এডিনবরা শহর।
এ দেশে তো দেখি মানুষের চেয়ে ভেড়ার সংখ্যা বেশি!
মাইলের পর মাইল সবুজ ঘাসের গালিচায় ঢাকা স্কটিশ হাইল্যান্ডের মধ্যে যেতে গিয়ে এই কথাটাই প্রথম মনে হল।
লন্ডনে অনেকেই বেড়াতে যান। লন্ডন সফরের সঙ্গে যদি আরও কয়েকটা দিন যোগ করে নিতে পারেন, তা হলে অবশ্যই স্কটল্যান্ড ঘুরে আসুন। দেখবেন, স্কুলের বইয়ে পড়া উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থের কবিতার লাইন চোখের সামনে ফুটে উঠছে। টিলার উপরে একাকী মহিলা, আপন মনে কাজ করে যাচ্ছেন। চারপাশে কেউ নেই। কোথাও আবার পথের ধারে মাথা নাড়ছে উজ্জ্বল সোনালি ড্যাফোডিল ফুল।
আরও পড়ুন: গল্পের বাঘ করবেটে টানে
বহু দিন ধরেই স্কটল্যান্ডের একটা বড় অংশ ‘স্বাধীনতা’র দাবি তুলছে। এই নিয়ে ২০১৪ সালে এখানে একটি গণভোট হয়। ৪৪.৭ শতাংশ ভোট পেয়ে হেরে যান স্বাধীনতাকামীরা। ফলে এখনও ব্রিটেনেরই অংশ স্কটল্যান্ড। তাই যেতে হলে লাগবে ব্রিটিশ ভিসা। দিল্লি বা মুম্বই থেকে স্কটল্যান্ডের রাজধানী এডিনবরার সরাসরি উড়ান রয়েছে। লন্ডন থেকে রয়েছে অনেক সস্তার উড়ানও। পৌঁছে যাওয়া যায় এক-দেড় ঘণ্টায়। হাতে সময় থাকলে অবশ্য ট্রেনে যাওয়াই ভাল। সারা দিন ধরে লন্ডনের কিংস ক্রস স্টেশন থেকে অসংখ্য ট্রেন রয়েছে।
রাজধানী এডিনবরা দিয়ে সফর শুরু করুন। আপনার কোনও আত্মীয়-বন্ধু যদি এ শহরে না থাকেন, তা হলে একটা টুর বাসে উঠে পড়ুন। ওয়েভারলি ব্রিজের সামনে থেকে ছাড়ে এই ধরনের বাসগুলি। এক দিনের টিকিটে যত বার, যত ক্ষণ খুশি ঘোরা যায়। এই সব বাস আপনাকে শহরের প্রতিটি দ্রষ্টব্যস্থানে নিয়ে যাবে। যেখানে খুশি নেমে যান, সেই জায়গাটা ঘুরে নিয়ে আবার পরের বাসে চড়ুন। সাধারণত কুড়ি মিনিট অন্তর পাওয়া যায় এই বাস। খেয়াল রাখবেন, টিকিটটা কোন সংস্থার। শুধু সেই কোম্পানির বাসেই কিন্তু চড়তে পারবেন।
আইল অব স্কাই।
এডিনবরা শহরটির দু’টি ভাগ। মধ্যযুগে বানানো ‘ওল্ড টাউন’ বা পুরনো শহর এবং ১৮-১৯ শতকে গড়ে ওঠা ‘নিউ টাউন’ বা নতুন শহর। অবশ্য-দ্রষ্টব্যের মধ্যে রয়েছে জাতীয় সংগ্রহশালা, এডিনবরা ক্যাসল এবং হলিরুড প্যালেস। এডিনবরা ক্যাসল ও হলিরুড প্রাসাদের মাঝখানের রাস্তাটি ঠিক এক মাইল লম্বা এবং ‘রয়্যাল মাইল’ নামে প্রসিদ্ধ। পাথরের ইট বাঁধানো রাস্তার দু’পাশে অসংখ্য দোকান আর কাফে। শপিং-প্রীতি না থাকলেও নরম উলের একটা মাফলার অন্তত কিনে নিন। যেমন আরামদায়ক, তেমনই ফ্যাশনেবল। শিল্পরসিক হলে চলে যান ন্যাশনাল গ্যালারিজ়ে। লিয়োনার্দো দা ভিঞ্চি, রাফায়েল, মোনে, দেগা— বহু খ্যাতনামা শিল্পীর কীর্তি সযত্নে রক্ষিত এখানে। এডিনবরা থেকে কয়েক ঘণ্টার জন্য ঘুরতে যেতে পারেন ৫০ মাইল দূরের সেন্ট অ্যান্ড্রুজ় বিশ্ববিদ্যালয়ে। ব্রিটেনের তৃতীয় প্রাচীনতম (অক্সফোর্ড ও কেমব্রিজের পরে) বিশ্ববিদ্যালয়টিতেই রাজকুমার উইলিয়ামের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল কেট মিডলটনের।
আরও পড়ুন: চাঁদের আলোয় কচ্ছের রণ দেখে এসে লিখলেন অভিনেত্রী সন্দীপ্তা
এডিনবরায় অবশ্যই দেখবেন স্কট মনুমেন্ট। ওয়েভারলি রেল স্টেশনের খুব কাছেই প্রিন্সেস স্ট্রিট গার্ডেনস। সেখানেই রয়েছে স্কটিশ ঔপন্যাসিক, ‘আইভ্যান হো’র লেখক ওয়াল্টার স্কটের স্মৃতিতে বানানো এই বিশাল সৌধটি। এটি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম স্মৃতিসৌধ (প্রথমটি রয়েছে কিউবার হাভানায়, লাতিন আমেরিকার কবি হোসে মার্তির স্মৃতিতে)। ১৮৩২ সালে স্কট মারা যাওয়ার পরেই এই সৌধ বানানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়। দু’শো ফুট ৬ ইঞ্চি উঁচু সৌধটির ২৮৮টি সিঁড়ি। বিভিন্ন উচ্চতায় রয়েছে নানা ‘ভিউইং প্ল্যাটফর্ম’, যেখান থেকে পুরো এডিনবরা শহরটিকে দেখা যায়। রাজা-রানি থেকে শুরু করে কবি-লেখক এবং স্কটের লেখা বিভিন্ন উপন্যাসের নানা চরিত্রের মোট ৯৬টি ছোট-বড় মূর্তি রয়েছে সৌধটিতে। তাদের মধ্যে রয়েছে স্কটের নিজের কুকুর-সহ তিনটি পশুর মূর্তিও!
স্কটল্যান্ডে এসে ‘লখ’ দেখতেই হবে। স্কটিশ ভাষায় ‘লখ’ মানে হ্রদ। পরিসংখ্যান বলে, ৩১,৪৬০টি হ্রদ রয়েছে স্কটল্যান্ডে। তাদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ‘লখ নেস’ এবং ‘লখ লমন্ড’। স্কটিশ উপকথায় ‘লখ নেস মনস্টার’-এর বাস এই নেস হ্রদে। সেই দৈত্যের খোঁজে এখনও লক্ষ লক্ষ পর্যটক ভিড় জমান হ্রদের ধারে। লখ নেসের মতোই বিখ্যাত এবং পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত প্রিয় লখ লমন্ড। টিনটিন কমিক্সে ক্যাপ্টেন হ্যাডকের প্রিয় হুইস্কির কোম্পানি এই হ্রদের নামেই। ব্রিটেনের সবচেয়ে বড় হ্রদ এটি। ৭১ স্কোয়্যার কিলোমিটার জুড়ে হ্রদের চারপাশে ঢেউ খেলানো টিলা, যার কেতাবি নাম স্কটিশ হাইল্যান্ডস।
ফোর্থ নদীর উপর ফোর্থ ব্রিজ, এডিনবরা।
হাতে আর একটু সময় থাকলে যেতে পারেন আর এক মনোরম জায়গা ‘আইল অব স্কাই’ বা স্কাই দ্বীপে। দ্বীপের পূর্ব প্রান্তে পিকচার পোস্টকার্ডের মতো সুন্দর পরর্টি গ্রামে। স্ট্যাফিন সৈকতে ডাইনোসরের পায়ের ছাপও থাকবে আপনার নট টু বি মিসড-এর তালিকায়। স্কাই-এর মতো আর একটি জনপ্রিয় দ্বীপ হ্যারিস। বিদেশি পর্যটক তো বটেই, স্কটল্যান্ডের মানুষও এই দ্বীপে এসে ক্যারাভানে কয়েকটা দিন কাটিয়ে যান। হাতে লম্বা ছুটি থাকলে গ্লাসগো এবং ইনভারনেস শহর দু’টিও ঘুরে আসবেন।
শহরের বাইরে যত্রতত্র ঘুরে বেড়ানোর জন্য আদর্শ জায়গা স্কটল্যান্ড। এখানকার মানুষ বিশ্বাস করেন, সবাইকে ফ্রিডম টু রোম বা অবাধে ঘুরে বেড়ানোর ছাড়পত্র দেওয়া উচিত। আপনি তাই সহজেই ঢুকে পড়তে পারেন কারও ফার্মে, কেউ আপনাকে কিচ্ছুটি জিজ্ঞেস করবে না! অবশ্য বাধা দেওয়ার জন্য কোনও লোকজনও দেখবেন না। বরং সেখানে চরে বেড়াচ্ছে অসংখ্য ভেড়া! কিছু গ্রামে মানুষের চেয়ে ভেড়ার সংখ্যা নাকি কয়েক গুণ বেশি।
সব শেষে বলি, স্কটল্যান্ডে শীতকালে ভীষণ ঠান্ডা পড়ে। বছরের অন্যান্য সময়ে স্কটল্যান্ডের আবহাওয়া মূলত তিন ধরনের— ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি, মাঝারি বৃষ্টি আর কপাল ভাল থাকলে ঝিরঝিরে বৃষ্টি। বেশির ভাগ সময়েই বৃষ্টির দোসর ঝোড়ো হাওয়া। ফলে ছাতা নয়, ব্যাগে অবশ্যই রাখবেন ওয়াটারপ্রুফ জ্যাকেট।
আরও পড়ুন: ময়নামতীর পথের ধারে
রসিকদের জন্য
সরকারি নিয়ম মেনে বিশেষ প্রক্রিয়ায় বানানো স্কটিশ হুইস্কি বা স্কচের কদর পৃথিবী জুড়ে। পর্যটক হিসেবে এখানকার বিভিন্ন ডিস্টিলারিতে যাওয়াও যায়। কী বিশাল কর্মকাণ্ড, তা কিঞ্চিত মালুম হয় এই সব ডিস্টিলারিতে গেলে। রসিকদের জন্য রয়েছে চেখে দেখার সুযোগও
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy