Advertisement
E-Paper

কলকাতার আশপাশেই রয়েছে ছবির মতো গ্রামীণ রথের মেলা! এক দিনের ছুটি নিয়ে ছুঁয়ে ফেলুন ছোটবেলা

মেলার মাঠ, রাস্তায় সারি সারি মাথা, তার পিছনে রথের চুড়ো, জিলিপি-পাঁপড়ের গন্ধ, হইহল্লা। কিন্তু বয়স যত বেড়েছে, ততই জীবন থেক দূরে সরে গিয়েছে ওই সমস্ত দৃশ্যপট।

আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক

শেষ আপডেট: ২৬ জুন ২০২৫ ১৮:২৫
ঘরের কাছে গ্রামের মেলা ঘুরে আসুন রথযাত্রার দিনে!

ঘরের কাছে গ্রামের মেলা ঘুরে আসুন রথযাত্রার দিনে! মূল ছবি: ফ্রিপিক। গ্রাফিক— সনৎ সিংহ।

সাদা কাগজে মোম রং ঘষে সবুজ মাঠ, নাগরদোলা, চুড়ির দোকান, রঙিন বলের ভেল্কি দেখানোর ছবি আঁকেননি, এমন মানুষ কমই আছেন বঙ্গে। রথের মেলার ছবি বললে আজও চোখের সামনে তেমনই ছবি ভাসে। মেলার মাঠ, রাস্তায় সারি সারি মাথা, তার পিছনে রথের চুড়ো, জিলিপি-পাঁপড়ের গন্ধ, হইহল্লা, কেনাকাটি ইত্যাদি। কিন্তু বয়স যত বেড়েছে, ততই জীবন থেকে দূরে সরে গিয়েছে ওই সমস্ত দৃশ্যপট। ব্যস্ত জীবনে আর ওই আবহে ভাসার সময় পান না অনেকেই। রথযাত্রার উৎসব যদিও ফিরে ফিরে আসে।

চাইলে ছুটন্ত জীবন থেকে একটা দিনের অবসর নিয়ে সেই উৎসবে শামিল হতে পারেন। তার জন্য খুব বেশি সময় ব্যয় করতে হবে না। কলকাতা থেকে কয়েক ঘণ্টার দূরত্বেই রয়েছে ছোটবেলার আঁকার খাতার ছবির মতো সব গ্রামীণ বা মফস্‌সলি রথের মেলা। দু’-এক ঘণ্টা গাড়ির চাকায় সওয়ার হয়ে সেখানে গিয়ে পড়লেই দেখবেন ছোটবেলার মেলার ছবি বাস্তব হয়ে ফুটে উঠছে চোখের সামনে!

গুপ্তিপাড়ার রথের মেলা

এ বছর ২৮৫ বছর পূর্ণ করল গুপ্তিপাড়ার রথযাত্রা। আর এই রথযাত্রাকে ঘিরে যে মেলা বসে তা-ও বহু পুরনো। ছড়ানো মাঠের এক পাশে কাচের চুড়ি, কাঠের বাসন, মাটির জিনিস, ঘরোয়া প্রয়োজনের জিনিসপত্রের ছোট ছোট দোকান, অন্য দিকে মাঠের মাঝখানে বেতের নানা রকমের জিনিসপত্র, মাটির খেলনা, জিলিপি, পাঁপড়ভাজা নিয়ে বসে মেলার বাজার। থাকে ফলের দোকানও। যেখান থেকে বিঘত মাপের আম, বড় বড় মাপের কাঁঠাল, আনারস, তরমুজ কিনে নিয়ে যেতে পারেন কিংবা কাটিয়ে খেতেও পারেন। মেলা থেকে কিছু দূরেই বৃন্দাবনচন্দ্র জিউয়ের মন্দির। যেখান থেকে শুরু হয় গুপ্তিপাড়ার বিখ্যাত রথযাত্রা। মেলা দেখার ফাঁকে টান দিতে পারেন সেই রথের দড়িতেও।

গুপ্তিপাড়ার রথের মেলা।

গুপ্তিপাড়ার রথের মেলা। ছবি: দেবরাজ দাস।

গুপ্তিপাড়ার রথটির উচ্চতা ৩৬ ফুট, অর্থাৎ চারতলা সমান। আকারে নবরত্ন মন্দিরের মতো। বৃন্দাবনচন্দ্র জিউ মঠ থেকে ওই রথ টেনে নিয়ে যাওয়া হয় ১.৫ কিলোমিটার দূরে গোসাইনগঞ্জ বড়বাজারের গুন্ডিচা মাসির বাড়ি পর্যন্ত। শোনা যায়, পুরীর পরে নাকি গুপ্তিপাড়াতেই এত দীর্ঘ রথযাত্রা হয়। তবে গুপ্তিপাড়ার রথের মূল আকর্ষণ এখানকার ভান্ডার লুটের রীতি। উল্টো রথের দিন জগন্নাথের মাসির বাড়িতে ৫২টি লোভনীয় রান্নার প্রায় ৪০ কুইন্টাল ভোগ মালসায় সাজিয়ে মাসির বাড়িতে রাখা হয়। এর মধ্যে থাকে গোবিন্দভোগ চালের খিচুড়ি, বেগুনভাজা, কুমড়োভাজা, ছানার রসা, পায়েস, ক্ষীর, পোলাও, মালপোয়া, সন্দেশ, রাবড়ি ইত্যাদি। মালসায় ওই সব খাবার সাজিয়ে ভক্তদের জন্য মাসির বাড়ির দরজা খুলে দেওয়া হয় ভান্ডার লুটের জন্য।

মহিষাদল রথের মেলা

রথ উপলক্ষে মহিষাদল রাজবাড়ির কাছে শহিদ বেদি থেকে গুন্ডিচাবাটী পর্যন্ত রাস্তার ধারে বসে মেলা। এককালে এই মেলায় আসর বসত পালাগান, কীর্তনের। মৃৎশিল্পের প্রদর্শনীও হত। কলকাতা থেকে আসত যাত্রা। এখন মহিষাদলের মাসির বাড়িতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয় সাত দিন ধরে। সার্কাস, ম্যাজিক, মোটরসাইকেলের মরণঝাঁপের মতো ভেল্কিও দেখা যাবে মেলায় এলে। তবে মহিষাদলের মেলার একটি বড় আকর্ষণ সবং-এর মাদুর। নানা দামের মাদুর পাওয়া যায় এই মেলায়। থাকে মাটির খেলনা, স্থানীয় শিল্পীদের তৈরি ফুলদানি, ল্যাম্প এবং গ্রামীণ জীবনের প্রয়োজনীয় বিবিধ জিনিসপত্র। বসে পাখির মেলাও। ১৭৭৬ সালে রাজা আনন্দলাল উপাধ্যায়ের স্ত্রী রানি জানকী দেবীর হাত ধরে মহিষাদল রাজবাড়ির রথযাত্রার সূচনা হয়। তার পর থেকে ২৪৯ বছর ধরে এই উৎসব সমানে চলেছে।

মাহেশের রথের মেলা চলে প্রায় এক মাস।

মাহেশের রথের মেলা চলে প্রায় এক মাস। ছবি: সংগৃহীত।

মাহেশের মেলা

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘রাধারাণী’ উপন্যাসে রয়েছে মাহেশের রথের কথা। যে রথের মেলায় মালা বিক্রি করতে গিয়ে হারিয়ে গিয়েছিল সেই কাহিনির নায়িকা রাধারাণী। তবে মাহেশের মেলার ইতিহাস তারও বহু বহু বছরের পুরনো। ১৩৯৬ সাল থেকে শুরু হওয়া ওই রথযাত্রা ২০২৫ সালে পড়ল ৬২৯তম বছরে। রথটির বয়স অবশ্য ১৩৭ বছর। এককালে বৈদ্যবাটির এক ভক্তের অর্থে তৈরি কাঠের রথ নষ্ট হয়ে যায়। তার পরেও বহু বার রথ নষ্ট হয়েছে। এখন যে রথটি রয়েছে সেটি লোহার। ১৮৮৫ সালে ওই রথ মার্টিন বার্ন কোম্পানিকে দিয়ে তৈরি করিয়েছিলেন শ্যামবাজারের বসু পরিবারের কৃষ্ণচন্দ্র বসু। মাহেশের রথও ন’টি চূড়া বিশিষ্ট। উচ্চতা ৫০ ফুট। রয়েছে ১২টি লোহার চাকা। দু’টি তামার ঘোড়া। কথিত আছে, সাধক ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারী স্বপ্ন পেয়ে গঙ্গায় ভেসে আসা নিমকাঠ দিয়ে মাহেশের রথের দারুমূর্তি তৈরি করেন। জনশ্রুতি চৈতন্যদেবও পুরী যাওয়ার পথে মাহেশে এসে দেখে মাহেশকে ‘নব নীলাচল’ বলে নামকরণ করেছিলেন। মাহেশের এই রথযাত্রা ঘিরে যে মেলা বসে, তা চলে প্রায় এক মাস। বড় মাঠে বসে মেলা। কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুল থেকে শুরু করে ঘূর্ণির কাঠের কাজ, হস্তশিল্পীদের গয়নার দোকানও থাকে এই মেলায়।

বারুইপুরের মেলা

গ্রামের মানুষ জগন্নাথের ভক্ত। কিন্তু পুরীর রথের উৎসবে যোগ দিতে পারেন না, তাই বারুইপুরের জমিদার রাজবল্লভ রায়চৌধুরী গ্রামেই রথযাত্রার উৎসব চালু করেন ৩০০ বছর আগে। জমিদারি না থাক, রথ রয়ে গিয়েছে। শালকাঠের তৈরি রথ টানা হয় ব্রিটিশ আমলের লোহার শিকল দিয়ে। যে রথযাত্রা ঘিরে এখনও প্রায় এক মাস ধরে মেলা চলে বারুইপুরের রাসমাঠে। শহরের কাছে হলেও মফস্‌সলের এই মেলায় এক বেলার জন্য গেলে মন ভাল হয়ে যাবে।

বৈঁচিগ্রামে মেলা উপলক্ষে পুতুল নাচের আসর বসে।

বৈঁচিগ্রামে মেলা উপলক্ষে পুতুল নাচের আসর বসে। — প্রতীকী চিত্র।

বৈঁচিগ্রামের দাঁ বাড়ির রথের মেলা

রথের মেলায় বৈঁচিগ্রাম দাঁ বাড়িতে গেলে দেখা মেলে পুতুলনাচের। কয়েকশো বছর আগে কালীপদ দাঁ বৈঁচি গ্রামের রথের সূচনা করেছিলেন। তবে ওই রথে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার দেখা পাওয়া যায় না। দেখা মেলে দাঁ বাড়ির কূলদেবতা রাজরাজেশ্বরীর। রথযাত্রা উপলক্ষে যে মেলা বসে সেখানেই প্যান্ডেল খাটিয়ে বসানো হয় পুতুলনাচের আসর। নানা পৌরাণিক কাহিনি উঠে আসে পুতুলনাচে, যা দেখতে ভিড় জমান আশপাশের গ্রামের বাসিন্দারাও।

শান্তিপুরের রথের মেলা

রথযাত্রা মানে জগন্নাথদেব বলেই মনে করা হয় সাধারণত। কোথাও কোথাও গোবিন্দ বা বৃন্দাবন বা মদনমোহনও থাকেন রথে। শান্তিপুরে কিন্তু তা নয়। সেখানকার সবচেয়ে প্রাচীন তিন বাড়ি— বড়গোস্বামী বাড়ি, মধ্যম বা হাটখোলা গোস্বামী বাড়ি এবং সাহাবাড়ির প্রাচীন রথে শোভা পায় রঘুনাথ বা রামচন্দ্রের মূর্তি। সঙ্গে জগন্নাথদেব থাকলেও বলরাম এবং সুভদ্রা অনুপস্থিত। বৈষ্ণবতীর্থ শান্তিপুরে রথে রথী রঘুনাথ কেন, তার ব্যাখ্যা না মিললেও, মেলায় ভিড় হয় বিস্তর।

মাটির পুতুল থেকে শুরু করে মাটির বাসনের সম্ভার নিয়ে শুলাটির মেলায় আসেন বহু শিল্পী।

মাটির পুতুল থেকে শুরু করে মাটির বাসনের সম্ভার নিয়ে শুলাটির মেলায় আসেন বহু শিল্পী। ছবি: শাটারস্টক।

শুলাটির রথের মেলা

শুলাটি রথের মেলায় দেখা মেলে সারি সারি মাটির পুতুল, মাটির খেলনা, মাটির বাসন কোসনের পসরা। শুলাটির জমিদার ঘোষ পরিবারের তরফে ২০০ বছর আগে ওই রথের উৎসব শুরু হয়। সেকালে অবশ্য রথযাত্রার চাকচিক্য ছিল আরও বেশি। শোনা যায়, ন’দিনের মেলা বসত ওই রথযাত্রাকে ঘিরে। বসত পুতুলনাচের আসরও। মাহেশের রথের জাঁকজমকের সঙ্গে তুলনা টানা হত শুলাটির ঘোষবাড়ির রথের। সেই জৌলুস এখন না থাক, রথ এবং রথের মেলা রয়েছে এখনও। শুলাটি মেলার মূল আকর্ষণ মাটির পুতুল, মাটির খেলনা এবং চারাগাছ। মেলায় ছোট-বড় প্রায় ২০০ থেকে ২৫০টি দোকান বসে। সেখানে মাটির হাড়ি, কড়াই, উনুন, শিল-নোড়া, হাতা-খুন্তিও পাওয়া যায়।

কুলীন গ্রামের রথের মেলা

কলকাতা থেকে পৌনে দু’ঘণ্টার দূরত্বে পূর্ব বর্ধমানের এই গ্রামের মেলা অন্তত ৩০০ বছরের পুরনো। কুলীন গ্রাম বৈষ্ণবদের তীর্থক্ষেত্র। কারণ এ গ্রামে চৈতন্যদেব এসে ছিলেন দিন তিনেক। তবে তার থেকেও বেশি এ মেলার মাহাত্ম্য ‘পট্টডোরী’র জন্য। পট্টডোরী হল তুলো আর রেশমের সুতোর এক ধরনের দড়ি। এই দড়ি দিয়ে পুরীর রথের সঙ্গে জগন্নাথ, বলরাম আর সুভদ্রার মূর্তি জড়িয়ে রাখা হত। কথিত আছে শ্রীচৈতন্যদেবের নির্দেশেই তা পাঠানো হত শ্রীক্ষেত্রে। কিন্তু সে প্রথা বছর দশেক আগে বন্ধ হয়। ৩০০ বছর আগে পুরীর সঙ্গে এই ভাবেই জুড়েছিল কুলীন গ্রাম। সেই সময় থেকেই এ গ্রামে নিজস্ব রথযাত্রাও শুরু হয়। প্রতিষ্ঠিত হয় জগন্নাথ মন্দির। রথের দিন সেই মন্দির থেকেই শুরু হয় রথযাত্রা। গ্রামের মানুষ টান দেন রথের রশিতে। লালমাটির রাস্তার পাশে মেলা বসে। সেখানে জিলিপি, পাঁপড়ভাজা, নাগরদোলার দেখা যেমন পাওয়া যায়, তেমনই দেখা যায় কাঁঠালের মেলাও। কারণ কুলীন গ্রামের জগন্নাথের প্রিয় ভোগ কাঁঠাল। রথের দিনও তাঁকে কাঁঠাল ভোগই দেওয়া হয়। সোজা রথ থেকে উল্টোরথ পর্যন্ত সাত দিন ধরে চলে ওই মেলা।

গ্রামীণ পরিবেশে বড় মেলা বসে দশঘড়ায়।

গ্রামীণ পরিবেশে বড় মেলা বসে দশঘড়ায়। —প্রতীকী চিত্র।

দশঘরার রথের মেলা

হুগলির মাহেশের রথের মতোই দশঘরার রথের মেলারও ঐতিহ্য রয়েছে। তাকে ঘিরে রয়েছে নানা রকমের গল্পও। দশঘরায় এককালে তিনটি রথ ছিল বলে শোনা যায়। ওড়িশার রাজা অনন্তবর্মণের প্রতিনিধি সদানন্দদেব ওই রথ তৈরি করিয়েছিলেন। পুরীর জগন্নাথ, বলরাম এবং সুভদ্রার নামে উৎসর্গ করে একটি ২১ চূড়া, ১৩ চূড়া এবং একটি ৯ চূড়া বিশিষ্ট রথ তৈরি করিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সেই রথ আগুনে পুড়ে যায়। বেঁচে যায় শুধু ১৩ চূড়ার রথটি। পরবর্তী দশঘরার বিশ্বাস রাজবাড়ির তরফে রথটি সংস্কার করে রথযাত্রা শুরু হয়। কিন্তু সেই রথও ২০০৭ সালে পুড়ে গেলে বিশ্বাস পরিবার নিজেদের খরচে নতুন রথ নির্মাণ করেন, যা এখন টানা হয়। এই রথযাত্রা ঘিরেও গ্রামীণ পরিবেশে বড় মেলা বসে। যেখানে বেতের নানা রকমের জিনিসপত্র, মাটির বাসন, মাটির পুতুল ইত্যাদি বিক্রি হয়। তবে এই মেলা সাত দিন ধরে চলে না। সোজা রথের পরের দিনই হয়ে যায় উল্টো রথের অনুষ্ঠান। মেলাও দু’দিনই স্থায়ী হয়।

Rath Yatra Village Fare Rath Yatra 2025 Rath yatra Festival Rath Yatra Travel Travel Tips Day Trip From Kolkata One day trip near Kolkata
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy