Advertisement
E-Paper

মাটির উঠোনে সুদিন ফেরাচ্ছেন ‘ডিস্কো’রা

হুরমত শেখের ‘ডিস্কো’ হয়েছে! বিয়ের পাঁচ বছরের মাথায় তাঁর তৃতীয় সন্তানটি পঙ্গু হওয়ায় হুরমতের যে বিশেষ আফসোস রয়েছে, এমন নয়। কোমরের নীচ থেকে শীর্ণ, অসাড় পা, মাস দেড়েকের ছেলেটার দিকে চেয়ে হুরমত ভরসা খুঁজছেন—‘‘খোদাতালার ইচ্ছে, ছেলে অন্তত ভিক্ষে করে দু’পয়সা আয় করবে!’’

রাহুল রায়

শেষ আপডেট: ০৮ জানুয়ারি ২০১৬ ০৩:২৪
মক্কা-ফেরত এক প্রতিবন্ধী। মহালন্দীতে।

মক্কা-ফেরত এক প্রতিবন্ধী। মহালন্দীতে।

হুরমত শেখের ‘ডিস্কো’ হয়েছে!

বিয়ের পাঁচ বছরের মাথায় তাঁর তৃতীয় সন্তানটি পঙ্গু হওয়ায় হুরমতের যে বিশেষ আফসোস রয়েছে, এমন নয়। কোমরের নীচ থেকে শীর্ণ, অসাড় পা, মাস দেড়েকের ছেলেটার দিকে চেয়ে হুরমত ভরসা খুঁজছেন—‘‘খোদাতালার ইচ্ছে, ছেলে অন্তত ভিক্ষে করে দু’পয়সা আয় করবে!’’

খাপলা ছাওয়া উঠোনের কোণে দু’আঁটি খড়ের উপরে শোয়ানো সদ্যোজাতটির দিকে চোখ পড়লে আমিনা বিবির অবশ্য গলা বুজে আসছে। পড়শি মহিলারা তাঁকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন— ‘‘খোদায় তোরে ডিস্কো দেইছেন, কপাল তো ফিরল রে আমিনা, চোখের পানি মোছ।’’

মুর্শিদাবাদের কান্দি-সিউড়ি সড়কে পিঠোপিঠি মহালন্দী আর হাটপাড়া গ্রামের পঙ্গু-প্রতিবন্ধীদের ওই নামেই চেনে গোটা তল্লাট— ‘ডিস্কো’। তার মাহাত্ম্য বোঝেন না, এমন অবুঝ নন আমিনা-হুরমতও। তাঁদের চোখের সামনেই তো মাটির দাওয়া আর খড়-খাপলার চালার ছায়া ঢাকা আটপৌরে গ্রাম দু’টো বছর কয়েকের মধ্যে ইট-সিমেন্টের ইমারতে ছেয়েছে। ছাদে বসেছে ডিশ-অ্যান্টেনা, উঠোনে স্কুটার-মোটরবাইকে। শ্রীবৃদ্ধির এই জোয়ারে সামিল হতেই বুঝি হুরমতও বিড়বিড় করছেন, ‘‘আল্লার দোয়ায় পঙ্গু ছেলেই হয়তো এ বার আমাদের সুদিন ফেরাবে!’’

কী করে? জবাবের খেইটা ধরিয়ে দেন মহালন্দী স্কুলের শিক্ষক আখতার আলি— ‘‘কিশোর বেলাটুকু পার করে দিতে পারলেই হল, বুঝলেন? গ্রামের এজেন্টের হাত ধরে হজ যাত্রী হয়ে মক্কা পাড়ি দেবে প্রতিবন্ধীর দল, আর মাসখানেক পরে দু’পকেটে সুদিন নিয়ে ফিরে আসবে!’’ তিনি জানান, কাবা শরিফের ‘আসমান ছোঁয়া’ পাঁচিলের গায়ে মাসখানেক ধরে লুকিয়ে-চুরিয়ে ভিক্ষা করে প্রতিবন্ধীরা যা পান, তার অঙ্কটা লাখ পাঁচেকের কম নয়। হজে যাওয়া তীর্থযাত্রীরাই আয়ের উৎস। দিনার, রিয়াল কিংবা ডলারে পাওয়া সেই ভিক্ষার দানই হুন্ডি-বাহিত হয়ে চলে আসছে মহালন্দী- হাটপাড়ার।

পাকাবাড়ি, রঙিন টিভি, সদ্য বাজারে আসা মোবাইল কেনার হিড়িক— রমরমার কারণটা জানেন মহালন্দী ১ পঞ্চায়েত প্রধান, কংগ্রেসের সাহেবা খাতুনও। বলেন, ‘‘অনেকেই আরবে মজুর খাটতে যায় বটে, তবে ভিক্ষার আয়ে অনেকেরই বরাত খুলেছে রাতারাতি।’’ গত দু’দশকে মহালন্দীর সঙ্গে কপাল খুলেছে হাটপাড়ারও। তবে সেটি যে পঞ্চায়েতের এলাকায় পড়ে, সেই গোকর্ণ পঞ্চায়েতের প্রধান কংগ্রেসের চুমকি হাজরার সতর্ক মন্তব্য, ‘‘সবই তো বুঝতে পারছেন! এ ব্যাপারে আমি কিছু বলব না।’’

তবে মহালন্দীর ‘ডিস্কো-এজেন্ট’ রেজাউল হক লুকোছাপা করছেন না। গ্রামের চৌমাথায় চায়ের দোকানে বসে তিনি বলেন, ‘‘আমাদের পেশাটা এক রকম লটারি। পাঁচ-ছ’জন ডিস্কো নিয়ে গিয়ে ফাটকা খেলে বিশ-বাইশ লাখ কামিয়েছি, আবার ধরা পড়ে সটান গ্রামেও ফিরতে হয়েছে।’’

হজযাত্রী হিসেবে ডিস্কোর নাম নথিভুক্ত করানো, পাসপোর্ট করানোর দায়িত্ব এজেন্টের। রেজাউল জানান, বহরমপুরে পাসপোর্ট অফিসের শাখা খোলায় এখন আর কলকাতা ছোটার ঝক্কি নেই। মক্কায় ডিস্কোদের থাকা-খাওয়ার দায়িত্বও তাঁদের। অন্য এক এজেন্ট খইরুল আলম বলেন, ‘‘ইদ-সবেবরাত কিংবা নবি দিবসের সময়ে হজে যাওয়ার হিড়িকটা বেশি। এই সময়ে রিয়াধ কিংবা মক্কায় ৬০ থেকে ১০০ রিয়াল ফেললেই বাথরুম-সহ এসি ঘর পাওয়া য়ায়। দশ-বারো জন অনায়াসে থাকা যায়।’’

ভিক্ষার আয়ে শ্রী ফিরছে মহালন্দীর।

খইরুল জানাচ্ছেন, মক্কায় পৌঁছেই প্রতিবন্ধীরা রোজা রাখা শুরু করেন। রোজার ‘অজুহাতে’ ১৫ দিনের ভিসা এক মাসের ছাড়পত্র পেয়ে য়ায়। তাঁদের হিসেবে থাকা-খাওয়া আর যাতায়াত নিয়ে জন প্রতি খরচ ১.২০ থেকে ১.৩০ লক্ষ টাকা। রেজাউল বলেন, ‘‘এক জন ডিস্কোর রোজগার জানেন? পাঁচ থেকে ছ’লাখ! তা থেকে ১৫% আমার পকেটে যায়।’’ সেই নগদ টাকা হুন্ডি মারফত আসে গ্রামে। কিন্তু ভিক্ষা করায় এত লুকোচুরি কেন? রেজাউল মনে করিয়ে দেন, ‘‘ইসলামে ভিক্ষা করা তো মন্দ কাজ, ‘হারাম’। তাই সতর্ক থাকতে হয়।’’ ভিক্ষার অপরাধে মক্কার গারদ দর্শনের অভিজ্ঞতাও রয়েছে তাঁর। খইরুল অবশ্য বলছেন, ‘‘সৌদি-সরকারের সেই জেলখানাও এত সুন্দর! সেখানে থাকতে পারলেও বর্তে যাবেন কর্তা!’’

রেজাউলের হাত ধরে বার তিনেক ‘হজ’-এ গিয়েছেন মহালন্দীর জার্মান শেখ। সত্তরোর্ধ্ব জার্মান বলেন, ‘‘ওই রোজগারের টাকায় পাকা ঘর, ছেলের স্কুটার, মেয়ের বিয়ে, স্কুলের ফান্ডে অনুদান দেওয়ার পরেও যা রয়েছে তাতে আমার এন্তেকাল (মৃত্যু) তক দিব্যি চলে যাবে।’’ পোলিও আক্রান্ত আব্বাস আলির ডান হাতটা ফিতের মতো সরু। তাঁর আফসোস, ‘‘দু’বারে প্রায় ১৩ লক্ষ টাকা রোজগার করেছি, কিন্তু এক হাতে মোটরবাইক চালাতে পারব না, তাই কেনা হল না।’’

প্রশ্ন হল, মুর্শিদাবাদের প্রান্তিক গ্রামগুলিতে এত প্রতিবন্ধী কেন?

দেশের পিছিয়ে পড়া এলাকায় মানুষের আয়ের উৎস নিয়ে গবেষণা করছে পুণের সংস্থা ‘লিভিং উইথ রুরাল ইন্ডিয়া’। তাদের রিপোর্ট বলছে— মুর্শিদাবাদের ওই এলাকায় এখনও কুসংস্কারের ছায়া কাটেনি। ব্লক হাসপাতাল নয়, গ্রামের ভরসা ফকির-গুণিন। পোলিও, বিসিজি, ডিপিটি টিকা দেওয়া হচ্ছে অধিকাংশ শিশুকে। বিকলাঙ্গের হার তাই বেশি। দুর্ঘটনায় জখম হওয়ার পরে জড়িবুটির দৌলতেও অঙ্গহানি ঘটছে অনেকের।

মহালন্দীর পুরনো বাসিন্দা ইলিয়াস শেখ বলছেন, ‘‘বছরখানেক আগে পোলিও টিকা নেওয়ার পরে একটি শিশু মারা গিয়েছিল। শুরু হল পোলিও-বয়কট। দিনের পর দিন বুঝিয়েও গ্রামের শিশুদের পোলিও খাওয়ানো যায়নি।’’ গোকর্ণ ব্লক স্বাস্থ্য আধিকারিক দয়াল মণ্ডলের কথাতেও একই ইঙ্গিত— ‘‘গ্রামে বেশ কিছু পোলিও সংক্রমণের ঘটনা রয়েছে। সম্ভবত টিকা না নেওয়ার ফল।’’

গ্রামে সচেতনতা ফেরানোর লড়াই অবশ্য চালিয়ে যাচ্ছে ‘মহালন্দী ইস্টার্ন ক্লাব’। ক্লাবের সম্পাদক আবরার হোসেন বলছেন, ‘‘আধুনিক ওষুধ বা টিকা সম্পর্কে সচেতনতার অভাব তো আছেই। পরিবারের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্কও রয়েছে। জ্ঞাতি-বিবাহের ফলে পরের প্রজন্মে জিনঘটিত রোগ বাড়ছে, জন্মাচ্ছে প্রতিবন্ধী শিশুও।’’

সুস্বাস্থ্য না কি ডিস্কোদের আনা দৌলত, কোনটা ভবিষ্যৎ তা মহালন্দী বা হাটপাড়ার বাসিন্দাদেরই বেছে নিতে হবে।

ছবি: গৌতম প্রামাণিক।

begging disco patient mahalandi rahul roy
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy