Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
Rice

Farming: জোড়া ক্ষতি, হতাশায় চাষি

যে ধান রক্ষা পেয়েছে, তার মানও বিশেষ ভাল নয় বলে চাষিদের একাংশের দাবি।

রায়নার বহু গ্রামে এখনও ধান জমিতে জমে রয়েছে জল, ব্যস্ত চাষি। ছবি: উদিত সিংহ

রায়নার বহু গ্রামে এখনও ধান জমিতে জমে রয়েছে জল, ব্যস্ত চাষি। ছবি: উদিত সিংহ

সৌমেন দত্ত
রায়না শেষ আপডেট: ২০ ডিসেম্বর ২০২১ ০৯:৪৮
Share: Save:

নিম্নচাপের পরে দু’সপ্তাহ কেটে গেলেও জমিতে পড়ে থাকা ভিজে ধানগাছ এখনও শুকোনোর জন্য ফেলে রাখা আছে। তা থেকে কত ধান পাওয়া যাবে, তার মান কেমন হবে, তা নিয়ে সংশয়ে পূর্ব বর্ধমানের রায়নার বহু চাষিই। নষ্ট হয়েছে আলু চাষও। এই পরিস্থিতিতে ক্ষতির ধাক্কা কী ভাবে তাঁরা সামলাবেন— ভেবে পাচ্ছেন না রায়নার বিভিন্ন গ্রামের চাষি।

তবে রাজ্যের মুখ্য কৃষি উপদেষ্টা প্রদীপ মজুমদার বলেন, ‘‘শস্যবিমার প্রিমিয়াম বাবদ রাজ্য সরকার ৮০০ কোটি টাকা দেয়। মোট চাষির ৮০ শতাংশ শস্যবিমায় নাম লিখিয়েছেন। বাকিরাও বিমা করে নিলে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা পাবেন।’’

শুক্রবার রাত থেকে কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে রায়না ১ ব্লকের হিজলনা পঞ্চায়েতের বনতির গ্রামের গণেশচন্দ্র ঘোষ ও নতু পঞ্চায়েতের দেবীবরপুর গ্রামের জয়দেব ঘোষ নামে দুই চাষির অপমৃত্যুর পরে তাঁদের পরিবার দাবি করেছে, চাষের ক্ষতির কারণেই অবসাদে তাঁরা আত্মঘাতী হয়েছেন। রবিবার রায়না ১ ব্লকের বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে চাষিদের মধ্যে হা-হুতাশই দেখা গিয়েছে। স্থানীয় ভাবে ঋণ নিয়ে চাষ করার পরে এ বার কী ভাবে ধার শোধ করবেন, অনেকেই তা নিয়ে দুর্ভাবনায়।

কৃষি দফতর ও ব্লক প্রশাসনের দাবি, রায়না ১ ব্লকে ২১,৩০০ হেক্টর জমিতে ধান চাষ হয়েছিল। যার বেশির ভাগটাই ছিল গোবিন্দভোগ চাষ। নিম্নচাপের আগে বাদামি শোষক পোকার হানায় ধান গাছের ক্ষতি হয়। অতিবৃষ্টিতে জমি ডুবে যাওয়ায় ৭০ শতাংশ জমির ধানই নষ্টের মুখে। ওই ব্লকে ১,৮০০ হেক্টর জমিতে আলু লাগানো হয়েছিল। প্রায় সব আলুই পচে গিয়েছে।

যে ধান রক্ষা পেয়েছে, তার মানও বিশেষ ভাল নয় বলে চাষিদের একাংশের দাবি। চাষিরা জানান, সাধারণত গোবিন্দভোগ চাষ করে প্রতি বিঘায় আট-দশ বস্তা (৬০ কেজি) ধান পাওয়া যায়। বাদামি শোষক পোকা ও অতিবৃ্ষ্টির জেরে বিঘায় দু’বস্তা করে ধান কম ধান মিলছে। বিঘা প্রতি লাল স্বর্ণ পাওয়া যায় প্রায় ১৬ বস্তা। এ বার সেটা মিলবে আট-দশ বস্তা। চাষিদের আরও দাবি, প্রতি বস্তায় ধান ভাঙানোর পরে যে অনুপাতে চাল মেলে, এ বার তার থেকে অনেক কম চাল পাওয়া যাচ্ছে। ফলে ধানের দামও তুলনামূলক ভাবে কম।

কৃষি দফতর সূত্রে খবর, এই ব্লকে ভাগচাষির তুলনায় নিজেদের জমিতে চাষ করা কৃষকের সংখ্যা বেশি। তবে প্রান্তিক চাষিরা জানাচ্ছেন, তাঁদের অনেকেরই পৈতৃক সম্পত্তি নিজেদের নামে নেই। সে কারণে তাঁরা সরকারি সুবিধা পাচ্ছেন না। আবার শরিকি সমস্যার জন্য জমি ভাগ না হওয়ায় অনেকের নাম সরকারি প্রকল্পের খাতায় উঠছে না।

অভিযোগ, এই সব চাষিদের একটা বড় অংশ কার্যত ‘বাঁধা’ থাকেন স্থানীয় সার ব্যবসায়ী, আড়তদারদের কাছে। তাঁদের কাছে ধার নিয়ে ওই চাষিরা চাষ করেন। তার বদলে তাঁদের উৎপাদিত ফসল ওই সব ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করতে ‘বাধ্য’ হন চাষিরা। অভিযোগ, বাজারের থেকে অনেক কম দামেই সেই ফসল বিক্রি করতে হয়। যদিও ব্যবসায়ীদের অনেকে তা মানতে নারাজ।

বনতিরের পাশে জ্যোৎসাদি গ্রামের জামাল শেখের দাবি, “গত বছর ২০ বিঘা জমি নিয়ে খাস ধান (সুগন্ধি) চাষ করেছিলাম। লাভের মুখ দেখায় এ বছর ব্যবসাদার, মহাজনের কাছ থেকে পাঁচ লাখ টাকা ধার করে চাষ করেছিলাম। সব ধানই জলের তলায় চলে গিয়েছে। নিজের জমি না থাকায় সরকারের সুবিধাও পাব না।” ওই এলাকার কামাল মোল্লা, শুকুর শেখও বলেন, ‘‘ধার শোধ করার জন্যে ‘চাপ’ আসতে শুরু করেছে। সেই গয়না বন্ধক দিতে হবে। অন্যের কাছে আবার ধার করতে হবে।’’ স্থানীয় হিজলনা পঞ্চায়েতের উপ-প্রধান তৃণমূলের আজিজুল হকের দাবি, “কী হবে, এই আশঙ্কায় প্রতিদিন অনেক চাষি আমাদের কাছে আসছেন। আমরা তাঁদের বলেছি, সরকার পাশে আছে।’’

চিন্তা যাচ্ছে না বাঁধগাছা গ্রামের বিশ্বরূপ মণ্ডলের। তাঁর দাবি, “সোনা বন্ধক রেখেই ১৪ বিঘা জমিতে আলু চাষ করেছিলাম। সব বীজ পচে গিয়েছে। ফের ধার-দেনা করে চাষ শুরু করেছি।’’ এলাকার আর এক চাষি সৌমেন ঘোষ জানান, ঋণ করে চাষ করেছেন। তবে তাঁরা কিছু দিন আগে শস্যবিমার জন্য নাম লিখিয়েছেন।

ব্যাঙ্ক থেকে কৃষিঋণ নিয়েও স্বস্তিতে নেই বলে অনেকে জানাচ্ছেন। মাছখাণ্ডা গ্রামের চাষি শেখ ফকির মহম্মদ দাবি, “সাত বিঘা জমি চাষের জন্য ব্যাঙ্ক থেকে ৯০ হাজার টাকা কৃষি ঋণ নিয়েছিলাম। যা ক্ষতি হল, ধান-আলু একটুও পাব না। ব্যাঙ্ক ছ’মাসের মধ্যে শোধ করতে বলেছে। কী ভাবে করব? নতুন করে চাষের জন্য ভাগচাষিও আর মিলবে না।’’ তিনি জানান, পাশের গ্রামের এক ভাগচাষি ২০ বিঘা জমিতে চাষ করেছিলেন। চাষের ক্ষতি দেখে বিষ খেয়েছিলেন। কপালের জোরে বেঁচে গিয়েছেন। আর এক চাষি শেখ আব্দুল গনির দাবি, “আলু, সর্ষে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। ধান তুলতে পারছি না। ঋণ শোধ করতে পারব না।’’

এলাকার এক কৃষি সমবায়ের কর্তা অর্জুন ধাড়ার দাবি, “যা পরিস্থিতি, তাতে চাষিরা ঋণ শোধ করতে পারবেন না।’’ সার-কীটনাশক ব্যবসায়ী নয়ন মির্জারও দাবি, “ধার শোধ করতে চাষিদের কিছুটা সময়
দিতেই হবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Rice Potato Farmers
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE