পুরনো মোড়কে নতুন বিষয়। মোড়কের নাম ‘বাংলা এবং বাঙালি’। বিষয়: ভোটার তালিকায় বিশেষ নিবিড় সংশোধন (এসআইআর)।
বিজেপির মোকাবিলায় ২০২১ সালের বিধানসভা ভোট থেকেই ‘বাঙালি গরিমা’কে হাতিয়ার করেছে তৃণমূল। ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটেও তার অন্যথা হয়নি। ২০২৬ সালের বিধানসভা ভোটেও যে সেই রাজনৈতিক লাইনই নেবে বাংলার শাসকদল, মঙ্গলবার তা আবার স্পষ্ট হয়ে গেল। এসআইআর মোকাবিলাতেও সেই বাংলা এবং বাঙালিকে অসম্মান করার প্রসঙ্গই টেনে আনলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়।
এসআইআর নিয়ে দেশের মুখ্য নির্বাচন কমিশনার জ্ঞানেশ কুমার এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে এক বন্ধনীতে ফেলে আক্রমণ শানিয়েছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। বলেছেন, যে ভাবে বাংলাকে অসম্মান করতে ভোট পরবর্তী হিংসার কথা বলা হয়েছিল, সন্দেশখালি নিয়ে মিথ্যা রটানো হয়েছিল, যে ভাবে বাংলার মানুষকে ভাতে মারতে ১০০ দিনের কাজ-সহ বিভিন্ন কেন্দ্রীয় প্রকল্পের টাকা বন্ধ রেখেছে দিল্লি, সে ভাবেই বাংলার মানুষকে আতঙ্কিত, সন্ত্রস্ত এবং বিপন্ন করতে এসআইআর করা হচ্ছে।
পাশাপাশিই অভিষেক আবার দাবি করেছেন, যতই এসআইআর হোক, ২০২১ সালের তুলনায় একটি হলেও বিধানসভা ভোটে বেশি আসন পাবে তৃণমূল। মানচিত্র দেখিয়ে ‘তৃণমূলের সেনাপতি’ দাবি করেছেন, বাংলাদেশ এবং মায়ানমারের সঙ্গে ভারতের যে রাজ্যগুলির সীমানা রয়েছে, সেই ন’টি রাজ্যের মধ্যে একমাত্র পশ্চিমবঙ্গেই এসআইআর হচ্ছে। কমিশনের এ হেন পদক্ষেপের মধ্যে ‘অভিসন্ধি’ রয়েছে বলেই অভিযোগ তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের।
শাহ-জ্ঞানেশকে নিশানা
কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনকে ‘বিজেপির সহকারী সংস্থা’ বলে নিশানা করেছেন অভিষেক। আগামী বছরের প্রথমার্ধে পাঁচ রাজ্যে নির্বাচন হওয়ার কথা। সেই তালিকায় পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গেই রয়েছে অসম, তামিলনাড়ু, কেরল এবং পুদুচেরি। বাকি চারটি রাজ্যের জন্য এসআইআর হলেও অসমের জন্য তা ঘোষিত হয়নি। অভিষেকের দাবি, ওই রাজ্যগুলির মধ্যে অসমই একমাত্র বিজেপিশাসিত। সেই কারণেই কমিশন সেখানে এসআইআর করছে না। অসমে এনআরসি সংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তি না-হওয়ায় এসআইআর হচ্ছে না বলে যে ব্যাখ্যা কমিশন দিয়েছে, তাকে ‘দুর্বল যুক্তি’ বলে অভিহিত করেছেন অভিষেক।
ঘটনাচক্রে, সোমবার এসআইআর ঘোষিত হওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মঙ্গলবার উত্তর ২৪ পরগনার পানিহাটিতে প্রদীপ কর নামের ৫৭ বছর বয়সি এক ব্যক্তি আত্মঘাতী হন। সুইসাইড নোটে তিনি তাঁর মৃত্যুর জন্য এসআইআর এবং জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি)-কে দায়ী করেছেন। সেই প্রসঙ্গ তুলে অভিষেক বলেন, ‘‘আর কত রক্ত চান জ্ঞানেশ কুমার? কত রক্ত চান অমিত শাহ?’’ শাহ এবং জ্ঞানেশের বিরুদ্ধে এফআইআর হওয়া উচিত বলেও মনে করেন তিনি। সেই এফআইআর কি তৃণমূল করবে? অভিষেকের জবাব, এই ধরনের ঘটনায় দলগত ভাবে এফআইআর করা যায় না। তবে পরিবার এফআইআর করলে তৃণমূল সর্বতোভাবে পাশে থাকবে। জ্ঞানেশের উদ্দেশে অভিষেক আরও বলেন, ‘‘সরকার বদল হলে আপনি দেশ ছেড়ে পালাবেন না। যেখানেই যান খুঁড়ে বার করে আনব। মনে রাখবেন, সারাজীবন বিজেপি থাকবে না।’’
কোন জাদুকাঠি
২০০২ সালের এসআইআর-কে ‘সূচক’ হিসাবে ধরছে কমিশন। সেই সূত্রেই অভিষেকের প্রশ্ন, ‘‘২০০২ সালে এসআইআর হয়েছিল দু’বছর সময় নিয়ে। এখন কমিশনের কাছে কোন জাদুকাঠি রয়েছে যে, ৮০ হাজার বুথে, সাড়ে সাত কোটি মানুষের কাছে দু’মাসে পৌঁছে যাবে তারা?’’ তবে ২৩ বছর আগের পরিস্থিতির চেয়ে এখনকার পরিস্থিতি আলাদা। প্রযুক্তিগত উন্নতি মানুষের জীবন আমূল পাল্টে দিয়েছে। অভিষেক তারও উল্লেখ করে বলেন, ‘‘কমিশন প্রযুক্তির মাধ্যমে সব করলে তো তার আগে ভোটার তালিকা ডিজিটাল করে রাজনৈতিক দলগুলিকে দেওয়া উচিত। সেটা করছে না কেন?’’ তৃণমূল সাংসদের অভিযোগ, ‘‘এত দিন পর্যন্ত দেশের মানুষ তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে সরকার নির্বাচন করতেন। এখন বিজেপির সরকার নির্বাচন কমিশনকে ব্যবহার করে পছন্দ মতো ভোটার চিহ্নিত করছে।’’ ৪ নভেম্বর থেকে এসআইআর-এর মূল প্রক্রিয়া শুরু হবে। বিএলও-রা যাবেন বাড়ি বাড়ি। চলবে ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত। অভিষেকের বক্তব্য, এর মধ্যে উৎসব আছে, ছুটির দিন আছে। সব মিলিয়ে মেরেকেটে ২০ দিন পাওয়া যাবে। এই ২০ দিনে কি ৮০ হাজার বুথে সাড়ে সাত কোটি ভোটারকে ছুঁতে পারবে কমিশন? প্রশাসন সেই কাজে সাহায্য করবে কি না, সেই প্রশ্নে অভিষেকের জবাব, ‘‘কমিশনের এত তাড়া কেন?’’
রাজনৈতিক মহলের অনেকেরই আশঙ্কা, এসআইআর হলে সীমান্তবর্তী অনেক এলাকা এবং সংখ্যালঘু অধ্যুষিত অঞ্চলে অস্থিরতা তৈরি হতে পারে। অভিষেকের বক্তব্য, ‘‘শান্তিপ্রিয় মানুষ হিসাবে চাই না কোথাও অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হোক। কিন্তু হলে তার দায় নির্বাচন কমিশনকে নিতে হবে। কারণ, প্রশাসন এখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অধীন নয়।’’
প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ
এসআইআর ঘোষণা হওয়া মাত্র সোমবার বিকালের পর থেকে প্রশাসনের বড় অংশের নিয়ন্ত্রণ কমিশনের হাতে। ঘটনাচক্রে, কমিশনের ওই ঘোষণার কয়েক ঘণ্টা আগেই রাজ্যের বিভিন্ন জেলা, মহকুমা এবং ব্লকের প্রশাসন ও পুলিশে প্রায় সাড়ে ৫০০ জনকে বদলি করেছে নবান্ন। এসআইআর প্রক্রিয়া চলবে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। তত দিন পর্যন্ত এই ‘নিয়ন্ত্রণ’ থাকবে কমিশনের। তার পরেই ভোট। নির্ঘণ্ট ঘোষণা হলেই ফের কমিশনের অধীনে চলে যাবে প্রশাসন। দীর্ঘ সময় নবান্ন চাইলেও কিছু করতে পারবে না। এতে কি তৃণমূল উদ্বিগ্ন? অভিষেক উদ্বেগের কথা না বললেও খানিকটা স্বগতোক্তির মতোই বলেছেন, ‘‘এ হল কৌশলে প্রশাসনকে নিজের হাতে নিয়ে নেওয়া। সরকার কাজটা করবে কখন?’’
অভিষেক না-বললেও তৃণমূলের প্রথম সারির অনেক নেতা একান্ত আলোচনায় বলছেন, স্থানীয় স্তরের প্রতিষ্ঠান বিরোধিতায় প্রলেপ দিতে রাজ্য সরকার বুথভিত্তিক টাকা খরচের প্রকল্প নিয়েছিল। যার পোশাকি নাম ‘আমাদের পাড়া, আমাদের সমাধান’। পাড়ায় পাড়ায় শিবির করে কাজের পরিকল্পনা হয়ে গিয়েছে। এ বার তা বাস্তবায়িত হওয়ার কথা। এসআইআরে গোটা প্রশাসন ব্যস্ত হয়ে গেলে সেই কাজ কী ভাবে হবে, তা নিয়ে অনেকেই সংশয়ী। আবার একাংশের বক্তব্য, এই রদবদল অনিবার্যই ছিল। কারণ, কমিশনকে এসআআইআরের কাজ নিয়ে বিড়ম্বনার মধ্যে ফেলা গিয়েছে।
আরও পড়ুন:
বদলি বিতর্কে পাল্টা
কমিশন এসআইআর ঘোষণার অব্যবহিত আগেই প্রশাসনে ঢালাও রদবদলকে ‘বেআইনি’ বলে দাবি করেছে বিজেপি। কমিশন যদিও এ নিয়ে কোনও নেতিবাচক মন্তব্য করেনি। তবে অভিষেক মঙ্গলবার বলেছেন, ‘‘গত ২৪ জুন এসআইআর সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি জারি করেছিল কমিশন। তার পর ২৮ জুন জ্ঞানেশ কুমারের কন্যা মেঘা রূপমকে বদলি করে নয়ডার জেলাশাসক করা হয়েছে। ২৫ জুন জ্ঞানেশের জামাতা মণীশ বনশলকে সাহারানপুরের জেলাশাসক করা হয়েছে। সেগুলি কি বেআইনি?’’
তবে সার্বিক ভাবে সংগঠনকে এসআইআর পর্বে ‘মাঠে’ থাকার বার্তা দিয়েছেন অভিষেক। সেই সঙ্গে আবার জানিয়ে দিয়েছেন, ১০০ দিনের কাজের বকেয়া নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায় কেন্দ্র কার্যকর না-করলে, অর্থ না-দিলে আদালত অবমাননার মামলা তো হবেই। বাংলাকে ভাতে মারার চক্রান্তের বিরুদ্ধে আবার তৃণমূলের দিল্লি অভিযানও হবে।
বিধানসভা ভোট আসছে। হাতিয়ার সেই ‘বাংলা এবং বাঙালি’।