Advertisement
০৭ মে ২০২৪

খাদ্যে ভেজাল রুখবে কে, কাজিয়া

২০১১ সাল থেকে গত ৪ বছরে ভেজাল সন্দেহে শহরে ১১০টি নমুনা সংগ্রহ করেছে পুরসভা। ভেজাল মিলেছে মাত্র ২২টিতে। অথচ ভেজাল খাবার নিয়ে প্রায়ই শহরে নানা অভিযোগ ওঠে। তা সত্ত্বেও এক হাজারেরও বেশি দিনে নমুনা সংগ্রহ হয়েছে মাত্র ১১০টি। প্রশ্নটি উঠেছিল পুর-অধিবেশনেও। নামী রেস্তোরাঁ, রাস্তার হোটেল, মিষ্টির দোকানে ভেজাল এবং কাটা ফলের বিক্রি রুখতে পুরসভায় আলাদা দফতর আছে। আছেন মেয়র পারিষদও। কী করেছে ওই দফতর? কেনই বা যথেষ্ট অভিযান হয়নি ভেজালের বিরুদ্ধে?

অনুপ চট্টোপাধ্যায়, মেহবুব কাদের চৌধুরী
শেষ আপডেট: ২৫ মে ২০১৫ ০৩:৩২
Share: Save:

২০১১ সাল থেকে গত ৪ বছরে ভেজাল সন্দেহে শহরে ১১০টি নমুনা সংগ্রহ করেছে পুরসভা। ভেজাল মিলেছে মাত্র ২২টিতে। অথচ ভেজাল খাবার নিয়ে প্রায়ই শহরে নানা অভিযোগ ওঠে। তা সত্ত্বেও এক হাজারেরও বেশি দিনে নমুনা সংগ্রহ হয়েছে মাত্র ১১০টি। প্রশ্নটি উঠেছিল পুর-অধিবেশনেও।

নামী রেস্তোরাঁ, রাস্তার হোটেল, মিষ্টির দোকানে ভেজাল এবং কাটা ফলের বিক্রি রুখতে পুরসভায় আলাদা দফতর আছে। আছেন মেয়র পারিষদও। কী করেছে ওই দফতর? কেনই বা যথেষ্ট অভিযান হয়নি ভেজালের বিরুদ্ধে?

ওই সময়ে খাদ্যে ভেজাল দফতরের মেয়র পারিষদ পার্থপ্রতিম হাজারি অধিবেশনে প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, কলকাতার মতো বড় শহরে ভেজাল ধরতে আছেন মাত্র ২২ জন ফুড সেফটি অফিসার। দরকার অন্তত শ’খানেক। ভেজাল পরীক্ষায় যে ধরনের ল্যাবরেটরি দরকার, তা নেই। কয়েক কোটি টাকা না হলে তা তৈরি করা এবং প্রয়োজন মতো লোক নিয়োগ করা যাবে না বলে ২০১৪ সালেই জানিয়ে দিয়েছিলেন পার্থবাবু।

পার্থবাবুর অভিযোগ মেনে নিয়েছেন স্বাস্থ্য দফতরের মেয়র পারিষদ অতীন ঘোষও। তবে তাঁর কথায়, ‘‘সীমিত পরিকাঠামোর মধ্যেও ভেজাল রুখতে যে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত ছিল, বিগত বছরে তা নেওয়া হয়নি।’’ অর্থাৎ তাঁরই দলের এক মেয়র পারিষদের কাজের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অতীনবাবু।

পার্থবাবুর পাল্টা বক্তব্য, দফতর আলাদা হলেও বাজেটে খাদ্যে ভেজাল আটকানোর দফতরের নামে আলাদা টাকা বরাদ্দ হয়নি। বলা হয়েছিল, স্বাস্থ্য দফতরের মধ্যেই তা আছে। তবে পরিকাঠামো উন্নয়নে স্বাস্থ্য দফতর কোনও ভূমিকা নেয়নি কেন? পার্থবাবু আরও জানান, ভেজাল কারবারিদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়াতেও রয়েছে দীর্ঘসূত্রতা। ২০১১-এ কেন্দ্রীয় আইন অনুযায়ী, খাদ্যে ভেজাল মিললে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আইএএস পদমর্যাদার ‘অ্যাডজুডিকেটিং অফিসার’ শুনানির দায়িত্বে থাকবেন। কিন্তু গত চার বছর ধরে তেমন অফিসার নেই। ফলে থমকে বহু বিচারের শুনানি।

সবিস্তার দেখতে ক্লিক করুন

প্রসঙ্গত, এ বার পুরভোটে ১৭ নম্বর ওয়ার্ডে পরাজিত হন তৃণমূল প্রার্থী পার্থপ্রতিম হাজারি। অভিযোগ করেন, তাঁকে হারাতে স্থানীয় বিধায়ক তথা মন্ত্রী শশী পাঁজা ও এক কাউন্সিলর নির্দল প্রার্থী মোহন গুপ্তকে মদত দেন। তখনই পার্থ হাজারির বিরুদ্ধে ব্যর্থতার তকমা লেপে দিয়েছিল মোহন গুপ্তের দলবল। এখন অবশ্য ফের তৃণমূলে ঢুকে পড়েছেন মোহন। এ বার খাদ্যে ভেজাল আটকানোর দফতর-সহ পুরো স্বাস্থ্য দফতর গিয়েছে অতীনবাবুর হাতে। তিনি জানান, জুনের মধ্যেই শহরে ভেজাল আটকানোর অভিযান শুরু হবে।

পুরসভা সূত্রে খবর, সম্প্রতি মধ্য কলকাতার বড় হোটেল থেকে আনা ডালের বড়ি, অন্য একাধিক নামী রেস্তোরাঁর ফিশফ্রাই, কাঁচকলার কোপ্তা, মালাই চপ ও কাটলেট পরীক্ষায় ‘বিষাক্ত’ মেটানিল ইয়েলো মিলেছে। এক পাঁচতারা হোটেলের পনিরে ফ্যাটের পরিমাণ মিলেছে বেশি, কার্বোহাইড্রেট ও প্রোটিন বেশ কম। সেখানেই গোলাপ জলে ‘মিসব্র্যান্ড’-এর নমুনা মিলেছে। অর্থাৎ সেটি কবে তৈরি বা ব্যবহারের সর্বশেষ সময়সীমা লেখা নেই। কিন্তু তা পরীক্ষার ক্ষেত্রে পুরসভার নিজস্ব পরীক্ষাগারের মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে পরীক্ষক মহলেই। অতীনবাবুও বলছেন, ‘‘সরবতে রং বা ফলে রঞ্জক আছে কি না, তা হয়তো আমাদের পরীক্ষাগারে ধরা যায়। তবে বিষাক্ত রাসায়নিক ধরার মতো যন্ত্র নেই।’’ সেটি উন্নত করাই প্রধান কাজ হবে স্বাস্থ্য দফতরের।

পুর-স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে খবর, কেন্দ্রীয় সরকারের খাদ্য ভেজাল প্রতিরোধ আইন (প্রিভেনশন অব ফুড অ্যাডাল্ট্রেশন অ্যাক্ট, ১৯৫৪) অনুযায়ী আগে সব অভিযোগের নিষ্পত্তি আদালতে হতো। ২০০৬-এ ওই আইন সংশোধন করে নতুন নামকরণ হয় খাদ্য নিরাপত্তা এবং গুণগত মান নির্ধারক আইন (ফুড সেফটি অ্যান্ড স্ট্যান্ডার্ড অ্যাক্ট)। যা কার্যকর হয় ২০১১-য়। নয়া আইনে ভেজাল খাবার সরবরাহে যুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রয়োজনীয় ভূমিকা নেবেন ‘অ্যাডজুডিকেটিং অফিসার’। অভিযোগ খতিয়ে দেখে ক্ষতিপূরণের পরিমাণ ঠিক করা বা ওই অভিযোগ আদালতে নিষ্পত্তি হবে কি না সে সিদ্ধান্তও তিনিই নেবেন। পার্থবাবু বলেন, ‘‘অ্যাডজুডিকেটিং অফিসার নিয়োগ নিয়ে পুর-কমিশনারকে একাধিক বার জানানো হয়েছে।” তবে পুর-কমিশনার খলিল আহমেদ অবশ্য এ নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি।

শহরে ভেজাল খাবারের রমরমায় চিন্তিত চিকিৎসকেরাও। ক্যানসার বিশেষজ্ঞ সুবীর গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, ‘‘পরিবেশ দূষণের সঙ্গে এতে ক্যানসারের সম্ভাবনা বাড়ছে। অনুমোদিত নয়, এমন রং খাদ্যে মেশালে জটিল রোগের সম্ভাবনা থাকে। মেটানিল ইয়েলো, রোডামিন বি, কঙ্গো রেড, অরামিন, ম্যালাকাইট গ্রিন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে বিকল করে, ক্যানসারেরও আশঙ্কা থাকে। পুরসভাকে আরও সক্রিয় হতে হবে।’’ চিকিৎসক গৌতম মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘দৃষ্টিনন্দন রঙিন খাবারে মানুষের দুর্বলতা ক্ষতিকারক হতে পারে। খাবারে মেশানো রাসায়নিক থেকে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিকল হতে পারে। ভেজাল খাবার থেকে পেটের অসুখ, কিডনির সমস্যা, ক্যানসারের আশঙ্কাও প্রবল। ভেজাল আটকাতে প্রশাসনকে কড়া ব্যবস্থা নিতে হবে।’’

চিকিৎসক সুকুমার মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘ভেজাল খাবার থেকে ডায়েরিয়া, পেটের অসুখ, স্নায়ুর সমস্যাও হতে পারে।’’ গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজিস্ট অভিজিৎ চৌধুরীর কথায়, ‘‘ভেজাল খাবার সামগ্রিক ভাবে দেহের ক্ষতি করে। নিয়মিত ভেজাল খাবার থেকে পেটের অসুখ, এমনকী শরীরের নানা অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ক্ষতিও হতে পারে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE