ঘর থেকে যদি বা বাইরে চোখ যায়— কোথায় শরতের আকাশ? চার দিকে তো শুধু গোটানো-প্যাঁচানো তারের জঙ্গল, নয়তো সুউচ্চ বহুতল। তার ফাঁক দিয়ে যদি বা কিছু দেখা যায়— তাতে কি আর আকাশ দেখার সাধ মেটে?
চিরকাল বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় পড়ে আসা বাঙালি তাই আজও খোঁজে আকাশ, খোঁজে এক এমন রাজত্ব, যার সীমানা অসীম, যেখানে চোখ মেললেই পাহাড় দেখা যায়, যেখানে ভিড় করে গাছেরা।
এ বারের পুজোর ঠিকানা হোক সাহিত্যের পাতার সেই স্থান। বুদ্ধদেব গুহর নানা উপন্যাসে উঠে আসা ম্যাকলুস্কীগঞ্জ। সঙ্গে থাকা বর্ষায় জলে ভরে ওঠা হুড্রু, জোনা, দশমের আকর্ষণ।
চারচাকায় সওয়ার হয়ে চলুন রাঁচী। সেখান থেকেই ঘুরে নেওয়া যাবে ম্যাকলুস্কীগঞ্জ, নেতারহাট। সবসুদ্ধ দিন পাঁচেকের পরিকল্পনা। তবে জায়গা কমিয়ে বা বাড়িয়ে দিন বাদ দিতে বা জুড়তেও পারেন।
যাওয়ার পথেই ঘুরে নিন দশম জলপ্রপাত। ছবি: সংগৃহীত।
কলকাতা থেকে যত তাড়াতাড়ি সফর শুরু করা যায়, ততই সুবিধা হতে পারে। সঙ্গী যখন চারচাকা, তখন ঘুরতে ঘুরতেই যাওয়ার পরিকল্পনা সাজানো ভাল। কোলাঘাট, খড়্গপুর হয়ে রাস্তা গিয়েছে ঘাটশিলার দিকে। বহড়াগোড়া হয়ে এগোতে হবে। পথে লোধাশুলির জঙ্গল পড়বে। সুযোগসুবিধা মতো কোথাও একটু গাড়ি দাঁড় করিয়ে হাত-পা ছাড়িয়ে নিতে পারেন। উপভোগ করতে পারেন সবুজ প্রকৃতি। তার পর সোজা চলুন ঘাটশিলা। সেখানেই মধ্যাহ্নভোজ সেরে ঢুঁ মেরে নিতে পারেন গালুডি ড্যামে। তার পর চান্ডিল হয়ে রাঁচি। এই পথে যাওয়ার সময় ঘুরে নিতে পারেন দশম জলপ্রপাত। বর্ষায় জলপ্রপাতের রূপ বদলে গিয়েছে। দুর্গাপুজো যে হেতু একটু আগেই, তাই পুজোয় গেলে জলপ্রপাতের রূপ উপভোগ্য হবে। দশমে কাটান বিকেল। তার পর রাঁচী পৌঁছে বরং বিশ্রাম নিয়ে নিন রাতটা।
পরের দিনটি রাখুন শহরটি ঘুরে দেখার জন্য। হুড্রু, জোনা, টেগোর হিল-সহ বেশ কয়েকটি দর্শনীয় স্থান রয়েছে এখানে। সম্ভব হলে পত্রাতু ভ্যালিও জুড়ে নিতে পারেন। রাঁচিতে দ্বিতীয় দিনটি নিজেদের মতো করে ঘুরে নিন। রাতটা রাঁচি শহরে থেকে পরের দিন সকাল সকাল বেরিয়ে পড়ুন ম্যাকলুস্কীগঞ্জ উদ্দেশে। দূরত্ব ৬০ কিলোমিটার।
ম্যাকলুস্কীগঞ্জের উপর দিয়েই বয়ে গিয়েছে নদী। অরণ্যঘেরা স্থানটি নিয়ে যাবে সাহিত্যের পাতায়। ছবি: সংগৃহীত।
বুদ্ধদেব গুহের উপন্যাসের ম্যাকলুস্কীগঞ্জ পুরোপুরি না হলেও, অনেকটাই আগের মতো আছে। রয়েছে এর সুদীর্ঘ ইতিহাস। শোনা যায়, অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ব্যবসায়ী আর্নেস্ট টিমোথি ম্যাকক্লাস্কি এই জায়গার সৌন্দর্য দেখে প্রেমে পড়ে যান। এখানকার জলবায়ু এতটাই স্বাস্থ্যকর এবং মনোরম ছিল যে, তিনি ছোটনাগপুরের রাজার কাছ থেকে অনেকটা জমি কেনেন। পরবর্তীতে সেখানে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান বসতি গড়ে ওঠে। সেই সব স্মৃতি আঁকড়েই বসে রয়েছে শহরটি। লোকমুখে ম্যাকক্লাস্কির নাম বদলে গিয়েছে। এখন এই জায়গা পরিচিক ম্যাকলুস্কীগঞ্জ নামে।
ম্যাকলাস্কিগঞ্জে সর্বধর্মস্থল। ছবি: সংগৃহীত।
পরবর্তীতে অবশ্য বাংলা সাহিত্যের পাতায় স্থান করে নেয় এই জায়গা। এখনও এখানে গেলে বুদ্ধদেব গুহ, অপর্ণা সেনের বাড়ি দেখানো হয়। যদিও সেই সব বাড়ি হাতবদল হয়ে গিয়েছে। অনুভবের ক্ষমতা থাকলে অরণ্যঘেরা পাহাড়ি শহরটির সর্বত্রই সৌন্দর্য চোখে পড়বে। এখান থেকে ঘুরে নেওয়া যায় ডুগাডুগি নদী, রেলস্টেশন, সর্বধর্মস্থল, সীতাকুণ্ড। একটি রাত এখানে কাটিয়ে পর দিন সকালে চলুন নেতারহাটের উদ্দেশে।
ম্যাকলুস্কীগঞ্জ থেকে নেতারহাট যাওয়ার সময় রাস্তার সৌন্দর্য মনোমুগ্ধকর। অরণ্যঘেরা প্রকৃতি। সঙ্গ দেবে পাখি-প্রজাপতি।পুজোর সময় পথে স্বাগত জানাবে কাশফুল। ১৩৪ কিলোমিটার অরণ্যপথ ঘণ্টা চারেকেই পেরিয়ে যাওয়া যায়। নেতারহাটকে ঘিরে রেখেছে অরণ্য এবং পাহাড়। যে দিন পৌঁছোলেন, সে দিন দুপুরে বিশ্রাম নিয়ে, খাওয়া-দাওয়া সেরে বেরিয়ে পড়ুন সূর্যাস্ত দেখতে। নেতারহাটে রয়েছে ম্যাগনোলিয়া সানসেট পয়েন্ট। এখান থেকে আকাশ রাঙিয়ে পাহাড়ে গায়ে সূর্য ডোবার ছবি আজীবন মনে গেঁথে থাকবে।
নেতারহাটে ম্যাগনোলিয়া ভিউপয়েন্ট। এখান থেকে দারুণ সূর্যাস্ত দেখা যায়। ছবি: সংগৃহীত।
নেতারহাটে অকৃত্রিম প্রকৃতি ভুলিয়ে দেবে ব্যস্ততা, শহুরে ক্লান্তি। সফর মানে তো নিজের সঙ্গযাপনও। প্রিয়জনের সঙ্গে একাত্ম হওয়া। সেই সব রসদ খুঁজে পাওয়া যায় এখানে। ভোরে উঠতে পারলে সাক্ষী থাকতে পারেন অপূর্ব সূর্যোদয়ের। এখান থেকে ঘুরে নিন ন্যাসপাতি গার্ডেন, লোয়ার এবং আপার ঘাগরি, কোয়েল ভিউ পয়েন্ট। তালিকায় জুড়ে নিন লোধ জলপ্রপাত। অরণ্যের মধ্যে সুউচ্চ জলপ্রপাতটির সৌন্দর্য দারুণ।
ঘুরে নিন লোধ জলপ্রপাত। ছবি: সংগৃহীত।
পঞ্চম দিন ভোরে রাঁচী হয়ে কলকাতা ফেরার সময় তাড়াহুড়ো না করে বরং চান্ডিল জলাধারটি ঘুরে নিতে পারেন। পাহাড় ঘেরা বিশাল জলাধারকে ছোট সমুদ্র বলে ভ্রম হতে পারে। এখানে রয়েছে স্পিড বোটে চাপার সুযোগ।
ফেরার সময় ঘুরে নিতে পারেন চান্ডিল ড্যাম। ছবি: সংগৃহীত।
কী ভাবে যাবেন?
কলকাতা থেকে রাঁচীর দূরত্ব ৪০২ কিলোমিটার। কোলাঘাট, খড়্গপুর, লোধাশুলি, বহড়াগোড়া, ঘাটশিলা, চান্ডিল হয়ে রাঁচী। রাঁচী থেকে ম্যাকলুস্কীগঞ্জ ৬০ কিলোমিটার। সেখান থেকে নেতারহাট আরও ১৩৪ কিলোমিটার।
কোথায় থাকবেন?
রাঁচি শহরে থাকার একাধিক জায়গা রয়েছে। ছোট, বড় বিভিন্ন মানের হোটেল, রিসর্ট আছে। ম্যাকলুস্কীগঞ্জেও থাকার হোটেল মেলে। ঝাড়খণ্ড পর্যটন দফতরের অতিথি নিবাসের পাশাপাশি বেসরকারি একাধিক হোটেল রয়েছে নেতারহাটেও।