Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
Valentines Day

ভালবাসা অভ্যন্তরীণ ব্যাপার, বলছে ছক-ভাঙা জুটিরা

পাশে দাঁড়িয়ে তখন একদৃষ্টে সুস্মিতাকে দেখছেন তাঁর সঙ্গী সুপর্ণা তথা আদিত্য কর্মকার।

নির্ভয়: হাসি-আড্ডায় অন্তরঙ্গ (বাঁ দিক থেকে) রবি, বিনন্দন, আদিত্য (সুপর্ণা), সুস্মিতা।

নির্ভয়: হাসি-আড্ডায় অন্তরঙ্গ (বাঁ দিক থেকে) রবি, বিনন্দন, আদিত্য (সুপর্ণা), সুস্মিতা। শনিবার, দক্ষিণ কলকাতার একটি হোটেলের অনুষ্ঠানে। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী

ঋজু বসু
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ০৭:১৮
Share: Save:

‘‘কে, কাকে ভালবাসবেন, সেটা একান্তই তাঁদের ব্যাপার। দু’জনের অভ্যন্তরীণ বিষয়ও বলতে পারেন।’’ শনিবার প্রাক্-ভ্যালেন্টাইন্স ডে সন্ধ্যায় মঞ্চে দাঁড়িয়ে হাসছিলেন আধা শহরতলির মেয়ে সুস্মিতা দাস। একটু থেমে তিনি বললেন, ‘‘জাত, ধর্ম, লিঙ্গ নয়। ভালবাসার মাপকাঠি শুধু ভালবাসাই!’’

পাশে দাঁড়িয়ে তখন একদৃষ্টে সুস্মিতাকে দেখছেন তাঁর সঙ্গী সুপর্ণা তথা আদিত্য কর্মকার। সুস্মিতা পরে বলছিলেন, ‘‘ভালবাসার এই মানেটা এক দিনে বুঝিনি। ভীষণ কম বয়সে বাড়ির চাপে খুব খারাপ একটা বিয়ে হয়েছিল আমার। মারধর খেয়ে সম্পর্কটা থেকে বেরিয়ে আসার সময়েই ও আমার পাশে দাঁড়াল।’’ ‘ও’ মানে স্কুলের পুরনো ‘সহপাঠিনী’ সুপর্ণা। দু’জনের সম্পর্কটা যে ঠিক আর পাঁচ জন বান্ধবীর মতো নয়, তা ক্রমশ বুঝলেন দু’জনেই। আর নিজেকে অন্য ভাবে আবিষ্কার করলেন সুস্মিতা।

সুপর্ণা তথা আদিত্যও বলছিলেন, ‘‘স্কুলে মেয়েদের পোশাক পরে যেতে হত বলে পড়াশোনা চালাতে পারিনি। সুস্মিতাকে তখন থেকেই ভাল লাগত।’’ আদিত্য হয়ে ওঠার জন্য অস্ত্রোপচার করাতে ইচ্ছুক সুপর্ণা। সুস্মিতা লাজুক হাসছেন, ‘‘সেটা কিন্তু ওরই ইচ্ছে। আমার কাছে ও যেমন, তেমনই সুন্দর!’’ কলকাতার উপকণ্ঠে চিলতে সংসারে ঘর সাজানোর সামগ্রী, ডিজ়াইনার গয়না তৈরি করেই দিন কাটছে দু’জনের।

উত্তর শহরতলির সমকামী পুরুষ জুটি রবি-বিনন্দন কিংবা শহরের ভিন্ ধর্মের দম্পতি সঞ্জনা ও হাবিবরাও মিলে গেলেন এক ছাদের নীচের উদ্‌যাপনে। ছক-ভাঙা এই ভালবাসার আসরে এসে লোপামুদ্রা মিত্র বলছিলেন, ‘‘আমরা মানুষকে আকছার ধর্ম, জাত, ফর্সা, কালো কিংবা উদ্ভট সব দিক দিয়ে বিচার করি। একটা মানুষের নিজের ইচ্ছে মতো যাঁকে খুশি ভালবাসার, নিজের মতো থাকার অধিকার আছে।’’ এই শহরের ছক-ভাঙা জুটি, বিশেষত সমকামী দম্পতিদের জন্য ভালবাসাবাসি বা সহযাপন ব্যাপারটা মোটেও সহজ ছিল না কিছু দিন আগেও। মূলত শহরের পার্কে আবডালে দেখা হত তাঁদের। ২০২১-এ কি এই ছবিটা পাল্টেছে? ‘‘সুপ্রিম কোর্টের ৩৭৭ ধারা নিয়ে রায়ের পরে ভারতে সমকামী সম্পর্ক আর অপরাধ নয়। তা-ও এই ধরনের জুটিদের অনেকেই বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হন। তাই লড়াইচলছেই,’’ বলছিলেন অভিনব ‘রেনবো স্প্রিং ফেস্টিভ্যাল’-এর উদ্যোক্তা বাপ্পাদিত্য মুখোপাধ্যায়। দেশের নানা প্রান্তে ‘লাভ-জিহাদের’ চোখরাঙানির দিনে ভিন্ ধর্মের জুটিদেরও ডেকেছেন তাঁরা। এমনই এক দম্পতির এক জন সঞ্জনাও মঞ্চে বললেন, ‘‘আমাকেও ছোটবেলায় বাড়িতে শুনতে হয়েছিল, যাকে ইচ্ছে বিয়ে করিস, মুসলিম না হলেই হল! কিন্তু ভালবাসা আবার অতশত দেখে না!’’

ভালবাসার অন্য রকম রঙের কথা বলছিলেন গিরিশ পার্কের বাসিন্দা স্বপ্না কর্মকারও। আট বছরের মেয়ের মায়ের চোখে তাঁর স্বামী রাজকুমারই স্বপ্নের পুরুষ। স্বপ্নার মা থাকতেন হাওড়ার ডোমজুড়ের যৌনপল্লিতে। লোকের বাড়ি কাজ করতে করতে মুক্ত বিদ্যালয় পাশ করেন তিনি। স্বপ্নার কথায়, ‘‘আমি তখনও মাধ্যমিক পাশ করিনি। লোকের বাড়ি কাজ করি। তবু আমার বিষয়ে সব জেনেই রাজকুমার আমাকে ভালবেসেছিল।’’ এখন স্নাতক স্বপ্না নিজেও মেয়েদের ক্ষমতায়নের কাজের শরিক একটি সংস্থার দায়িত্ব নিয়েছেন।

ভালবাসা বা বন্ধুত্ব, কোনও কিছুই যে প্রথাগত নারী-পুরুষের ছকে বন্দি নয়, সেই বার্তাই ছড়িয়ে গেল এ দিনের অনুষ্ঠানে। সকালে প্রায় ৩০টি জুটিকে নিয়ে চলল ‘ব্লাইন্ড ডেটিং’-এর কর্মশালা। ডেটিং বলতে যা বোঝায়, তা নয়! আসলে বন্ধুত্বই! টিটাগড়ের সাবির আর মধ্যমগ্রামের রূপান্তরকামী নারী দেবজিতের মধ্যে ভাব হল এখানেই। লটারির ঢঙেই পরস্পরকে জানার জন্য লিঙ্গ, ধর্ম, যৌন ঝোঁক— কোনও কিছুই না-দেখে দু’জনকে পাশাপাশি বসানো হয়েছিল। নিজেকে পুরুষ বা মেয়ে কিছুই বলতে না-চাওয়া ‘নন-বাইনারি’ ব্যক্তি ‘অপর্ণা’র সঙ্গে আলাপ হয়ে বিস্মিত এক বিসমকামী যুবক। ‘‘দাঁড়া, তোকে আমি একটা ঘড়ি উপহার দেব। সময়টা যে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে না, সারা ক্ষণ পাল্টায়, এটা তার চিহ্ন!’’ — আলাপ শেষে তাঁকে বললেন অপর্ণা।

(কয়েকটি নাম পরিবর্তিত)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

love Valentines Day
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE