Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

বিদ্রুপে ভরা ঘাটালে ব্যতিক্রমী দেব

ঘাটাল লোকসভা এলাকা জুড়েই ভোটের মুখে আজ ভেসে বেড়াচ্ছে বিদ্রুপের হাজারো সুর।

.

.

সুনন্দ ঘোষ
ঘাটাল শেষ আপডেট: ০৮ মে ২০১৯ ০৩:২৪
Share: Save:

‘বেঁচে থাক, থাক বেঁচে থাক, বিদ্যাসাগর’— বিদ্রুপে বিদ্রুপে জেরবার হতে হয়েছে তাঁকে।

বিধবা বিবাহ প্রচলনের পরে তাঁকে ঠেস দিয়ে এই ছড়া বেঁধেছিলেন হিন্দু সমাজের মাতব্বররা। সত্যি যদি তিনি বেঁচে থাকতেন, আজ তিনি দেব-ভারতীর কেন্দ্রের ভোটার হতেন। আজকের ঘাটাল লোকসভা কেন্দ্রে, ঘাটাল শহরের অদূরেই তাঁর সেই বীরসিংহ গ্রাম।

ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের যে মাটির বাড়িতে প্রায় ২০০ বছর আগে ঈশ্বরচন্দ্রের জন্ম, সেই বাড়ি কবে মাটির সঙ্গে মিশে গিয়েছে। এখন সেখানে কৃত্রিম মাটির বাড়ি। দেখভাল করেন দিলীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর গলাতেও বিদ্রুপের সুর— ‘‘এমন একটা লোকের বাড়িতে নেতা-নেত্রীদের তো আসতে দেখি না!’’

ঘাটাল লোকসভা এলাকা জুড়েই ভোটের মুখে আজ ভেসে বেড়াচ্ছে বিদ্রুপের হাজারো সুর।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

ঘাটাল, দাসপুর, কেশপুর, পাশকুড়া, সবং, পিংলা, ডেবরা— একটু পিছন ফিরে তাকালে বাম জমানার ‘ভয়ার্ত’ চেহারার এক ছবি ফুটে ওঠে। শোনা যায়, পঞ্চায়েত ভোটে এক বার এক স্থানীয় যুবক বুক ঠুকে নির্দল হিসেবে মনোনয়ন পেশ করেছিলেন। পরের দিন স্থানীয় সিপিএম নেতা দলবল নিয়ে তাঁর বাড়ির সামনের দাওয়ায় বিশাল লোহার কড়াই রেখে দরজার কড়া নেড়েছিলেন। ওই যুবকের স্ত্রী বেরিয়ে আসতে বিদ্রুপ করে বলেছিলেন, ‘‘দাদা কি মনোনয়ন প্রত্যাহার করবে? নয়তো দাদাকে মেরে এই কড়াইয়ে রান্না করে মাংস আপনাকে খাইয়ে যাব।’’ বলা বাহুল্য, যুবকের আর নির্বাচনে লড়া হয়নি।

দাসপুরের সামাটে পিচ রাস্তার পাশে হাঁটু মুড়ে বসা প্রাণকৃষ্ণ মিশ্রের গলাতেও বিদ্রুপ— ‘‘হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছে সেই সিপিএম। নিচুতলায় যাঁরা ছিলেন, তাঁরা সুবিধা পেতে তৃণমূলে নাম লিখিয়েছেন। আর নীতি আঁকড়ে ধরে রাখা মানুষগুলো খিল তুলেছেন ঘরে।’’

তবু কিছু ভোট রয়ে গিয়েছে। নইলে মাত্র বছর পাঁচেক আগে সিপিআইয়ের সন্তোষ রাণা কেন সাড়ে তিন লক্ষ ভোট পেয়ে দেব-এর পরে দ্বিতীয় স্থান পাবেন! সে বার কংগ্রেসের মানস ভুঁইয়া শেষ করেছিলেন তিন নম্বরে। বিজেপি প্রায় ৭ শতাংশ ভোট পেয়ে চার নম্বরে। মানস ভুঁইয়া এখন পাশের মেদিনীপুর কেন্দ্রে তৃণমূলের প্রার্থী। কংগ্রেসের পতাকা তুলে দেওয়া হয়েছে ৩১ বছরের মহম্মদ সাইফুলের হাতে। সন্তোষ রাণার জায়গায় সিপিআই প্রার্থী একেবারে আনকোরা তপন গঙ্গোপাধ্যায়।

সাত বিধানসভা এলাকায় মানুষদের সঙ্গে কথা বলে একটি বিষয় পরিষ্কার হয়েছে— বিজেপি প্রাণপণ লড়াই চালাচ্ছে। চার নম্বর থেকে উঠে আসার লড়াই। তৃণমূলের উপরে যাঁরা অসন্তুষ্ট, তাঁদের ভোটটা নিজেদের বাক্সে তুলে নিতে মরিয়া তারা। সবংয়ের ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, সরকারি কোনও কাজই টাকা ছাড়া হচ্ছে না। পিংলা, ডেবরার অভিযোগ, সীমাহীন দুর্নীতিতে ডুবে গিয়েছেন তৃণমূলের স্থানীয়দের একাংশ।

তা হলে এই অভিযোগগুলোকে মূলধন করে বিজেপি অনেকটাই এগিয়ে থাকছে ভোটে! কিন্তু, এখানেও বিদ্রুপ।

জেলার মাটি কামড়ে পড়ে থাকা বিজেপিরই একাংশ জানাচ্ছেন, প্রার্থী অন্য কেউ হলে হয়তো এক রকম হতো! কিন্তু, ভারতী ঘোষকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে তাঁরই অতীত। তিনি মেদিনীপুর জেলার প্রাক্তন পুলিশ সুপার। কেশপুরের যুবকের গলাতে বিদ্রুপের সুর—ওঁর কথাতেই নাকি এক সময়ে বাঘে-গরুতে এক ঘাটে জল খেত! এখন তো দেখছি ওঁকেই সিআইডি জল খাওয়াচ্ছে। ‘‘২ টাকা কেজি চাল, কন্যাশ্রী-সবুজশ্রীর সুবিধা পেয়েছে গ্রামের মানুষ। শুধু শুধু ঘুরে কেন সময় নষ্ট করছেন ভারতী’’— বলছেন কোনানের বাবলু পণ্ডিত।

খোলা আকাশের নীচে কোনও ভিআইপি-র সঙ্গে তাঁর ছবি তুলে নিলে এক সময়ে তর্জনী তুলে, হুমকির মুখে চিত্র-সাংবাদিকদের ছবি মুছে ফেলতে বাধ্য করেছেন। রাজনীতির মঞ্চে দাঁড়িয়ে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে ‘জঙ্গলমহলের মা’ বলেছেন। অভিযোগ, স্থানীয় পুরসভায় কে চেয়ারম্যান হবে, তাও নাকি ঠিক করে দিয়েছেন তিনি।

অভিযোগ, আজও তাঁর দাপট এতটুকু কমেনি। বিদ্রুপ করে এক তৃণমূল নেতা বলেন, ‘‘সাদা সালোয়ার কুর্তার উপরে বিজেপির পতাকার মতো দেখতে উত্তরীয় গলায় ফেলা থাকলেও, আড়ালে রয়ে গিয়েছে ফেলে আসা খাকি পোশাক। বাবা এখনও কী দাপট!’’ এক সময়ে তো মুখ্যমন্ত্রীকে জঙ্গলমহলের মা বলতেন, এখন এত বিরোধিতা কেন? সাংবাদিকের প্রশ্ন শুনে ঝাঁঝিয়ে ওঠেন আজও— ‘‘আই ওয়াজ অ্যাঙ্কারিং দ্য শো (আমি তখন সঞ্চালনার দায়িত্বে ছিলাম কিনা!)।’’

সিপিআইয়ের তপনবাবুর দাবি, এ বারেও তৃণমূলের সঙ্গে মূল লড়াই তাঁদের। এমনকি দিল্লিতে ইউপিএ-কে সামনে রেখে সরকার গড়ার কথাও বলেছেন তিনি। সপ্রতিভ সাইফুল দৌড়ে বেড়াচ্ছেন জেলার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। খেলাধুলো করা পেটানো চেহারা। জানেন, কংগ্রেসের মাটি আলগা। তাঁর কথায়, ‘‘চেষ্টা করে যাব।’’ বিদ্রুপ করে বলেন, ‘‘পঞ্চায়েতে ভোট দিতে গিয়ে মানুষের দারুণ ‘শিক্ষা’ হয়েছে। পাল্টা শিক্ষা দিতে তাঁরা প্রস্তুত হয়ে রয়েছেন।’’

ব্যতিক্রমী শুধু এক জন। তিনি দীপক অধিকারী— মানুষ যাকে দেব বলে জানেন। পাঁচ বছরে অনেকটাই বদলে ফেলেছেন নিজেকে। গত বার ছিলেন শুধুই অভিনেতা। এ বার সঙ্গে নেতাও হয়ে উঠেছেন অনেকটা। কথা বলছেন অকপট। তাঁর কথায়, ‘‘কী ভাবে এত তাড়াতাড়ি পাঁচটা বছর কেটে গেল বুঝতে পারলাম না।’’

আর দশটা রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীর পথে হাঁটতে চান না তিনি। অমায়িক শোনায় তাঁকে, ‘‘গত পাঁচ বছরে ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান নিয়ে, বন্যার সময়ে মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করেছি। কতটা পেরেছি জানি না। যতটা পারিনি, তার দায়ভার একার আমার। আর কারও না।’’ জানিয়েছেন, তাঁকে দেখে নুসরত-মিমিরা ভোটে লড়ার সাহস পেয়েছেন— এটা দেখে তাঁর ভাল লেগেছে।

বিরোধীদের সম্পর্কে কিছু বলবেন?

‘‘বিরোধীদের নামে কুৎসা করা হয় বলেই বোধহয় রাজনীতি নিয়ে সাধারণ মানুষ আজ বীতশ্রদ্ধ,’’ মনে করেন তিনি। তাই, কাউকে আক্রমণের পথে হাঁটতে চান না।

বিদ্রুপ তো একেবারেই নয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE