তাঁর বিরুদ্ধে ছ’জন নাবালিকাকে ধর্ষণের অভিযোগ ছিল। অভিযোগ ছিল, তাদের মধ্যে এক জনকে ধর্ষণের পর খুন করারও। গ্রেফতার হয়েছিলেন ২০১৩ সালে। সাক্ষ্যগ্রহণ করে মহারাষ্ট্র্রের ঠাণের নিম্ন আদালত ২০১৯ সালে অভিযুক্তকে দোষী সাব্যস্ত করে ফাঁসির সাজা ঘোষণা করে। অভিযুক্ত সেই রায় চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হন। সম্প্রতি তাঁকে বেকসুর খালাস করার নির্দেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। সেই সঙ্গেই দেশের শীর্ষ আদালত তার পর্যবেক্ষণে বলেছে, মিথ্যা মামলায় যে মানুষটির ১২টি বছর কারাবন্দি অবস্থায় কেটে গেল, তাঁকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বন্দোবস্ত করা উচিত।
সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি বিক্রম নাথ এবং বিচারপতি সন্দীপ মেহতার বেঞ্চ সম্প্রতি ওই ব্যক্তির ক্ষতিপূরণের বিষয়টি কার্যকর করার দায়িত্ব সঁপেছেন কেন্দ্রের অ্যাটর্নি জেলারেল এবং সলিসিটর জেনারেলের উপর। সুপ্রিম কোর্টের এই পর্যবেক্ষণকে ‘স্বাগত’ জানালেও তার বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছে পশ্চিমবঙ্গের মানবাধিকার সংগঠনগুলি।
মানবাধিকার কর্মীদের বক্তব্য, এই ধরনের নির্দেশ বা পর্যবেক্ষণ আগেও এসেছিল সুপ্রিম কোর্ট-সহ বিভিন্ন হাই কোর্টের তরফে। কিন্তু বাস্তবে পরিস্থিতির বদল হয়নি। তেলঙ্গানার এক ব্যক্তিকে মাওবাদী কার্যকলাপের অভিযোগে গ্রেফতার করার পরে দীর্ঘ কয়েক বছর পরে তাঁকে বেকসুর খালাস করেছিল সুপ্রিম কোর্ট। সেই মামলাতেই আদালত তার পর্যবেক্ষণে বলেছিল, ‘‘কী ভাবে মামলা করা হয়েছিল, তা বলতে গেলে প্যান্ডোরার বাক্স খুলে যাবে।’’ এপিডিআর-এর সাধারণ সম্পাদক রঞ্জিত শূর একটি ঘটনার উদাহরণ দিতে গিয়ে জানিয়েছেন, গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ছত্রে সুব্বাও দীর্ঘ দিন কারাবাসের পরে বেকসুর খালাস হয়েছিলেন। তার পরে আদালতের দ্বারস্থ হয়ে ক্ষতিপূরণের আর্জি জানাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য, কোনও আইনজীবীই আইনি প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতার জন্য তাঁর হয়ে দাঁড়াতে চাননি। মানবাধিকার কর্মীদের আরও বক্তব্য, ব্রিটিশ জমানায় যে কারা আইন ছিল, সেখানে বন্দি থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির পরিবারকে ভরণপোষণের জন্য সরকারি সাহায্যের বিধান ছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পরে তা বিলুপ্ত হয়েছে এবং একাধিক দমনপীড়নমূলক আইন বলবত হয়েছে। কখনও তা ‘টাডা’ বা ‘মিসা’, কখনও ‘ইউএপিএ’।
পরিসংখ্যান বলছে, কঠোরতম আইন ইউএপিএ-তে যাঁরা গ্রেফতার হন, তাঁদের মধ্যে ২-৩ শতাংশ দোষী সাব্যস্ত হন। বাকিরা সকলেই দীর্ঘ সময় জেলে কাটানোর পরে বেকসুর খালাস পান। মাওবাদী যোগে গ্রেফতার হওয়া কলকাতার রাজা সরখেল, হিমাদ্রি সেনরায়, চণ্ডী সরকারদের ক্ষেত্রেও তেমনই হয়েছে। মানবাধিকার কর্মী রঞ্জিতের কথায়, ‘‘আইনি প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতা থেকে মামলা সাজানোর নেপথ্যে শাসকের হাত এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে, প্রক্রিয়াই এখন শাস্তি (প্রসেস ইজ় দ্য পানিশমেন্ট) হয়ে উঠেছে।’’
বন্দিমুক্তি কমিটির সভাপতি সুজাত ভদ্রের কথায়, ‘‘সুপ্রিম কোর্টের এই পর্যবেক্ষণকে স্বাগত। একজন কারাবন্দি থাকলে তাঁর এবং তাঁর পরিবারের গায়ে সামাজিক ভাবে নানা তকমা লাগানো হয়। ক্ষতিপূরণ দেওয়াই উচিত। কিন্তু তা নিশ্চিত করার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ।’’ মানবাধিকার সংগঠনগুলির এ-ও বক্তব্য যে, ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আরও একটি দিক রয়েছে। সরকার ক্ষতিপূরণ দিলে প্রকৃতপক্ষে তারা পরোক্ষে মানতে বাধ্য হয় যে, তারা একজন নাগরিকের ‘ক্ষতি’ করেছে। সেই জন্যই এখন তা ‘পূরণ’ করছে।
মহারাষ্ট্রের ওই মামলার পর্যবেক্ষণে সুপ্রিম কোর্ট এ-ও বলেছে যে, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশে প্রক্রিয়াগত ত্রুটি বা মিথ্যা মামলায় কেউ বন্দি থাকলে মুক্তির পরে তাঁদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আইন রয়েছে। কিন্তু ভারতে তেমন আইন নেই। সেই কারণেই শীর্ষ আদালত দায়িত্ব সঁপেছে কেন্দ্রের অ্যাটর্নি জেলারেল এবং সলিসিটর জেনারেলের কাঁধে।