নিয়োগ মামলায় গ্রেফতার মুর্শিদাবাদের বড়ঞার তৃণমূল বিধায়ক জীবনকৃষ্ণ সাহাকে ছ’দিনের জন্য নিজেদের হেফাজতে নিল এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। নিয়োগ মামলায় এই নিয়ে দ্বিতীয় বার গ্রেফতার হলেন তিনি। ২০২৩ সালের এপ্রিলে তাঁকে গ্রেফতার করেছিল সিবিআই। পরে জামিনে ছাড়াও পান। এ বার সেই নিয়োগ মামলাতেই ফের গ্রেফতার হলেন জীবনকৃষ্ণ। এ বার গ্রেফতার হলেন অপর কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা (ইডি)-র হাতে। দু’বছর আগে যে নাটকীয়তা দেখা গিয়েছিল, এ বারও সেই নাটকীয়তা দেখা গেল মোবাইল ঘিরে। আগের বার পুকুরে ছুড়ে ফেলেছিলেন বলে অভিযোগ ওঠে। এ বার ফেললেন নর্দমায়। সেই মোবাইল উদ্ধারও করল ইডি।
সোমবার সকাল থেকে এসএসসি দুর্নীতি মামলায় রাজ্যের একাধিক জায়গায় হানা দেয় ইডি। মুর্শিদাবাদের কান্দির আন্দি গ্রামে বিধায়কের বাড়িতে হানা দেন তদন্তকারীরা। অভিযান চলে রঘুনাথগঞ্জে বিধায়কের শ্বশুরবাড়িতেও। ওই অভিযানেই গ্রেফতার হন জীবনকৃষ্ণ। মুর্শিদাবাদ থেকে তাঁকে নিয়ে আসা হয় কলকাতায়। বিকেলেই সল্টলেকে তাঁর ‘মেডিক্যাল’ (গ্রেফতারি পরবর্তী স্বাস্থ্য পরীক্ষা) করানো হয়। সন্ধ্যায় পেশ করা হয় নগর দায়রা আদালতে। কী কারণে জীবনকৃষ্ণকে গ্রেফতার করা হচ্ছে, তা-ও আদালতে জানান ইডির আইনজীবী।
তদন্তকারী সংস্থার বক্তব্য, বেশ কিছু সন্দেহজনক লেনদেনের হদিস পাওয়া গিয়েছে। বিধায়কের স্ত্রী এবং বাবার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টও লেনদেনের জন্য ব্যবহার হয়েছে। এ বিষয়ে নথি চেয়েও পাওয়া যায়নি বলে দাবি ইডির আইনজীবীর। পাশাপাশি, তদন্তকারী সংস্থা আরও জানায়, অভিযানের সময় পাঁচিল টপকে পালানোর চেষ্টা করেন জীবনকৃষ্ণ। মোবাইল উদ্ধারের প্রসঙ্গও উঠে আসে আদালতে। আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ প্রসঙ্গে, ৬-৭ জন চাকরিপ্রার্থীর উদাহরণ তুলে ধরে ইডি। আদালতে তদন্তকারী সংস্থা জানায়, ৪৬ লক্ষ টাকার লেনদেন হয়েছে বলে সন্দেহ করছে তারা।
নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় অতীতে গ্রেফতার হয়েও জামিন পেয়েছেন জীবনকৃষ্ণ। সে ক্ষেত্রে কেন তাঁকে আবার গ্রেফতার করার দরকার পড়ল, তা নিয়ে আদালতে প্রশ্ন তোলেন বিধায়কের আইনজীবী। অতীতে তাঁর মক্কেল তদন্তে সহযোগিতা করেছেন বলেও আদালতে জানান আইনজীবী। তাঁর বক্তব্য, গত দেড় বছর ধরে তদন্তে সহযোগিতা করা হচ্ছে। তদন্তে নতুন কী পাওয়া গেল, যার জন্য গ্রেফতার করা হচ্ছে, তা নিয়েও প্রশ্ন আইনজীবীর। ইডির মামলা থেকে জামিন নয়, পুরোপুরি মুক্তির জন্য আবেদন জানান জীবনকৃষ্ণের আইনজীবী। যদিও দু’পক্ষের বক্তব্য শোনার পরে বিচারক বলেন, “ইডি ওঁকে হেফাজতে চাইছে। তদন্ত চলুক। এটা খুব গুরুতর অভিযোগ” শেষ পর্যন্ত তদন্তকারী সংস্থার আবেদন মতো জীবনকৃষ্ণের ছ’দিনের ইডি হেফাজতের নির্দেশ দিয়েছে আদালত। আগামী শনিবার ফের তাঁকে পেশ করা হবে আদালতে।
আমি পালাইনি! দাবি জীবনের
সোমবার সন্ধ্যায় আদালতে নিয়ে যাওয়ার সময়ে দ্বিতীয় বার গ্রেফতারির প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হয় জীবনকে। উত্তরে বিধায়কের দাবি, পুরোটাই বিজেপির ‘চক্রান্ত’। পরে আদালত চত্বর থেকে ইডি আধিকারিকেরা তাঁকে নিয়ে যাওয়ার সময়েও বাবা ও স্ত্রীর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া হয় বিধায়কের কাছে। ওই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “সব স্টেটমেন্ট দেওয়া হয়েছে। একদম ক্ল্যারিফিকেশন দিয়ে দিয়েছি। আগেই দিয়েছি। আমি পালাইনি। সব নথি জমা দেওয়া আছে।” ২০২৩ সালের এপ্রিলে সিবিআইয়ের হাতে গ্রেফতারির পর থেকে প্রায় ১৩ মাস বন্দি ছিলেন তিনি। শেষে গ্রেফতারির প্রায় ১৩ মাস পরে গত বছরের মে মাসে সুপ্রিম কোর্ট থেকে জামিন পান বিধায়ক। জামিনের পরে বিধানসভাতেও গিয়েছিলেন তিনি।
এ বারও সেই মোবাইল বিতর্ক
২০২৩ সালে যখন জীবনকৃষ্ণের বাড়িতে হানা দিয়েছিল সিবিআই, তখন তিনি দু’টি মোবাইল পুকুরে ফেলে দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ। দীর্ঘ তল্লাশির পর পুকুরের জল ছেঁচে তা উদ্ধার করা হয়। এ বারও বিতর্ক সেই মোবাইল নিয়েই। অভিযোগ, সোমবার সকালে ইডি যখন জীবনকৃষ্ণের বাড়িতে পৌঁছোয়, তখন পিছন দিকের দরজা দিয়ে তিনি পালানোর চেষ্টা করেছিলেন। স্থানীয় সূত্রের দাবি, পাঁচিল টপকে ছুটতে ছুটতে প্রায় ১০০ মিটার চলেও গিয়েছিলেন তিনি। তিন কেন্দ্রীয় আধিকারিক ধাওয়া করেন তাঁকে। ওই সময় রাস্তার মধ্যে কাদায় হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়েছিলেন বিধায়ক। শেষে কেন্দ্রীয় আধিকারিকেরা তাঁকে ধরে ফেলেন এবং বাড়ির ভিতর নিয়ে এসে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন। জীবনকে বাড়িতে নিয়ে এসে জিজ্ঞাসাবাদের সময় দেখা যায়, তাঁর মোবাইল সঙ্গে নেই। প্রথমে তা বোঝা যায়নি। পরে ইডি বুঝতে পারে এবং বাড়ির পিছন দিকের ঝোপে নর্দমা থেকে মোবাইলটি উদ্ধার হয়। অভিযোগ, এর পরেও দু’টি মোবাইলের পাসওয়ার্ড বলতে চাননি বিধায়ক।
আরও পড়ুন:
জীবনের আত্মীয়দের বাড়িতেও অভিযান
মুর্শিদাবাদে জীবনকৃষ্ণের বাড়ি ছাড়াও রঘুনাথগঞ্জে বিধায়কের শ্বশুরবাড়িতে হানা দেয় ইডি। এ ছাড়া আন্দির মহিষ গ্রামের এক ব্যাঙ্ককর্মীর বাড়িতেও তল্লাশি চালানো হয়। বীরভূমের সাঁইথিয়াতেও পৌঁছে যান কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার আধিকারিকেরা। সেখানে ৯ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর মায়া সাহার বাড়িতে হানা দেয় ইডি। সম্পর্কে মায়া জীবনকৃষ্ণের পিসি। সূত্রের দাবি, জীবনকৃষ্ণের শ্যালক নিতাই সাহাকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। এর আগেও নিতাইয়ের বাড়িতে হানা দিয়েছিল কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। সেই সময়ে অবৈধ ভাবে প্রাথমিক স্কুলে চাকরি পাওয়ার অভিযোগ উঠেছিল বিধায়কের শ্যালকের বিরুদ্ধে।