Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

এ বার স্টার থিয়েটার, জাতীয় সঙ্গীতের সময় উঠে না দাঁড়ানোয় হেনস্থা

দেশপ্রেমের সংস্কৃতি মেলে ধরা? নাকি লোক-দেখানো দেশপ্রেমের নামে গাজোয়ারি? সপ্তমীর সন্ধ্যায় কলকাতার স্টার থিয়েটারে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক দল প্রাক্তনীকে হেনস্থার অভিযোগের ঘটনা উসকে দিয়েছে এই পুরনো বিতর্ক।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ২১ অক্টোবর ২০১৮ ০১:৫৯
Share: Save:

দেশপ্রেমের সংস্কৃতি মেলে ধরা? নাকি লোক-দেখানো দেশপ্রেমের নামে গাজোয়ারি? সপ্তমীর সন্ধ্যায় কলকাতার স্টার থিয়েটারে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক দল প্রাক্তনীকে হেনস্থার অভিযোগের ঘটনা উসকে দিয়েছে এই পুরনো বিতর্ক।

স্টারে একটি নতুন বাংলা ছবি দেখতে গিয়েছিলেন, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সদ্য প্রাক্তন ৮-৯ জন ছাত্রছাত্রী। শো শুরুর আগে জাতীয় সঙ্গীত বাজানোর সময়ে তাঁরা উঠে দাঁড়াননি বলে নিজেরাই ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন। অর্কজা আচার্য নামে এক ছাত্রী পরে বলেন, ‘‘জাতীয় সঙ্গীতের সময়ে না-দাঁড়ানোর অপরাধে গালমন্দ, বিদ্রুপের পরে প্রতিবাদ করি। কিন্তু কাউকে পাশে পাইনি। আমাদের সঙ্গী দু’-তিন জন মেয়ে মার খেতে খেতে বাঁচে!’’ বিরতিতে বেরিয়ে যেতে কার্যত বাধ্য হন তাঁরা। স্থানীয় বড়তলা থানার দ্বারস্থ হয়েছেন এই ছেলেমেয়েরা। পুলিশের বক্তব্য, কারা গোলমাল বাধালেন, খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

কেরল, মুম্বই, গুয়াহাটিতেও মাল্টিপ্লেক্সে একই বিষয় নিয়ে ঝামেলা বাধানোর অভিযোগ উঠেছে। গুয়াহাটিতে হুইলচেয়ার-বন্দি এক যুবকও হেনস্থার শিকার হন বলে অভিযোগ। এ বছরের গোড়ায় সুপ্রিম কোর্টই কিন্তু সিনেমা হলে শো শুরুর আগে জাতীয় সঙ্গীত চালানো নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। জাতীয় সঙ্গীত চলাকালীন দাঁড়ানো বাধ্যতামূলক বলে কোনও নির্দিষ্ট আইন নেই বলেও অভিমত দেশের সর্বোচ্চ আদালতের। এই আইনি দিকটিই মনে করিয়ে দিচ্ছেন, সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি অশোক গঙ্গোপাধ্যায়।

আরও পড়ুন: দুর্ঘটনার দায় নিল না কেউই! ক্ষোভে ফুঁসছে অমৃতসর​

অশোকবাবুর মতে, ‘‘সংবিধানে জাতীয় পতাকা, জাতীয় সঙ্গীতের প্রতি সম্মান দেখাতে বলা হয়েছে। কিন্তু তার মানে উঠে দাঁড়াতে হবেই, তা নয়!’’

জাতীয় সঙ্গীত-জাতীয় পতাকাকে ঢাল করে ভয়ের পরিবেশ তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছে একটি গোষ্ঠী

বরং সিনেমাহলে জাতীয় সঙ্গীতের সময়ে কে দাঁড়ালেন, তার খতিয়ান নেওয়ার মধ্যে এক ধরনের উগ্র জাতীয়তাবাদ চাপানোরই ছক দেখছেন অনেকে। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রাক্তন আমলা তথা অবসরপ্রাপ্ত আইএএস-কর্তা জহর সরকারের কথায়, ‘‘জাতীয় সঙ্গীত-জাতীয় পতাকাকে ঢাল করে ভয়ের পরিবেশ তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছে একটি গোষ্ঠী। অনেকে তাতে প্রভাবিত হয়ে দেশভক্তির ভুল ধারণা আঁকড়ে বসছেন। স্টার থিয়েটারে সম্ভবত সেটাই ঘটেছে।’’ স্টারের সেই তরুণ-তরুণীরা সাম্য দাস, শুভশ্রী দাস বা তিস্তা রায়বর্মণেরা ফেসবুকে সরব হয়েছেন, কী ভাবে তাঁদের ঘিরে ধরে ‘পাকিস্তানে যা’ কিংবা ‘চিনের জাতীয় সঙ্গীতে উঠে দাঁড়াবি না কি’-বলে তেড়ে গিয়েছিলেন সুভদ্র পুরুষ-মহিলারা। অনেকের চোখেই, এ হল আজকের ভারতে কে কী খাচ্ছেন সন্দেহে গণপিটুনি-সংস্কৃতিরই প্রতিচ্ছবি। তা ছাড়া, সিনেমা হলে বাজানো জাতীয় সঙ্গীত আকছার বিকৃত সুরে গাওয়া হয় বলেও অভিযোগ। অশোকবাবু বলছেন, ‘‘দেশপ্রেমের নামে অসভ্যতা মানি না। দেশপ্রেম দেখাতে হলে, গরিবদের উপরে অজস্র অন্যায়ের প্রতিবাদ করুক।’’

তবে জাতীয় সঙ্গীতের সময়ে উঠে দাঁড়ানো নিয়ে আবেগও আছে অনেকেরই। স্টারের পরিচালন কমিটির কর্তা তথা পুরনেতা অতীন ঘোষ বলছেন, ‘‘জুলুমবাজি হলে খুব খারাপ হয়েছে! তবে জাতীয় সঙ্গীতের সময়ে না-দাঁড়ালে অনেকেরই ভাল লাগে না।’’ চিত্রপরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায় স্টারে ‘অভব্যতা’র নিন্দা করছেন। তবে তিনি বলছেন, ‘‘আমার কিন্তু খেলা বা সিনেমার আগে জাতীয় সঙ্গীত হলে উঠে দাঁড়াতে ভালই লাগে!’’

ভিন্ন সুর সাহিত্যিক সমরেশ মজুমদারের। তাঁর কথায়, ‘‘কেউ ভিকট্রিস্ট্যান্ডে ওঠার পরে পতাকা তোলা, জাতীয় সঙ্গীত বাজানোর যুক্তি আছে! কিন্তু খেলা বা সিনেমা শুরুর আগে কেন বাজানো হবে? এ ভাবে যত্র তত্র জাতীয় সঙ্গীতের প্রয়োগে আমরা সব কিছু কেমন সস্তা করে ফেলছি!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Nationalism National Anthem Controversy Court
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE