Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

জমাট ‘ডিফেন্সে’ শিলিগুড়ি দখল, স্বপ্ন দেখছেন বামেরা

শিলিগুড়ির রং আবার লাল! মেয়র পদে ভোটাভুটির পর্ব শেষ হতেই ঘটনাস্থল থেকে টুইট এক সিপিএম সাংসদের। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই যাবতীয় সোশ্যাল সাইটে ‘লাল সেলাম’ ঝরে পড়া শুরু হল অশোক ভট্টাচার্যের উদ্দেশে। বিধানসভা থেকে সূর্যকান্ত মিশ্র, আলিমুদ্দিন থেকে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, বিমান বসুদের তরফে অভিনন্দন এবং স্বস্তিসূচক বার্তা গেল উত্তরবঙ্গের দিকে। সেই সঙ্গেই শুরু হল প্রতীক্ষা। দু’দিন পরে যে আলিমুদ্দিনে পা দেবেন শিলিগুড়ির নতুন মেয়র!

মেয়র হিসেবে শপথগ্রহণের পরে অশোক ভট্টাচার্যকে অভিনন্দন জানাচ্ছেন মেয়র পদে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী নান্টু পাল। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক।

মেয়র হিসেবে শপথগ্রহণের পরে অশোক ভট্টাচার্যকে অভিনন্দন জানাচ্ছেন মেয়র পদে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী নান্টু পাল। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক।

কিশোর সাহা
শিলিগুড়ি শেষ আপডেট: ১৯ মে ২০১৫ ০৪:২১
Share: Save:

শিলিগুড়ির রং আবার লাল!
মেয়র পদে ভোটাভুটির পর্ব শেষ হতেই ঘটনাস্থল থেকে টুইট এক সিপিএম সাংসদের। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই যাবতীয় সোশ্যাল সাইটে ‘লাল সেলাম’ ঝরে পড়া শুরু হল অশোক ভট্টাচার্যের উদ্দেশে। বিধানসভা থেকে সূর্যকান্ত মিশ্র, আলিমুদ্দিন থেকে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, বিমান বসুদের তরফে অভিনন্দন এবং স্বস্তিসূচক বার্তা গেল উত্তরবঙ্গের দিকে। সেই সঙ্গেই শুরু হল প্রতীক্ষা। দু’দিন পরে যে আলিমুদ্দিনে পা দেবেন শিলিগুড়ির নতুন মেয়র!
প্রকৃতপক্ষে, গত চার বছরে এ রাজ্যে বামেদের জন্য বিজয় সংবাদ প্রায় বিরল হয়ে দাঁড়িয়েছে! সেই আকালে নিজে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে শিলিগুড়িতে জয় এনে দিয়েছেন প্রাক্তন পুরমন্ত্রী অশোকবাবু। ভোটের দিন বাম, কংগ্রেস ও বিজেপি— সব বিরোধী দলের সমর্থকদের এককাট্টা করে ভোটারদের বুথে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। তার পরেও স্বস্তি ছিল না! তৃণমূল পাছে কাউন্সিলর ভাঙিয়ে বোর্ড গড়ার চেষ্টা করে, তার জন্য সর্বক্ষণ সতর্ক থাকতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত দক্ষ অধিনায়কের মতোই নিজের টিম ধরে রেখে জয় হাসিল করেছেন সিপিএমের এই ক্রিকেটভক্ত নেতা। আনুষ্ঠানিক ভাবে সোমবার তৃণমূলের মেয়র পদের দাবিদার নান্টু পালকে ২৪-১৬ ভোটে হারিয়ে দিয়েছেন অশোকবাবু। চেয়ারম্যান হয়েছেন সিপিএমের দিলীপ সিংহ। তিনি জিতেছেন ২৪-১৭ ভোটে।

বামেদের কেউ কেউ বলছেন, আসলে গোল পাকিয়েছিল সংখ্যাগরিষ্ঠতা থেকে এক আসন কম পাওয়া। ২৪ হলে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ হিসেবে পুরসভা দখল করতেন অশোকবাবুরা। তাঁরা কথা শুরু করেন নির্দল কাউন্সিলর (প্রাক্তন তৃণমূল নেতা) অরবিন্দ ঘোষ ওরফে অমুবাবুর সঙ্গে। তখনই তৃণমূলের জেলা নেতৃত্ব সক্রিয় হয়ে ওঠেন বলে অভিযোগ। শুধু অমুবাবুই নন, তৃণমূল শিবির কংগ্রেস-বিজেপির সঙ্গেও যোগাযোগ করে বলে অভিযোগ। যদিও এমন ঘটনার কথা বরাবর উড়িয়ে দিয়েছেন উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব।

এই সময় ভূমিকম্প পরিস্থিতি দেখতে শিলিগুড়িতে পৌঁছন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর সফরের সময় দলের প্রায় সব কাউন্সিলরকে নিয়ে পাহাড়ে চলে যান অশোকবাবু। মুখ্যমন্ত্রী ফেরার পরে আবার সরব হন তৃণমূল নেতা নান্টু পাল। তাঁরা যে লড়াইয়ে রয়েছেন, সেটা জোর গলায় বারবার জানিয়ে দেন তিনি। দল ভাঙানোর আশঙ্কা তাই ছেয়েই ছিল বরাবর, বলছেন বাম কাউন্সিলরেরা।

ক্রিজ কামড়ে পড়ে থেকে পড়ে থেকে এই কঠিন ইনিংসটা অশোকবাবু দক্ষ অধিনায়কের মতোই খেলেছেন, মানছেন এলাকার রাজনীতিকরা। এ দিন সেই লড়াইয়ের ফলই বেরিয়ে এল দুই পদ জয়ের মধ্য দিয়ে। কংগ্রেসের চার ও বিজেপির দু’জন কাউন্সিলর এ দিন মেয়র ও চেয়ারম্যান পদের ভোটাভুটিতে যোগ দেননি। উপরন্তু, তৃণমূলের ১৭ জন কাউন্সিলর থাকলেও মেয়র পদের ভোটাভুটিতে তাদের দলের প্রার্থী পেয়েছেন ১৬টি ভোট। একটি বাতিল হয়েছে। কার ভোট, কেন বাতিল হয়েছে, তা নিয়ে তৃণমূলের অন্দরে বিতর্ক এখন তুঙ্গে। যদিও উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী তথা দার্জিলিং জেলা তৃণমূল সভাপতি গৌতম দেব বলেছেন, ‘‘দলের এক কাউন্সিলর মেয়র পদে ভোট দেওয়ার সময়ে ভুল করে ফেলেছেন। এটা ভুলই। পরে চেয়ারম্যান পদের ভোটের সময় তিনি তা শুধরে নিয়েছেন।’’

আর মেয়র হওয়ার পরে সফল অধিনায়কের মন্তব্য, ‘‘ভোটের পরে শহরে ঘোড়া কেনাবেচার রাজনীতি আমদানির চেষ্টা হয়েছিল। সে জন্য নানা সতর্কতা ও কাউন্সিলরদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে হয়েছিল। তাতে দলমত নির্বিশেষে অনেকের সহযোগিতা পেয়েছি। আগামী দিনেও সুস্থ রাজনীতিতে বিশ্বাসী সব দলকে পাশে নিয়েই চলার চেষ্টা করব।’’

রাজ্যে ক্ষয়িষ্ণু বামেরা শিলিগুড়ির এই জয়কেই ঘুরে দাঁড়ানোর ইনিংস হিসেবে নিতে চাইছেন এখন। সিপিএমের সচরাচর মেনে চলা প্রথা ভেঙে অশোকবাবুকে মেয়র পদপ্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র। তৃণমূলের নানা কৌশল, পর্যাপ্ত সংখ্যা না থাকা সত্ত্বেও মেয়র পদে তাদের প্রার্থী দেওয়া— এ সব পেরিয়েই অশোকবাবুর জয় যে দলকে বাড়তি স্বস্তি দিয়েছে, সেটা তাঁর কথাতেই স্পষ্ট এ দিন। তিনি বলেন, ‘‘তৃণমূল যে দাবি করছিল শিলিগুড়ির রায় নাকি বাম-বিরোধী, আজ আশা করি তাদের ভুল ভেঙে গিয়েছে!’’

শিলিগুড়ি-মডেলের সাফল্যের পরে স্বাভাবিক ভাবে দলে গুরুত্ব বাড়ছে অশোকবাবুরও। তার ইঙ্গিতও মিলতে শুরু করেছে এ দিন থেকে। শিলিগুড়ির ‘রতনদা’ চেয়েছিলেন, মেয়র ও চেয়ারম্যান পদের নির্বাচনে ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁদের পাশে থাকুন। অশোকবাবুর সেই ইচ্ছে মেনে নিয়ে টিকিট জোগাড় করে রবিবার রাতে তরুণ সাংসদকে ট্রেনে চাপানোর ব্যবস্থা করে দেন বুদ্ধবাবু-সূর্যবাবুরা। সোমবার মেয়র নির্বাচনের সময় ঋতব্রত ছিলেন অশোকবাবুদের সঙ্গে।

বামেদের দাবি, প্রথমে শিলিগুড়িতে পুরভোটে সাফল্য এবং তার পরে স্নায়ুযুদ্ধে জিতে বোর্ড গঠন বিধানসভা ভোটের আগে গোটা বাম শিবিরকেই নতুন উদ্যমে লড়াইয়ের রসদ দেবে। বিশেষ করে বিনা লড়াইয়ে জমি না ছাড়ার অদম্য মনোভাব। অদূর ভবিষ্যতে অশোকবাবুর দৃষ্টান্তকে সামনে রাখার জন্যই এ বার দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীতে শিলিগুড়ির সদ্যনির্বাচিত মেয়রকে জায়গা দিতে চাইছেন বুদ্ধবাবু-সূর্যবাবুরা।

যে সর্বদল সমন্বয়ের উপরে দাঁড়িয়ে ভোটের আগে থেকেই তৃণমূলকে পিছনে ফেলে দিয়েছেন অশোকবাবু, এ দিন সেই অবস্থান বজায় রাখার ইঙ্গিত মিলল পুরসভার কক্ষেই। দার্জিলিঙের সাংসদ সুরেন্দ্র সিংহ অহলুওয়ালিয়ার সঙ্গে হাত মেলাতে দেখা গিয়েছে অশোকবাবুকে। কংগ্রেসের একাধিক কাউন্সিলরদের সঙ্গেও বাম কাউন্সিলরদের হাসিঠাট্টা করতে দেখা গিয়েছে। এমনকী, তৃণমূলের নেতাদের একাংশের সঙ্গেও হাত মিলিয়ে সহযোগিতা চাইতে দেখা গিয়েছে অশোকবাবুকে। যাঁকে তিনি হারিয়েছেন, সেই নান্টুবাবুর পিঠে হাত রেখে ‘সান্ত্বনা’ দিয়েছেন প্রাক্তন পুরমন্ত্রী। সিপিএমের দার্জিলিং জেলা সম্পাদক জীবেশ সরকারও প্রতিদ্বন্দ্বী দলের অনেক নেতার সঙ্গে হাত মিলিয়ে পুরসভা চালানোর জন্য সাহায্য চেয়েছেন। জীবেশবাবু বলেন, ‘‘সুস্থ মানসিকতার রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের মিলেমিশে চলতে হবে। তা হলেই রাজ্য রাজনীতিতে নয়া সমীকরণ জোরদার হবে। শিলিগুড়ি যেন সেই বার্তাই দিল।’’

পক্ষান্তরে, মন্ত্রী গৌতমবাবু বলছেন, ‘‘২০০৯ সালে কংগ্রেস বামেদের সমর্থন নিয়ে পুরবোর্ড গড়েছিল। এ বার কংগ্রেস ও বিজেপি-র কাউন্সিলরেরা ভোটাভুটিতে হাজির না থেকে বামেদের বোর্ড গড়ার রাস্তা সাফ করে দিলেন। ভোটের আগে থেকেই এই রামধনু জোট চলছে।’’ কংগ্রেস ও বিজেপি-র পাল্টা জবাব, বাম বা তৃণমূল— দু’পক্ষের থেকেই সমান দূরত্ব বজায় রাখতে চেয়েছি। তাতে কারও সুবিধা হয়েছে কি না, সেটা তাদের দেখার কথা নয়।

কিন্তু শেষ চেষ্টা কি করেনি তৃণমূল? তৃণমূলের অন্দরের খবর, রবিবার রাতেও ঝড়বৃষ্টি মাথায় নিয়ে নান্টুবাবু কংগ্রেস, নির্দল, এমনকী, বাম শিবিরের একাধিক কাউন্সিলরের সঙ্গে যোগাযোগ করে সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করেন। কিন্তু সিপিএমের একাধিক নেতা জানান, প্রাক্তন শিষ্য নান্টুর কাছে কোনও মতেই হার না মানার পণ করেছিলেন ‘গুরু’ অশোকবাবু। তিনিও রবিবার রাত ১টা পর্যন্ত পার্টি অফিসে থেকে কাউন্সিলরদের মনোবল বাড়িয়েছেন। সাতসকালে ফের হাজির হয়েছেন দলের কার্যালয়ে। ঝকঝকে নতুন বাস ভাড়া করে ভোটাভুটির প্রায় দু’ঘণ্টা আগেই কাউন্সিলরদের নিয়ে সভাকক্ষে পৌঁছে গিয়েছেন।

শপথ গ্রহণের পরে কংগ্রেস-বিজেপির কাউন্সিলরেরা বেরিয়ে যেতেই চেয়ারে আধশোওয়া দেখা গিয়েছে নান্টুবাবুকে। তাঁর মন্তব্য, ‘‘সবার সমর্থনই চেয়েছিলাম। যাক গে, খেলায় হার-জিত আছেই!’’ আর অশোকবাবু জানেন, টানা হার থেকে দলকে জয়ের মুখ দেখাতে ভরসা হয়ে থাকল তাঁর ‘কামব্যাক ইনিংস’ই!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE