মুছাক আলিকে খুনের ঘটনায় ধৃতেরা। নিজস্ব চিত্র।
তৃণমূলের বুথ সভাপতিকে পিটিয়ে খুনের ঘটনায় চার জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। ঘটনায় সামনে এসেছে শাসক দলের দুই গোষ্ঠীর রেষারেষির তত্ত্বও। তৃণমূলের দুই গোষ্ঠীর বিবাদের জেরেই তাঁর ছেলেকে খুন হতে হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন মৃত মুছাক আলি মোল্লার বাবা নূর মহম্মদ মোল্লা। বারুইপুর পুলিশ জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পার্থ ঘোষ বলেন, “স্থানীয় দুই গোষ্ঠীর মধ্যে ঝামেলা মারামারির ঘটনায় এক জনের মৃত্যু হয়েছে। আমরা চার জনকে ইতিমধ্যেই গ্রেফতার করেছি। তাদেরকে পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হচ্ছে। এই ঘটনায় আরও কে বা কারা জড়িত সে বিষয়ে তদন্ত চলছে। এলাকায় অশান্তি রুখতে পুলিশ মোতায়েন রয়েছে।”
সোমবার সকালে গোসাবার রাধানগর তারানগর পঞ্চায়েতের ৮৪ নম্বর বুথের তৃণমূল সভাপতি মুছাক আলি মোল্লাকে পিটিয়ে খুনের অভিযোগ ওঠে। রাতেই মৃতের বাবা সুন্দরবন কোস্টাল থানায় ১৯ জনের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। তদন্তে নেমে সুন্দরবন কোস্টাল থানার পুলিশ সোমবার রাতেই চার জনকে গ্রেফতার করেছে। পুলিশ জানিয়েছে, ধৃতদের নাম ফারুক বৈদ্য, আনার জমাদার, ইমরান মোল্লা ও রউফ মোল্লা। ধৃতদের মঙ্গলবার আলিপুর আদালতে তোলা হয়। তাদের নিজেদের হেফাজতে নিয়ে তদন্ত এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে পুলিশ। যদিও এই ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত বাকিবুল মোল্লাকে পুলিশ এখনও গ্রেফতার করেনি বলে অভিযোগ। সূত্রের দাবি, ঘটনায় বাকিবুলও গুরুতর জখম হয়ে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
ক’দিন আগেই দক্ষিণ ২৪ পরগনার জয়নগরে খুন হন তৃণমূল নেতা সইফুদ্দিন লস্কর। সেই ঘটনায় তৃণমূল বিরোধী সিপিএমের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলেছে। তবে মুছাকের খুনের ঘটনার পিছনে যে গোসাবার বিধায়ক সুব্রত মণ্ডল ও জেলা পরিষদ সদস্য অনিমেষ মণ্ডলের গোষ্ঠীর দ্বন্দ্ব রয়েছে, তা মানছেন দলেরই অনেকে। মুছাকের বাবা নূর মহম্মদ সরাসরি অভিযোগ করছেন, “আমার ছেলে অনিমেষের সঙ্গে দল করত বলেই ওর উপর রাগ ছিল বিধায়কের অনুগামীদের। তাই চক্রান্ত করেই ওকে খুন করা হয়েছে। আমি দোষীদের শাস্তি চাই।”
কোন পথে এই দ্বন্দ্বের শুরু? তৃণমূল সূত্রে দাবি, ২০২১-এ গোসাবা বিধানসভায় জয়ী জয়ন্ত নস্করের মৃত্যুর পর থেকেই কোন্দল বড় আকার নেয়। উপনির্বাচনে জিতে সুব্রত বিধায়ক হতেই দলের মধ্যে কোন্দল বড় হতে থাকে। অনিমেষ ও সুব্রতর দু’টি গোষ্ঠী তৈরি হয়। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনেও দলের উচ্চ নেতৃত্বকে গোসাবা ব্লকের পঞ্চায়েতগুলিতে দুই গোষ্ঠীর মধ্যে আসন বণ্টন করতে মধ্যস্থতা করতে হয়। তার পরেও দু’পক্ষই একে অপরের বিরুদ্ধে নির্দল প্রার্থী দাঁড় করায়। পঞ্চায়েতের বোর্ড গঠনেও কোথাও কোথাও এ নিয়ে সমস্যা দেখা দেয়।
মুছাকের অনুগামীদের দাবি, স্থানীয় ৮৪ নম্বর বুথের সভাপতি আগে থেকেই ছিলেন মুছাক। কিন্তু বছরখানেক আগে বিধায়ক হিসেবে নিজের ক্ষমতায় সুব্রত বাকিবুলকে বুথ সভাপতি করে দেন। কিন্তু দলের উচ্চ নেতৃত্ব নির্দেশ দেন পুরনো সভাপতিরাই নিজেদের পদে বহাল থাকবেন। তাই মুছাক ফের বুথ সভাপতির পদ ফিরে পান। মূলত সেই ঘটনা থেকেই মুছাক ও বাকিবুলের মধ্যে রেষারেষি তৈরি হয়েছিল বলে তৃণমূলের অন্দরের খবর।
দু’পক্ষের এই রেষারেষির জেরেই কার্যত সোমবার সকালে গণ্ডগোল বাধে রাধানগর তারানগর গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায়। তৃণমূল সূত্রে দাবি, পথশ্রী প্রকল্পের যে রাস্তার কাজ নিয়ে গণ্ডগোল বাধে, সেই কাজ বিধায়কের অনুগামীরাই এলাকায় করছিলেন। কিন্তু রাস্তা তৈরিতে সরকারি নির্দেশিকা লঙ্ঘন করা হচ্ছে বলে অভিযোগ তোলেন মুছাক। সরকারি প্রকল্পের কাজ সঠিকভাবে বুঝে নেওয়ার জন্য নিজের কয়েকজন অনুগামী ও স্থানীয় কিছু বাসিন্দাকে সঙ্গে নিয়ে সোমবার সকালে প্রতিবাদ করেন তিনি।
তখনই দুপক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে বলে স্থানীয় সূত্রে খবর। দু’পক্ষই একে অপরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। অভিযোগ, সংঘর্ষের সময় বাকিবুল, রউফরা রড, বেলচা, বাঁশ নিয়ে মুছাককে বেধড়ক মারধর করে। ঘটনাস্থলেই গুরুতর জখম হয়ে লুটিয়ে পড়েন তিনি। স্থানীয়রা তাঁকে উদ্ধার করে প্রথমে স্থানীয় হাসপাতাল ও পরে কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথেই মৃত্যু হয় তাঁর। ক্যানিং থানার পুলিশ দেহ উদ্ধার করে মঙ্গলবার ময়নাতদন্তের জন্য পাঠিয়েছে।
গোসাবার বিধায়ক সুব্রত মণ্ডল অবশ্য দাবি করেছেন এই ঘটনার পিছনে কোনও রাজনীতি নেই। তিনি বলেন, “সরকারি রাস্তা খারাপ তৈরি হচ্ছিল বলে মুছাক প্রতিবাদ করলে তাঁকে ঠিকাদারের লোকেরাই মারধর করেছে। এই ঘটনায় কোনও রাজনীতি নেই। পুলিশকে বলেছি তদন্ত করে দোষীদের গ্রেফতার করতে।” যদিও অনিমেষ বলেন, “রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্যই মুছাককে পরিকল্পনা করে খুন করা হয়েছে। নিজেদের পিঠ বাঁচাতে এখন মিথ্যার আশ্রয়
নিচ্ছে অনেকেই।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy