Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
general-election-2019-west-bengal

তিন কেন্দ্রে দাপাদাপি শাসকদলের, কেন্দ্রীয় বাহিনী কই? বিরোধীদের তোপের মুখে কমিশন

দার্জিলিং লোকসভার চোপড়ায় সাত সকালেই ৩১ নম্বর জাতীয় সড়ক অবরোধ করেন স্থানীয় বাসিন্দারা। তাঁদের অভিযোগ, সকাল থেকে বুথে বুথে দখল নিয়েছে তৃণমূলের দুষ্কৃতীরা।

রায়গঞ্জ কেন্দ্রের ইসলামপুরের পাটাগড়ায় মহম্মদ সেলিমের গাড়িতে ভাঙচুর করেছে দুষ্কৃতীরা। নিজস্ব চিত্র।

রায়গঞ্জ কেন্দ্রের ইসলামপুরের পাটাগড়ায় মহম্মদ সেলিমের গাড়িতে ভাঙচুর করেছে দুষ্কৃতীরা। নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৮ এপ্রিল ২০১৯ ২১:৫৮
Share: Save:

তিনটি লোকসভা কেন্দ্রে ভোট। তার জন্য বরাদ্দ করা হয়েছিল ১৯৪ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী। নির্বাচন কমিশনের দাবি, ৮০ শতাংশ বুথে মোতায়েন করা হয়েছে কেন্দ্রীয় বাহিনী। কিন্তু তার পরেও বৃহস্পতিবার দিনভর দেখা গেল জায়গায় জায়গায় গত পঞ্চায়েত ভোটের ছায়া। ৫ হাজার ৩৯০টি বুথের প্রহরায় প্রায় ২০ হাজার আধা সেনা জওয়ান থাকলেও রোখা গেল না প্রার্থীর গাড়ির উপর হামলা, ভোটের লাইনে মস্তানদের দাপাদাপি। এমনকি বুথের সামনে এসে গুলিও চালিয়ে গেল দুষ্কৃতীরা! কোথাও বুথের মধ্যে ইভিএমের সামনে দাঁড়িয়ে থাকল বহিরাগতরা। যদিও দিনের শেষে কমিশনের দাবি, ভোট হয়েছে মোটের উপর শান্তিপূর্ণ।

এ দিনটা শুরুই হয় চরম অশান্তি দিয়ে। দার্জিলিং লোকসভার চোপড়ায় সাত সকালেই ৩১ নম্বর জাতীয় সড়ক অবরোধ করেন স্থানীয় বাসিন্দারা। তাঁদের অভিযোগ, সকাল থেকে বুথে বুথে দখল নিয়েছে তৃণমূলের দুষ্কৃতীরা। সাধারণ ভোটারদের বুথে ঢুকতে দেওয়া দূরে থাক, বুথের আশেপাশেই ভিড়তে দিচ্ছে না ওই দুষ্কৃতীরা। অবিলম্বে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করতে হবে, এই দাবি নিয়ে রাস্তায় বসে পড়েন সাধারণ মানুষ। খানিক ক্ষণের মধ্যে বিশাল পুলিশ বাহিনী ঘটনাস্থলে পৌঁছলে আগুনে ঘি পড়ে। পুলিশের উপর ক্ষোভ উগরে দেন বিক্ষোভকারীরা।

অবরোধ তুলতে গিয়ে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে শুরু হয়ে যায় পুলিশের সংঘর্ষ। পুলিশের লাঠি চার্জেও কোনও ফল হয় না। পাল্টা ইটবৃষ্টি শুরু হয় পুলিশকে লক্ষ্য করে। কাঁদানে গ্যাস ছুড়েও পরিস্থিতি আয়ত্তে আনতে ব্যর্থ পুলিশ শূন্যে তিন রাউন্ড গুলিও চালায় বলে অভিযোগ স্থানীয় বাসিন্দাদের। তবে জেলা পুলিশ সুপারের কোনও প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি এ দিন রাত পর্যন্ত।

সাত সকালেই ৩১ নম্বর জাতীয় সড়ক অবরোধ করেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

প্রায় চার ঘণ্টা পর ঘটনাস্থলে পৌঁছয় কেন্দ্রীয় বাহিনী। তাঁরা নিরাপত্তা দিয়ে ভোটারদের বুথে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করলে অবরোধ তোলেন গ্রামবাসীরা। এক স্থানীয় বাসিন্দার অভিযোগ, ‘‘পঞ্চায়েত ভোটের সময়ও ঠিক এ ভাবেই ভোট দিতে দেয়নি তৃণমূলের মস্তানরা। এ বার তাই আমরা ঠিক করে রেখেছিলাম, ভোট দিতে না দিলে রাস্তায় নামব।’’ যদিও তৃণমূলের দাবি, গোটা অশান্তির পিছনে রয়েছে বিজেপির হাত।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

চোপড়ার ধুন্ধুমারের মধ্যেই রায়গঞ্জ কেন্দ্রের ইসলামপুরের পাটাগড়ায় দুষ্কৃতীরা ভাঙচুর করে বিদায়ী সাংসদ এবং সিপিএম প্রার্থী মহম্মদ সেলিমের গাড়ি। প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, সকাল থেকেই ওই বুথে সাধারণ ভোটাররা ভোট দিতে পারছিলেন না। বহিরাগতরা ঢুকে গিয়েছিল ভোট কেন্দ্রে। সেই খবর পেয়েই সেখানে হাজির হন মহম্মদ সেলিম। প্রত্যক্ষদর্শীদের কথায়, সেলিম এবং তাঁর দেহরক্ষী বহিরাগতদের পরিচয় জানতে চান। সেই সময়তেই কিছু দুষ্ক়ৃতী রড, ইট নিয়ে ভাঙচুর করে সেলিমের গাড়ি।

একই রকম ভাবে বুথ দখলের খবর পেয়ে সাংবাদিকরা গোয়ালপোখরে গেলে সেখানে ভোট-মস্তানরা মাটিতে ফেলে ইট, রড দিয়ে বেধড়ক মারধর করে মাথা ফাটিয়ে দেয় এবিপি আনন্দের সাংবাদিকের। চিত্রসাংবাদিকের হাত থেকে ক্যামেরা কেড়ে ভেঙে দেওয়া হয়। উপরের দু’টি ক্ষেত্রেই অভিযোগের তির শাসক দলের দিকে। যদিও এই দুই ঘটনার পরে কমিশন নিযুক্ত রাজ্যের বিশেষ পুলিশ পর্যবেক্ষক বিবেক দুবেকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘‘মোটের উপর ভোট শান্তিুপূর্ণ হচ্ছে।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘ছোটখাটো কিছু ঘটনা তো ঘটবেই। আমরা আমাদের সাধ্য মতো চেষ্টা চালাচ্ছি।’’ রাজ্যের বিশেষ পর্যবেক্ষক অজয় নায়েকের দাবি, চোপড়ায় ১৫০ জন ভোট দিতে পারেননি বলে তিনি অভিযোগ পেয়েছেন।

আরও পড়ুন: বিভ্রান্ত শিল্পনগরে দায় ঠেলাঠেলি মন্ত্রী-সাংসদের, বামেরা বইছে সিটুর ‘পাপের বোঝা’

বিবেক দুবের প্রতিক্রিয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই খাস জলপাইগুড়ি শহরের মধ্যে ঘুঘুডাঙায় বুথের বাইরে ভোটারদের লাইনে শূন্যে গুলি চালানো হয় বলে অভিযোগ ভোটারদের। প্রিসাইডিং অফিসারকেও রীতিমতো হুমকি দেয় ওই দুষ্কৃতীরা। এমনটাই অভিযোগ। যদিও গুলি চলার কথা অস্বীকার করেছেন জেলার রিটার্নিং অফিসার অর্থাৎ জলপাইগুড়ির জেলাশাসক। এ ছাড়াও বিচ্ছিন্ন ভাবে বুথ দখল, ছাপ্পার একের পর এক অভিযোগ এসেছে তিন কেন্দ্রের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। সমস্ত ঘটনার পরেই কমিশনের প্রতিক্রিয়া, ‘‘আমরা রিপোর্ট চেয়ে পাঠিয়েছি।’’

আরও পড়ুন: মমতার মাথা কাটার ফতোয়া দেওয়া বিজেপি নেতাকে ভর্ৎসনা সুপ্রিম কোর্টের

জায়গায় জায়গায় অশান্তির খবর আসতে শুরু করতেই মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিকের অফিসে অভিযোগ জানাতে যান কংগ্রেস নেতা প্রদীপ ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, ‘‘যেখানে যেখানে রাজ্য পুলিশ দায়িত্বে ছিল সেখানেই অশান্তির ঘটনা ঘটেছে।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ে অভিযোগ জানিয়েছি। অনেক জায়গায় ঘটনা ঘটার অনেক পরে কেন্দ্রীয় বাহিনী পৌঁছেছে। যে জায়গায় কেন্দ্রীয় বাহিনীর উপস্থিতি দরকার, সেখানে বাহিনী নেই। বদলে অন্য জায়গায় বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। রাজ্য সরকার চাইছে না নির্বাচন অবাধ এবং শান্তিপূর্ণ হোক। বিবেক দূবে কী করবেন? তাঁকে তো রাজ্যের অফিসারদের নিয়েই কাজ করতে হচ্ছে। রাজ্যের পুলিশ কেন্দ্রীয় বাহিনীকে ভুল পথে চালিত করছে।” এখানেই প্রশ্ন ওঠে, প্রায় তিনশো মাইক্রো অবজার্ভার নিয়োগ করেছে কমিশন। কেন্দ্রীয় বাহিনীকে যদি রাজ্য ভুল পথে পরিচালিত করার চেষ্টা করে, তবে সেই মাইক্রো অবজার্ভাররা কোথায় ছিলেন? সে প্রশ্নের উত্তর এ দিন মেলেনি কমিশনের দফতরে।

বিজেপি নেতা মুকুল রায়ও দাবি করেন, ‘‘যেখানে রাজ্য পুলিশ দায়িত্বে ছিল সেখানেই সমস্যা হয়েছে। সেই কারণেই আমরা প্রথম থেকে সব বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের দাবি করেছি।” কিন্তু একটা প্রশ্ন থেকেই যায়। কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন থাকলেও কি আদৌ এড়ানো যেত ওই হিংসা? কারণ সেখানেও প্রদীপবাবুর কথা অনুযায়ী কেন্দ্রীয় বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করত রাজ্য পুলিশ। আর সেখানে ফের এক বার এসে যায় কমিশনের ভূমিকা। এই অভিযোগ উঠবে তা সবাই জানেন। সে কারণেই কেন্দ্রীয় বাহিনীর গতিবিধি যাতে রাজ্য পুলিশের দ্বারা প্রভাবিত না হয়, সে জন্য নিয়োগ করা হয়েছিল বিশেষ পুলিশ পর্যবেক্ষক। তাঁর উপস্থিতিতেও তা হলে কেন্দ্রীয় বাহিনীর সঠিক ব্যবহার কেন সম্ভব হল না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিরোধী রাজনৈতিক নেতৃত্ব। কমিশনের ওই ভূমিকার প্রতিবাদ করেই মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিকের অফিসের সামনে ধর্নায় বসেন সূর্যকান্ত মিশ্র। রবীন দেব, মনোজ ভট্টাচার্য-সহ বাম নেতৃত্ব।

শুধু হিংসা রুখতে বা ভোটারদের নিরাপত্তা দিতে কমিশন আদৌ কতটা সফল তা নিয়ে প্রশ্নের পাশাপাশি, কোথাও প্রার্থী ফোনে কথা বলতে বলতে ভোট দিচ্ছেন, আবার কোথাও সরকারি আধিকারিক সার্ভিস রিভলবার নিয়ে ভোট দিচ্ছেন। সব ক্ষেত্রেই নির্বাচনের দায়িত্বে থাকা কর্মীরা চুপ।

বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা থেকে সাধারণ মানুষ বৃহস্পতিবার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তাঁদের মতে, বাকি পাঁচ দফা ভোটে আরও কঠিন পরীক্ষার মুখে পড়তে হবে কমিশনকে। যদি এ দিনের কমিশনের ভূমিকা তাঁদের দক্ষতার ট্রেলার হয়, তবে আদৌ কি কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়েও পঞ্চায়েত নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি রোখা যাবে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE