মাস চারেক আগেও গমগম করত ট্যাংরার অতল শূর রোডের ‘চিত্তনিবাস’। দিদির সঙ্গে রোজ স্কুলে যেত বছর ১৪-র প্রতীপ দে। তার বাড়ি ছিল, গাড়ি ছিল, স্কুল ছিল, বন্ধুবান্ধব ছিল। ছিল বাবা-মা, কাকা-কাকিকে নিয়ে জমজমাট পরিবার। কিন্তু গত ফেব্রুয়ারিতে প্রতীপের জীবন ওলটপালট হয়ে গিয়েছে!
মা, কাকিমা আর দিদির মৃত্যু চোখের সামনে দেখেছে এই কিশোর। খুনের দায়ে এখন জেল খাটছেন তার কাকা। বাবা অবশ্য আছেন, কিন্তু তিনি এখনও হাসপাতালে। দে পরিবারের বিপর্যয়ের পরে আত্মীয়স্বজনেরাও কেউ প্রতীপের দায়িত্ব নিতে এগিয়ে আসেননি। ফলে শিশুকল্যাণ কমিটির সৌজন্যে এখন তার ঠিকানা একটি ‘হোম’। তাদের উদ্যোগেই প্রতীপকে নতুন স্কুলে ভর্তি করানোর বন্দোবস্ত করা হয়েছে। সেখানে নতুন ক্লাসে শুরু হতে চলেছে তার নতুন জীবনযুদ্ধ। কলকাতার শিশুকল্যাণ কমিটির তরফে জানা যাচ্ছে, আগামী সপ্তাহেই নতুন স্কুলে ভর্তি করানো হবে প্রতীপকে। তবে রোজ স্কুলে যাওয়ার জন্য এখনও শারীরিক ভাবে সম্পূর্ণ প্রস্তুত নয় সে। তার জন্য আরও সপ্তাহ দুয়েক সময় লাগবে।
গত ১২ ফেব্রুয়ারি ট্যাংরার বাড়ি থেকে উদ্ধার হয়েছিল প্রতীপের মা রোমি দে, কাকিমা সুদেষ্ণা দে এবং খুড়তুতো দিদি প্রিয়ম্বদার দেহ। অভিযোগ, কাকা প্রসূন ওই তিন জনকে খুন করেন। তিনটি দেহ বাড়িতে রেখে প্রতীপ ও তার বাবা প্রণয়কে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন প্রসূন। ভোরে তাঁদের গাড়ি বাইপাসের ধারে মেট্রোর স্তম্ভে ধাক্কা মারে। দুর্ঘটনায় তিন জনই গুরুতর জখম হন। দীর্ঘ দিন হাসপাতালে ছিলেন তাঁরা। সুস্থ হয়ে ওঠার পরে খুনের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় প্রসূনকে। প্রণয় এখনও পুরোপুরি সুস্থ নন। এনআরএস হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। পুলিশের সন্দেহের তালিকায় নাম আছে তাঁরও।
আরও পড়ুন:
কিশোর প্রতীপ সপ্তাহ দুয়েক আগে হাসপাতাল থেকে ছুটি পেয়ে হোমে গিয়ে উঠেছে।
প্রত্যেক হোমেই শিশুদের ‘কাউন্সেলিং’-এর ব্যবস্থা থাকে। সমবয়সিদের সঙ্গে মিলেমিশে খেলাধূলা করে যাতে তারা নিজেদের সঠিক ভাবে প্রকাশ করতে পারে, তা দেখা হয়। প্রতীপের ক্ষেত্রেও তার অন্যথা হচ্ছে না। ট্যাংরার যে স্কুলে প্রতীপ পড়াশোনা করত, সেখানে সপ্তম শ্রেণির দু’টি পরীক্ষা দেওয়া হয়ে গিয়েছিল তার। পারিবারিক বিপর্যয়ের কারণে বাকি পরীক্ষায় আর বসা হয়নি। তবে যাতে বছরটা নষ্ট না হয়, তার জন্য হোম কর্তৃপক্ষ উদ্যোগী হয়েছিলেন। হোমের বাকি শিশুরা যে স্কুলে পড়ে, প্রতীপকেও সেখানে অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি করানো হচ্ছে। আনন্দবাজার ডট কম-কে স্কুল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, প্রতীপের ক্লাসের পরীক্ষা হয়ে গিয়েছে। নতুন শিক্ষাবর্ষও শুরু হয়েছে। তবে তার ভবিষ্যৎ নিয়ে আর কোনও মন্তব্য করতে চায়নি স্কুল। শিশুকল্যাণ কমিটির চেয়ারপার্সন মহুয়া শূর রায় বলেন, ‘‘প্রতীপের পুরনো স্কুলের সঙ্গে আমাদের কথা হয়ে গিয়েছে। সেখান থেকে ওকে টিসি (ট্রান্সফার সার্টিফিকেট) দিয়ে দেওয়া হবে। আগামী সপ্তাহেই ওকে নতুন স্কুলে ভর্তি করানো হবে। ওর বছর নষ্ট হবে না।’’
এখন কেমন আছে প্রতীপ? মহুয়া বলেন, ‘‘এখন ওকে যেখানে রাখা হয়েছে, সেটি কলকাতা শহরের সেরা হোমগুলির অন্যতম। ওই হোমের শিশুরা যে স্কুলে যায়, সেখানেই প্রতীপকে পাঠানো হচ্ছে। এতে আরও ভাল করে ওর সময় কাটবে। ও নিজেও স্কুলে যেতে চাইছে। কিন্তু রোজ স্কুলে যেতে হয়তো ওর আরও দু’সপ্তাহ সময় লাগবে।’’
প্রতীপের ভবিষ্যৎ কী হবে? তাকে হোমেই থাকতে হবে কি না, এ প্রশ্নে জটিলতা রয়েছে। সূত্রের খবর, একাধিক পরিবার তাকে দত্তক নেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল। কিন্তু প্রতীপ ১৫ ছুঁইছুঁই। তার বাবাও জীবিত। এই পরিস্থিতিতে চাইলেই কাউকে দত্তক নেওয়া যায় না। হোম কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, এখন প্রতীপকে আইনি প্রক্রিয়ায় কেউ দত্তক নিতে চাইলে তাতে তার বাবা প্রণয়ের সম্মতি প্রয়োজন। একই সঙ্গে প্রয়োজন প্রতীপের নিজের সম্মতিও। সে কী চাইছে? মহুয়া বলেন, ‘‘ওর বাবা হাসপাতালে। মা বেঁচে নেই। নিজের বাড়িতে যেতে কে না চায়! কিন্তু ওর কি সেই উপায় আছে? ট্যাংরার ঘটনার সবচেয়ে বড় এবং সম্ভবত একমাত্র ভুক্তভোগী প্রতীপ।’’
হাসপাতাল থেকে আদালতে গিয়ে গোপন জবানবন্দি দিয়ে এসেছিল প্রতীপ। পুলিশকে সে জানিয়েছিল মা, কাকিমা, দিদিকে খুন করেছেন তার কাকা প্রসূন। পরে প্রসূনও খুনের কথা স্বীকার করে নেন বলেই পুলিশের দাবি। জানা গিয়েছে, গলা পর্যন্ত ঋণে ডুবে ছিল ট্যাংরার দে পরিবার। সঙ্কটমুক্তির উপায় না দেখতে পেয়ে সপরিবার তাঁরা আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বলেই প্রাথমিক তদন্তে জেনেছে পুলিশ। এক সপ্তাহ ধরে খেয়েছিলেন বিষ মেশানো পায়েস। কিন্তু তাতে খুব একটা কাজ হয়নি। পরিবারের দুই নাবালক সদস্য প্রতীপ এবং প্রিয়ম্বদাকে আত্মহত্যার পরিকল্পনার বিষয়ে অন্ধকারে রাখা হয়েছিল। খাদ্যে বিষক্রিয়ার ফলে প্রিয়ম্বদার মৃত্যু হয়। প্রতীপ দাবি করেছে,তার মা, কাকিমা আত্মহত্যা করতে না-পারলে কাকা ওই দু’জনের হাতের শিরা এবং গলা কেটে দেন। প্রতীপকেও খুনের চেষ্টা করা হয়েছিল। মুখে চেপে ধরা হয়েছিল বালিশ। তবে কোনও রকমে দমবন্ধ করে থেকে সে আত্মরক্ষা করে। মারা যাওয়ার ভান করে সে যাত্রায় বেঁচে যায় প্রতীপ। পরে তাকে নিয়ে কাকা এবং বাবা বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন এবং তাঁদের গাড়ি দুর্ঘটনার কবলে পড়ে।
তদন্তে প্রতীপের বয়ানও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তার সত্যাসত্য যাচাই করা হচ্ছে। কিন্তু যে সত্যে কোনও ফাঁক নেই, তা হল প্রতীপের জীবনের বাঁক। যে কিশোর দিদির সঙ্গে রোজ স্কুলে যেত, যার বাড়ি ছিল, গাড়ি ছিল, স্কুল ছিল, বন্ধুবান্ধব ছিল। ছিল বাবা-মা, কাকা-কাকিমাকে নিয়ে জমজমাট পরিবার। গত ফেব্রুয়ারিতে যে কিশোরের জীবন ওলটপালট হয়ে গিয়েছে!
প্রতীপ দে। ট্যাংরার ঘটনার সবচেয়ে বড় এবং সম্ভবত একমাত্র ভুক্তভোগী। বয়স ১৪। সামনে পড়ে আছে একটা গোটা জীবন।