Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪
State News

ফুল ফুটুক না ফুটুক, কাল মধুমাস

নাগরিক কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে কলম ধরলেন এ কালের আর এক কবি বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ঘরের জানলার পাশে বসে প্রায় ‘গণশত্রু’ বনে যাওয়া সুভাষ মুখোপাধ্যায় তবু জীবনের অভিজ্ঞতার আগুনে তাঁর সিদ্ধান্তের যে পরিমার্জন জরুরি ছিল, সেখান থেকে পিছিয়ে আসেননি এক পা-ও।

কেবল কৃষ্ণচূড়ার উদ্ভাস নয়, নিষ্পত্র গাছের বেঁচে থাকার লড়াইও সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতার কেন্দ্রে থেকেছে। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভের সৌজন্যে।

কেবল কৃষ্ণচূড়ার উদ্ভাস নয়, নিষ্পত্র গাছের বেঁচে থাকার লড়াইও সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতার কেন্দ্রে থেকেছে। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভের সৌজন্যে।

শেষ আপডেট: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ১৮:১২
Share: Save:

সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের জন্মশতবর্ষ পূর্ণ হল আজ। বাংলার ‘তরুণতম কবি’ কি তবে বৃদ্ধ হলেন? আর পাঁচ জনের ক্ষেত্রে যেমন হয়, কবি সুভাষের ক্ষেত্রেও কি ‘যৌবনের ফটো’ যৌবন পেরিয়ে যাওয়া জীবনকে বলছে, দূর হটো?

আরে ছো! পুরনো সোনা যেমন চিরনতুন থেকে যায় শতাব্দী পেরিয়েও, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতাও তেমনই নিজের বর্ণে-গন্ধে-শরীরে-আত্মায় পাঠকের মনের সেই স্থান দখল করে আছে, যার কোনও লয় নেই, ক্ষয় নেই, মাঝেমাঝে শুধু দৃশ্যের মৃত্যুর ভিতর দিয়ে নতুন দৃশ্যের জন্ম।

সেই দৃশ্যের পুরোভাগে কোনও রূপের তিলক বা বিত্তের বিস্ফোরণ নেই, আছে অগণিত ‘খেটে খাওয়া’ মানুষের ঘাম থেকে ঝরে পড়া সততা, রক্তের ভিতরে জেগে থাকা, অধিকার। সেই সব মানুষ, যাদের কথা আমরা ভুলে যাই, যে-কোনও তাত্ত্বিক আলোচনার সময়। যখন আমরা বলি যে গোটা দেশটাই ঘুষের উপর চলছে, তখন আমাদের মনে থাকে না যে জ্যৈষ্ঠের দুপুরে যে রিকশাচালক ওই অসহ্য গরমে এক মাইল প্যাডেল করে, সওয়ারির থেকে পঞ্চাশ টাকার নোট পেয়ে, কুড়ি টাকা ফেরত দিলেন, তিনিও আমার দেশেরই মানুষ। বসন্তের উচ্ছ্বাসে ‘খেলব হোলি, রং দেব না’ গাওয়ার সময় আমাদের মনেও পড়ে না যে এই দেশের অনেক মানুষের কাছে বসন্ত আত্মহত্যার ঋতু। না, তারা কেউ প্রেমে পড়ে আত্মহত্যা করে না। করে, স্রেফ না খেতে পেয়ে। কারণ ছোটনাগপুর মালভূমির বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে যারা পাতা কুড়িয়ে জীবিকা নির্বাহ করে বসন্তের সময়টা একদম দিশাহীন হয়ে যায় তারা। কারণ, তখন পুরনো পাতা ঝরে পড়েছে আর নতুন পাতা জন্ম নেয়নি। তা হলে কী বা কুড়োবে তারা, কী বিক্রি করবে ? আর দুটোর কোনওটাই না করতে পারলে, খাবে কী?

আরও পড়ুন: ‘আমাকে কেউ কবি বলুক, আমি চাই না’

মহাকালের বাংলা কবিতায় সুভাষ মুখোপাধ্যায় হাতে কলম, মাথায় ঝুড়ি আর পিঠে কাস্তে নিয়ে উঠে পড়েছেন। অলঙ্করণ: তিয়াসা দাস।

যে নাজিম হিকমতের অসংখ্য কবিতা সুভাষ অনুবাদ করেছেন, সুভাষ নিজেও তাঁর মতোই বিশ্বাস করতেন যে, ‘কবিরা...আকাশ থেকে পড়েননি যে তাঁরা মেঘের রাজ্যে পাখা মেলবার স্বপ্ন দেখবেন; কবিরা হলেন সমাজের একজন-জীবনের সঙ্গে যুক্ত, জীবনের সংগঠক।’

সেই জীবনের কথা, কেবল কৃষ্ণচূড়ার উদ্ভাস নয়, নিষ্পত্র গাছের বেঁচে থাকার লড়াইও সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতার কেন্দ্রে থেকেছে, তাঁর কবিজীবনের প্রথম দিন থেকে। “আমাকে উজ্জীবিত করে সমুদ্রের একটি স্বপ্ন/ মিছিলের একটি মুখ।/অন্য সব মুখ যখন দুর্মূল্য প্রসাধনের প্রতিযোগিতায়/কুৎসিত বিকৃতিকে চাপার চেষ্টা করে,/...তখন অপ্রতিদ্বন্দ্বী সেই মুখ/নিষ্কোষিত তরবারির মতো/জেগে উঠে আমাকে জাগায়।/অন্ধকারে হাতে হাতে তাই গুঁজে দিই আমি/নিষিদ্ধ এক ইস্তাহার/জরাজীর্ণ ইমারতের ভিৎ ধ্বসিয়ে দিতে/ডাক দিই-/যাতে উদ্বেলিত মিছিলে একটি মুখ দেহ পায়/আর সমস্ত পৃথিবীর শৃঙ্খলমুক্ত ভালবাসা/ দুটি হৃদয়ের সেতুপথে/ পারাপার করতে পারে।।” (মিছিলের মুখঃ অগ্নিকোণ)

সেই মিছিল থেকেই এক দিন ব্রাত্য হতে হয়েছিল সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে। ঘরের জানলার পাশে বসে প্রায় ‘গণশত্রু’ বনে যাওয়া সুভাষ মুখোপাধ্যায় তবু জীবনের অভিজ্ঞতার আগুনে তাঁর সিদ্ধান্তের যে পরিমার্জন জরুরি ছিল, সেখান থেকে পিছিয়ে আসেননি এক পা-ও। কারণ, সুভাষ জানতেন, গ্যালিলিওকে বন্দি করে রাখলেও যেমন পৃথিবীই সূর্যের চারদিকে ঘোরে, সূর্য পৃথিবীর চারদিকে নয়, তেমনই কবিকে ‘একঘরে’ করে রাখলেও কবিতা ঠিক পৌঁছে যায় ঘর থেকে ঘরে। নদীতে বাঁধ দিয়ে জলস্রোত অন্য দিকে বওয়ানো যেতেও পারে কিন্তু জলকে বরফ করে ফেলা যায় না। জেলের ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে যে সুভাষ এক দিন কলম তুলে নিয়েছিলেন, যে সুভাষ আদর্শগত কারণে নেহরু থেকে নেতাজি সুভাষচন্দ্রকেও তীব্র-তীক্ষ্ণ সমালোচনা করেছেন নিজের কবিতায়, লেনিনকে টেনে এনেছেন আটপৌরে জীবনে, সেই সুভাষই ধর্মতলায় পুলিশের গুলিতে বারো জন মারা যাওয়ার পর গর্জে উঠেছিলেন, ‘রক্ত রাস্তা রক্ত; গুনতে গুনতে সেই বারোতে থেমে যাই’...

আরও পড়ুন: আমি যত দূরেই যাই

আসলে কবির কলম সব দলগত রাজনীতির উপরে উঠে কথা বলে। মানুষের কথা বলে। কবি সুভাষ মেট্রো স্টেশন কলকাতার সেই অল্প কয়েকটি স্টেশনের একটা, যেখান থেকে ঝুড়ি মাথায় নিয়েও কামরাতে ওঠে লোক। মহাকালের বাংলা কবিতায় সুভাষ মুখোপাধ্যায় হাতে কলম, মাথায় ঝুড়ি আর পিঠে কাস্তে নিয়ে উঠে পড়েছেন। আরও একশো বছর পেরিয়ে গেলেও তাঁকে কেউ নামাতে পারবে না। কারণ সবার উপর মানুষ সত্য। আর মানুষের মধ্যে কবি।

(বাংলার রাজনীতি, বাংলার শিক্ষা, বাংলার অর্থনীতি, বাংলার সংস্কৃতি, বাংলার স্বাস্থ্য, বাংলার আবহাওয়া -পশ্চিমবঙ্গের সব টাটকা খবরআমাদের রাজ্য বিভাগে।)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE