এই মুহূর্তে সব স্তরেই আলোচনা চলছে ভোটার তালিকায় বিশেষ নিবিড় সংশোধন (এসআইআর) নিয়ে। এ বিষয়ে মনে থাকা নানা প্রশ্নের উত্তর খোঁজার পরে কেউ খোশমেজাজে বলছেন, ‘‘আমাদের কোনও চিন্তা নেই।’’ কেউ কেউ আবার উদ্বিগ্ন মুখে নথিপত্র যথাসম্ভব হাতের কাছে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ঘনিষ্ঠ বৃত্তে তাঁরা আবার বলছেন, ‘‘দেখাই যাক, কী হয়!’’ অভিযোগ, এই পরিস্থিতিরই সুযোগ নিচ্ছে সাইবার প্রতারকেরা। প্রতারণার জন্য সরাসরি তারা নিশানা করছে এসআইআর নিয়ে উদ্বিগ্নদের। কলকাতা পুলিশে গত এক মাসে এমনই একাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে বলে সূত্রের খবর। পুলিশের ওই সূত্র জানাচ্ছে, কোথাও তথ্য জানানোর নাম করে ফাঁদ পাতা হচ্ছে। কোথাও টাকা হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে শুধুমাত্র জন্মের শংসাপত্র করে দেওয়ার নাম করে। নির্বাচন কমিশনের নাম করে সরাসরি প্রতারণার ফাঁদ পাতারও অভিযোগ জমা পড়েছে পুলিশে।
এই পরিস্থিতিতে লালবাজারের তরফে এ নিয়ে দ্রুত সচেতনতার প্রচার শুরুর ভাবনাচিন্তা করা হচ্ছে। রাজ্য পুলিশের এক কর্তার দাবি, ‘‘এক অভিনব পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। সাইবার প্রতারণার পাশাপাশি, টাকার বিনিময়ে নথি বানিয়ে দেওয়ার দালাল-চক্রের সক্রিয় হওয়ারও অভিযোগ আসছে। গত ১০ দিনে এ নিয়ে রাজ্য জুড়ে বেশ কয়েকটি ধরপাকড় হয়েছে। কলকাতা পুলিশেই প্রতারণার অভিযোগ জমা পড়েছে ১৬টি।’’ বুধবার পর্যন্ত এই অভিযোগের সংখ্যা চিন্তা বাড়াচ্ছে, আরও সময় গেলে কী পরিস্থিতি হতে পারে, সে কথা ভেবে।
এমনই প্রতারণার ঘটনায় অভিযোগকারী, জেমস লং সরণির এক বাসিন্দার দাবি, ২০০২ সালের ভোটার তালিকায় তাঁদের নাম নেই। সে জন্য তাঁরা উদ্বিগ্ন। এর মধ্যে হঠাৎ তাঁর কাছে নির্বাচন কমিশনের নামে ফোন আসে। জানানো হয়, নথি তৈরি করে দেওয়ার জন্য অনলাইন ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে কমিশন থেকে। বিশ্বাস করে ফোনে পাঠানো একটি লিঙ্কে ক্লিক করতেই তাঁর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে হাওয়া হয়ে যায় লক্ষ লক্ষ টাকা। অভিযোগকারীর মন্তব্য, ‘‘লিঙ্কে ক্লিক করতেই একটি ফর্ম খুলে যায়। সেটি পূরণ করতে করতেই কয়েক দফায় প্রায় পাঁচ লক্ষ টাকা কেটে নেওয়া হয়।’’ বেহালার বাসিন্দা আর এক মহিলার দাবি, ‘‘আমার কাছেও এমন ফোন এসেছিল। একটি লিঙ্ক পাঠিয়ে বলা হয়, নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটের লিঙ্ক। ক্লিক করলেই নাকি ২০০২ সালের ভোটার তালিকা পাওয়া যাবে। কিন্তু লিঙ্ক খুলতেই ফোনের সমস্ত কিছু বেহাত হয়ে যায়। ব্যাঙ্ক থেকে ১৮ লক্ষ টাকা চলে যায়। পুলিশ বলছে, ফোনটিই নাকি ক্লোন করে নেওয়া হয়েছিল।’’
অভিযোগ এসেছে খাস কলকাতা পুরসভায় গিয়ে দালাল-চক্রের ফাঁদে পড়ার। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক অভিযোগকারীর দাবি, দ্রুত জন্মের শংসাপত্র বার করে দেওয়ার জন্য দু’হাজার টাকা নেওয়া হয়। সাত দিন পরে নথি আনতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির আর খোঁজ পাওয়া যায়নি। আর এক ব্যক্তির অভিযোগ, তাঁকে বলা হয়, তাঁর এলাকার বরো চেয়ারম্যানকে টাকা দিলে নাকি জন্মের শংসাপত্র বার করে দেওয়া হবে। কিন্তু সেই টাকা দিলেও যিনি টাকা নিচ্ছেন, তাঁকে আর পুরসভায় গিয়ে দেখা যায়নি। কেষ্টপুরের এক প্রবীণ বাসিন্দার আবার দাবি, গণনাপত্র পূরণের সময়ে তাঁর থেকে বাড়ির দলিল চাওয়া হয়েছে।
যদিও নির্বাচন কমিশন স্পষ্ট জানাচ্ছে, এসআইআর নিয়ে কাউকেই তাদের তরফে ফোন করা হচ্ছে না। https://ceowestbengal.wb.gov.in এবং নির্বাচন কমিশনের সরকারি ওয়েবসাইটে শুধুমাত্র এই সংক্রান্ত তথ্য মিলছে। নির্বাচন কমিশন সূত্রের দাবি, ‘‘গণনাপত্র ভর্তির জন্য কারও বাড়িতে গিয়ে কোনও বিএলও (বুথ স্তরের অফিসার) বা বিএলএ (রাজনৈতিক দলের বুথ লেভেল এজেন্ট) নথি চাইতে পারেন না। প্রয়োজনে ইলেক্টোরাল রেজিস্ট্রেশন অফিসার নথি চাইবেন নোটিস পাঠিয়ে। বিএলএ হওয়া কোনও ব্যক্তি বিএলও-দের কাজে নজরদারি চালানো ছাড়া কিছুই করতে পারবেন না।’’ এ ব্যাপারে কলকাতা পুলিশের এক কর্তার মন্তব্য, ‘‘থানা স্তর থেকে নজরদারি বাড়াতে বলা হয়েছে।’’ কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম যদিও বললেন, ‘‘নথির জন্য ভিড় হচ্ছে। দ্রুত কাজ মেটাতে বলেছি। কিন্তু দালালের খপ্পরে পড়ার অভিযোগ এখনও পাইনি। পেলেই ব্যবস্থা নেব।’’
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)