কাশ্মীর, হিমাচল প্রদেশ, উত্তরাখণ্ড— বেড়ানোর তালিকায় থাকে বরাবরই। তবে এ বার একটু অন্য ভাবেও ভাবতে পারেন। চারচাকায় সওয়ার হয়ে পুজোর দিনগুলিতে কোথাও বেড়াতে যেতে চাইলে বেছে নিন রাজগীর। পাহাড় এবং অরণ্যে ঘেরা জনপদের প্রতিটি কানাচে ইতিহাস।
আজও ঘোড়ার গাড়ি চলে সেখানে। মসৃণ বাঁধানো পথে টাঙ্গায় চড়েই ঘুরে নেওয়া যায় পাহাড়ি শহরের আনাচ-কানাচ। এক সময়ের অপরিচ্ছন্ন শহর এখন আগের চেয়ে ঝাঁ-চকচকে। পর্যটনের প্রসারে তৈরি হয়েছে স্কাইওয়াক। রয়েছে অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টসের সুযোগ-সুবিধাও। হাতে দিন পাঁচ-ছয় সময় থাকলে কী ভাবে কলকাতা থেকে ঘুরে নেবেন বুদ্ধগয়া, নালন্দা এবং রাজগীর?
রাজগীরে এখনও চলে টাঙ্গা। ছবি: সংগৃহীত।
কলকাতা থেকে বর্ধমান হয়ে আসানসোলের পথ। খুব ভোর ভোর বেরিয়ে পড়লে ফাঁকা রাস্তা এবং ভোরের আবহ— দুই হতে পারে উপভোগ্য। চা খাওয়ার বিরতি নিতে পারেন আসানসোলে। সেখান থেকে তোপচাঁচি-পরেশনাথের রাস্তা ধরে এগোলে পৌঁছবেন বুদ্ধগয়া। ভোরবেলা যাত্রা শুরু হলে সন্ধ্যার মুখেই ঢুকে পড়তে পারবেন বুদ্ধগয়া।
গন্তব্যে পৌঁছনোর তাড়াহুড়ো না থাকলে আসার পথে দেখে নিতে পারেন তোপচাঁচি হ্রদটিও। এক সময় বহু বাংলা ছবির শুটিং হয়েছিল সেখানে। পরেশনাথ পাহাড় এবং মন্দিরও ঘোরা যায়। তবে সে জন্য আলাদা ভাবে একটি দিন বরাদ্দ করতে হবে।
বুদ্ধগয়া
এখানে তরুণ সিদ্ধার্থ খ্রিস্টজন্মের প্রায় ছ’শো বছর আগে বোধিলাভ করেছিলেন। এখন সেখানে মহাবোধি মন্দির। মন্দিরের পাশে অশ্বত্থ গাছের নীচেই সিদ্ধার্থের বোধিলাভ হয়। যার পাশে বুদ্ধের স্তূপ তৈরি করেছিলেন সম্রাট অশোক। দ্বিতীয় শতাব্দী পর্যন্ত ওই স্তূপই ছিল বৌদ্ধদের প্রধান আরাধ্য স্থান। তার পর সেখানে তৈরি হয় মহাবোধি মন্দির। মন্দিরের ভিতরে সোনার জল করা কষ্টিপাথরের ভূমিস্পর্শ মুদ্রায় বুদ্ধের বসে থাকার মূর্তি তৈরি করেন পাল রাজারা। ৪৮ বর্গফুট চৌকো বেসমেন্টের বুকে উপরের দিকে উঠে গিয়েছে মন্দির। লম্বায় যা প্রায় ১৭০ ফুট।
মহাবোধি মন্দির চত্বরটিও সুন্দর করে সাজানো। — নিজস্ব চিত্র।
ওই মন্দির চত্বর থেকে খানিক দূরে দূরে তৈরি হয়েছে ৮০ ফুটের বুদ্ধমূর্তি, অজস্র বৌদ্ধবিহার। চিন, জাপান, শ্রীলঙ্কা, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়ার মতো নানা দেশের স্থাপত্যশৈলীতে বুদ্ধগয়ায় তৈরি করা হয়েছে বুদ্ধের বিহার বা মন্দির। সারা বিশ্বের বৌদ্ধদের কাছে বুদ্ধগয়া অন্যতম শ্রেষ্ঠ তীর্থক্ষেত্র। দিনের বেলা মহাবোধি মন্দিরের রূপ এক রকম, সন্ধ্যায় আলো জ্বললে সেই রূপ একেবারে আলাদা।
বরাবর গুহা এবং নালন্দা এবং রাজগীর
স্থানটি একটু ভাল ভাবে ঘুরতে হলে অন্তত দু’টি দিন থেকে যেতে হবে সেখানেই। বুদ্ধগয়া থেকে ঘণ্টাখানেকের পথ বরাবর গুহা। গ্রাম্য পথের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতেই পৌঁছে যেতে পারেন সেখানে। বরাবর এবং নাগার্জুনি পাহাড়ের মধ্যে রয়েছে একাধিক গুহা। পাথরে কেটে নির্মিত গুহায় সম্রাট অশোকের শিলালিপিও পাওয়া গিয়েছিল বলে শোনা যায়। মৌর্যযুগের ইতিহাসের দলিল রয়েছে এই স্থানে। এখান থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে নালন্দা। পথে পড়ে ফল্গু নদী। বছরভর শুষ্ক নদী বর্ষায় জলে টইটম্বুর হয়ে ওঠে।
বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় নালন্দা। প্রায় ১৪ হেক্টর এলাকা জোড়া এই বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে পুরাতাত্ত্বিকদের মত, এটা শুধু মাত্র নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল এলাকা। আরও প্রায় ১০ কিলোমিটার এলাকায় খননকার্যে মিলছে ওই সময়কার নানা ঐতিহাসিক নিদর্শন। নালন্দায় অবশ্য বেশির ভাগটাই ধ্বংসাবশেষ। তার মধ্যেই কুষাণ রাজাদের সময়কার স্থাপত্যে তৈরি বিভিন্ন মুদ্রায় বুদ্ধমূর্তি, ছাত্রদের থাকার জায়গা, প্রার্থনাস্থান দেখার মতো। বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরের ঠিক বাইরে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের মিউজিয়ামটিও ঘুরে নিতে পারেন। বুদ্ধগয়া থেকে বরাবর গুহা হয়ে নালন্দার পথে তেমন খাবার মিলবে না। তাই সঙ্গে জল এবং খাবার— দুই নিয়ে নেওয়া ভাল।
প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় নালন্দার ধ্বংসাবশেষ। — নিজস্ব চিত্র।
রাজগীর
নালন্দা দেখে নিয়ে রওনা হয়ে যান রাজগীরের দিকে, প্রাচীন মগধের প্রথম রাজধানী। দূরত্ব মাত্র ১৫-১৬ কিলোমিটার। পথে সিলাও গ্রামে দাঁড়াতে পারেন। এখানে মিলবে বিহারের বিখ্যাত ‘সিলাও খাজা’।
রাজগীরের রোপওয়ে চড়ে যাওয়া যায় শান্তিস্তূপে। ছবি: সংগৃহীত।
মগধ তো বটেই, বুদ্ধের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে রয়েছে রাজগীর। রোপওয়ে দিয়ে উঠে যাওয়া যায় রত্নগিরি পর্বতে। সেখানে জাপানিদের তৈরি মঠ ও শান্তিস্তূপ দেখার মতো। তার পাশেই গৃধ্রকূট পর্বত। যেখানে বহু উপদেশ শিষ্যদের দিয়ে গিয়েছিলেন বুদ্ধ। এক সময়ের রাজগীরের খোলা রোপওয়ে নিয়ে ভয় থাকলেও, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদল এসেছে তাতে। ক্যাপসুলের মতো রোপওয়ে চড়ে নির্ভয়ে পাহাড় চড়তে পারেন পর্যটকেরা। আর আছে হিন্দুদের তীর্থক্ষেত্রে উষ্ণ প্রস্রবণ এবং বৈভব পাহাড়ের উপরে সপ্তপর্ণী গুহা।
ইতিহাসের এই শহরে এখন নতুন আকর্ষণ স্কাইওয়াক বা গ্লাস ব্রিজ। টিকিট কেটে অরণ্যপথে খানিক গাড়িতে, কিছুটা হেঁটে সেখানে পৌঁছতে হয়। টিকিট কাটার হ্যাপা, লাইনে দাঁড়ানোর ঝক্কি আছে বটে। তবে এক বার কাচের সেতুতে উঠলে সমস্ত কষ্ট লাঘব হয়ে যাবে। চার পাশে পাহাড়, আর তার মাঝে তৈরি এই সেতু থেকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দারুণ উপভোগ্য হয়ে ওঠে। কাচের সেতু অব্দি পৌঁছতে গেলে নেচার সাফারির টিকিট অনলাইন বা অফলাইনে কাটতে হয়। পুজোর দিনে গেলে, অন্তত তিন দিন আগে অনলাইনেই টিকিট কেটে না ফেললে, সমস্যা হতে পারে। আর আছে জু সাফারি। পরিচ্ছন্ন পথে গাড়ি করে বন্যপ্রাণ দর্শনের সুযোগ হবে এখানে।
রাজগীরের গ্লাস ব্রিজই এখন নতুন আকর্ষণ। ছবি: সংগৃহীত।
রাজগীর একটু ভাল করে ঘুরতে হলে দিন তিনেক লাগবেই। রাজগীর থেকে ১৯ কিলোমিটার দূরে পাওয়াপুরী। জৈনদের তীর্থস্থান। পাওয়াপুরীর সবচেয়ে সুন্দর জায়গাটি হল জল মন্দির। পদ্মে ভরা জলাশয়ের মাঝ বরাবর তার অবস্থান। একটি দিন টাঙ্গা করে রাজগীরের আশপাশের এই দর্শনীয় স্থানগুলি ঘুরে নিতে পারেন।
কোথায় থাকবেন?
বুদ্ধগয়া, নালন্দা এবং রাজগীর— সব জায়গাতেই থাকা যায়। রাজগীর বাসস্ট্যান্ডের কাছে বিভিন্ন মানের হোটেল আছে। বুদ্ধগয়াতেও বিভিন্ন মানের হোটেল মিলবে। সরকারি পর্যটন আবাস রয়েছে বুদ্ধগয়া এবং রাজগীরে।
কী ভাবে যাবেন?
কলকাতা থেকে বুদ্ধগয়া গিয়ে রাজগীর ঘুরে ফিরতে পারেন। কলকাতা থেকে বুদ্ধগয়ার দূরত্ব সড়কপথে ৪৮০ কিলোমিটার। রাজগীর থেকে কলকাতা কোডরমা হয়ে ফিরতে পারেন। এটি সহজ পথ। দূরত্ব ৫১০ কিলোমিটার। রাস্তাও মসৃণ। কোডরমা ঘাটি অঞ্চলে রাস্তা দিনের আলো থাকতে থাকতে পেরিয়ে এলে ভাল। সুযোগ থাকলে তিলাইয়া বাঁধ এবং জলাধারটি ঘুরে নিতে পারেন। এই পথে ধানবাদ পড়বে। রাস্তা দীর্ঘ মনে হলে সেখানে রাত্রিবাস করতে পারেন।
হাতে সময় কম থাকলে বুদ্ধগয়ায় একটি রাত কাটান। বাদ দিতে পারেন বরাবর গুহাও। আবার দিন যদি বাড়াতে পারেন, ধানবাদে বথিন্ডা, উস্রী জলপ্রপাতও ঘুরে নিতে পারবেন। রাজগীর হয়ে ফেরার সময় দেওঘরও সফরে জুড়ে নিতে পারবেন।