেপি প্রার্থী ছেলে শান্তনু ঠাকুরকেই করা ফোনটা। তার পরে আবার— ‘‘ঠাকুরবাড়িতে রাজনীতি ঢুকিয়েছে লোকটা। এখন দুর্নাম করছে। ছেলেকে দাঁড় করিয়েছি, জিতিয়ে জবাব দেব।’’

অদূরে কামনাসাগরের উল্টো দিকে হরিচাঁদ-গুরুচাঁদ ঠাকুরের মন্দির থেকে আচমকা উড়ে এল উলুধ্বনি, ‘ড্যাডাম-ড্যাডাম’ বাদ্যি। থেমেও গেল।

তফসিলিদের সংরক্ষণের বিরুদ্ধে মোদী-অমিত শাহেরা। পাল্টা সংখ্যাগুরুর সংরক্ষণ চালু করেছে বিজেপি। দলিতদের ওপর অত্যাচারের এত ঘটনা ঘটছে। তফসিলি মতুয়াদের আপনি বলছেন বিজেপিকে ভোট দিতে? মঞ্জুলকৃষ্ণের উত্তর, ‘‘কে বিজেপি? আমি বিজেপি নই, আমার ছেলেও বিজেপি নয়। জবাব দিতে একটা বড় শক্তিকে পাশে লাগে। আমরা তাই বিজেপিকে সঙ্গে নিয়েছি!’’

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

তৃণমূল দলে ফিরিয়ে নিলে যাবেন? ঠান্ডা গলায় জবাব, ‘‘বললাম তো, ও সব নিয়ে ভাবছিই না। তবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় লড়াকু নেত্রী। এক সময়ে পাশে ছিলাম। তাঁকে নিশ্চয়ই শ্রদ্ধা করি!’’ নড়ে উঠল পর্দা। অন্তঃপুর থেকে ডাক এল। উঠে গেলেন। স্পষ্ট শোনা গেল এক মহিলা কণ্ঠ— এ সব কথা বলছ কেন? মঞ্জুলকৃষ্ণ বোঝালেন তাঁকে, বলাটা দরকার। শান্তনুও জানে। বেরোলেন একটা খবরের কাগজ (আনন্দবাজার নয়) নিয়ে। একটা খবর দেখিয়ে বললেন, ‘‘দেখুন কী বলেছে কাল। আমি আর শান্তনু ভক্তদের কাছ থেকে অন্যায় ভাবে টাকা তুলে খাই! বেশ করি। আমার চোদ্দো পুরুষ ভক্তদের কাছ থেকে টাকা তুলে খেয়েছে, আমিও খাই। এটা অন্যায়? তুমি বলার কে হে! তুমি কি মতুয়া? তুমি তো বর্ধমান থেকে উড়ে এসে বসা।’’

ফের সেই উলুধ্বনি। মন্দিরে বেজে ওঠে কাড়া-নাকাড়া।

আচ্ছা, যশোর রোড সম্প্রসারণ, আর্সেনিকের সমস্যা, ইছামতীর সংস্কার...। কথা শেষ করার আগেই মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে উড়িয়ে দিলেন সব সমস্যা। বললেন, ‘‘সব হয়ে যাবে। শান্তনু জিতলে ও সব নদ-নদী, রাস্তাঘাট এমনিই ঠিক হয়ে যাবে। সবার আগে ঠাকুরনগরে একটা মেডিক্যাল কলেজ করতে হবে। রাত-বিরেতে অসুখ-বিসুখ...। এখানে একটা রেলগেট করাও দরকার। কেন্দ্র পাশে না থাকলে এ সব করা যায়!’’

যাঁর বিরুদ্ধে মঞ্জুলকৃষ্ণের এত আক্রোশ, তিনি তৃণমূলের উত্তর ২৪ পরগনার ভারপ্রাপ্ত নেতা জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। দলের প্রাক্তন মন্ত্রীর অভিযোগগুলো নিয়ে তাঁর জবাব, ‘‘ঠাকুরবাড়ি ভক্তের বাড়ি। তার সম্পত্তি নিয়ে যাঁরা ব্যবসা করেন, ভোটে মানুষই তাঁদের জবাব

দেবেন। বড়মা উইল করে মমতাবালাকে সংঘাধিপতি নিয়োগ করেছেন। তিনিই উত্তরাধিকারী। ওরা সেটা মানে না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঠাকুরবাড়িকে চিনিয়েছেন। লোভে পড়ে উনি ছেলেকে বিজেপির হয়ে দাঁড় করিয়ে এখন আমাকে গালাগাল পাড়ছেন। আমি তার জবাব দেব না। আগের বার মঞ্জুলের বড় ছেলে প্রার্থী হয়ে ২ লাখ ১২ হাজার ভোটে হেরেছেন। এ বারে সেটা আড়াই লাখ হবে।’’

কিছু দিন আগে মারা গিয়েছেন শতবর্ষী বড়মা। তাঁর শেষকৃত্যে দু’টি অনুষ্ঠান করেছেন দুই শরিক। ঐতিহ্যের মেলাও বসেছে দুটো। এই মৃত্যুর আগেই দু’টুকরো হয়েছে মতুয়া মহাসংঘ। একটা বোর্ড মঞ্জুলকৃষ্ণের বাড়ির সামনে। আর একটা বোর্ড যাঁর বাড়িতে, তিনি বনগাঁর বিদায়ী সাংসদ, এ বারেও তৃণমূলের প্রার্থী মমতাবালা ঠাকুর। সম্পর্কে তিনি মঞ্জুলের দাদা কপিলকৃষ্ণের স্ত্রী। ঠাকুরবাড়িতে নিত্যদিনের মতো আসা মতুয়া ভক্তরা কিন্তু দুই শিবিরকেই বাঁচিয়ে চলছেন। ভোটের খবর জানতে চাইলে সবারই এক কথা— ঠাকুরবাড়িতে রাজনীতির কথা বলবেন না। কাকে ভোট দেব, সেটা বেরিয়ে ভাবব।

নাম প্রকাশ না করার কড়া শর্তে মহাসংঘের এক সংগঠক বলেন, ‘‘হরিচাঁদ-গুরুচাঁদ, পি আর ঠাকুরের কড়া নির্দেশ ছিল রাজনীতিতে জড়াবে না সংঘ। কিন্তু রাজনীতি দু’শিবিরে ভাগ করে ফেলেছে সংঘকে। আমরা পড়েছি ধর্মসঙ্কটে। কেন্দ্র নাগরিক বিল এনে উদ্বাস্তু হিন্দুদের নাগরিকত্ব দিতে চায়। এটা তো সংঘের এক নম্বর দাবি। তাই কেন্দ্রকে চাই। তৃণমূল আবার তার বিরোধিতা করছে। আবার বিজেপি নেতারা হুমকি দিচ্ছেন, অসমের মতো এখানে নাগরিক পঞ্জি করবেন। তার বিরোধিতার জন্য তৃণমূলকে আমাদের দরকার। আমার কোন দিকে যাই! নতুন শরিকেরা কি হরিচাঁদ-গুরুচাঁদের ভাবাদর্শ মানেন? না কি শুধু নিজেদের পাওনাটা বোঝেন?’’

উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব দেবেন মোদী, অমিত শাহ— এই স্লোগানকে সামনে রেখে তফসিলি জাতিদের জন্য সংরক্ষিত বনগাঁ কেন্দ্রে প্রচারে ঝাঁপিয়ে সাড়া পেয়েছেন বলে জানালেন মঞ্জুলের তরুণ পুত্র শান্তনু। কর্মীদের বিলি করা গেঞ্জিতেও সেই স্লোগান। কিন্তু তৃণমূল তার বিরোধিতা করছে কেন? প্রশ্নটা করা গেল মমতাবালাকে। জবাবে এল পাল্টা প্রশ্ন— ‘‘যে নাগরিক বিলের কথা বলছে, সেটা পড়ে দেখেছে ওরা? ১২-র বদলে ৬ বছর বাসিন্দা হলে এক রকম নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা বলা হলেও ভোটাধিকার দেবে বলেছে কি? বলেনি।’’

রাজ্যের সিভিক পুলিশ, সিভিক শিক্ষকের মতো কেন্দ্র ‘সিভিক নাগরিকত্ব’ দিতে চায় বলছেন?

বাউন্সার বল মাথা নিচু করে ছেড়ে দিয়ে বলে চলেন মমতাবালা, ‘‘আমরাও চাই উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধান হোক। কিন্তু পূর্ণ নাগরিক অধিকার দিয়ে। তার ওপরে ওরা নাগরিক পঞ্জি করবে বলছে। অসমে কিন্তু হিন্দু বলে কেউ ছাড় পায়নি। রাতারাতি নাগরিক সুবিধা হারিয়েছে তারা। মিথ্যা কথা প্রচার করছে ওরা। ঠাকুরবাড়িকে ধ্বংস করতে চায়।’’ বিজেপির বিরুদ্ধে অভিযোগের ঝুড়ি তাঁর। আরএসএসের মনুবাদী ভাবাদর্শের আঘাত ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের পাশাপাশি দেশের দলিত, তফসিলিদের ওপরও পড়েছে। মতুয়ারা নমঃশূদ্র, তফসিলি জাতি।

গাইঘাটা, ঠাকুরনগর, বনগাঁ, বাগদা, হরিণঘাটা, কল্যাণীতে রাস্তার প্রচারে ফ্লেক্স-ফেস্টুন-পতাকায় পদ্ম আর ঘাসফুলের লড়াইয়ের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে লাল পতাকাও। সিপিএম প্রার্থী অলোকেশ দাস বললেন, ‘‘আসল সমস্যাগুলো আড়াল করতেই ঠাকুরবাড়ি নিয়ে কামড়াকামড়ি করছে তৃণমূল আর বিজেপি। আমরা ওর মধ্যে না ঢুকে মানুষকে সমস্যার কথাগুলো বলছি। বনগাঁ কেন্দ্রের পুরোটাই কৃষিপ্রধান এলাকা। সংস্কারের অভাবে ইছামতী-যমুনার মতো নদী উপচে জল জমা হয় বিস্তীর্ণ কৃষিজমিতে। চাষবাস মার খায়। বাইপাস রাস্তা তৈরি করে যশোর রোডের সমস্যা দূর করার প্রস্তাব আমরা দিয়েছিলাম, কোনও সরকারই গা করেনি। এ দিকে বেনাপোলে ল্যান্ডপোর্ট করার টাকা ফিরে যাচ্ছে। বনগাঁর হাল ফিরে যেত এই পোর্ট হলে। কল্যাণীতে শিল্পসংস্থাগুলো ধুঁকছে। আমরা এই কথাগুলো ঘরে ঘরে গিয়ে বলছি। সংখ্যালঘুদের একটা অংশ থেকেও আমরা বেশ সাড়া পাচ্ছি।’’ তবে পুরনো ভোটব্যাঙ্কের ক্ষয় রোখা যে তাঁদের প্রধান লড়াই, সেটাও মানছেন সিপিএম প্রার্থী।

ঠাকুরে-ঠাকুরে লড়াইয়ে হারিয়ে গিয়েছে উলুখাগড়ার সমস্যা। বনগাঁর লড়াই হয়ে উঠেছে মর্যাদার লড়াই।

পুনশ্চ: কংগ্রেসের এক জন প্রার্থীও আছেন এই কেন্দ্রে। নাম সৌরভ প্রসাদ। তবে কেন্দ্র ঘুরে একটি ‘হাত’-ও চোখে পড়েনি কোথাও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE