Advertisement
E-Paper

‘বস’কে সিটটা দেবই, বলছেন মহুয়া, বিজেপির ভরসা শাসকের ‘পঞ্চায়েত ভোট দৌরাত্ম্য’

পঞ্চায়েত নির্বাচনে ভোট দিতে না পারার পাশাপাশি শাসক দলের বিরুদ্ধে কৃষ্ণনগরের আরও একটা ক্ষোভের কারণ বললেন শান্তনু ঝা।

উজ্জ্বল চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০১৯ ২১:১৩
ভোটের আগে সরগরম কৃষ্ণনগর।

ভোটের আগে সরগরম কৃষ্ণনগর।

পঞ্চায়েত নির্বাচনের পর নদিয়ার চার দিক কার্যত সবুজ রঙে ছেয়ে গিয়েছিল। তৃপ্তির হাসি হেসেছিল শাসকদল। সেটাই এখন সবচেয়ে মাথা ব্যথার কারণ হয়েছে তৃণমূলের। কারণ, চাপড়া থেকে পলাশিপাড়া, কালিগঞ্জ হোক বা তেহট্ট— অধিকাংশ জায়গাতেই সাধারণ মানুষ মনে করিয়ে দিচ্ছেন সেই আপাত সবুজের নেপথ্যে বিপুল দৌরাত্ম্যের কথা।

ভোটটাই তো দিতে দিল না’, ‘বুথে যাওয়ার আগেই ফিরিয়ে দিল’, ‘বাড়ি থেকে বেরতেই বারণ করে দিয়েছিল’— হ্যাঁ, এ বারের ভোট নিয়ে কথা বলতে গেলেই মুখের উপর সপাটে বলে দিচ্ছেন এই সব সংলাপ। বোঝা গেল, পঞ্চায়েত নির্বাচন এখনও ক্ষত রেখে গিয়েছে। চাপড়ার ন’মাইলের দোকানে বসে জাকির আলি যেমন বলেই দিলেন, ‘‘ভোটটা তো ওদেরই দিতাম। তা-ও বিশ্বাস করতি পারল না।’’ কারা ভোট দিতে দিল না? কারাই বা বিশ্বাস করতে পারল না? সব জায়গাতেই আঙুল শাসক দলের দিকে।

তবে, এ সব নিয়ে মোটেও ‘টেনশন’-এ নেই কৃষ্ণনগরের তৃণমূল প্রার্থী মহুয়া মৈত্র। জেতার ব্যাপারে তিনি সম্পূর্ণ নিশ্চিত। ভোট আগামী সোমবার। প্রচারের কাজ শনিবার শেষ হবে। জানালেন, এই আসন ভাল ব্যবধানে জিতে ‘বস’কে দেবেনই। হ্যাঁ, আবডালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ‘বস’ বলেই সম্বোধন করেন। সামনাসামনি যদিও ‘দিদি’।কৃষ্ণনগর লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে যে ৭টি বিধানসভা,তার ৮২টি পঞ্চায়েত এলাকাই মহুয়ার ঘোরা হয়ে গিয়েছে আগেই। মিছিল, রোড শো— তিনি পৌঁছেছেন মানুষের কাছে। ঘুরেছেন এই কেন্দ্রের একমাত্র পুরসভা কৃষ্ণনগরের সব ক’টি ওয়ার্ডও। সাধারণ মানুষ কী বলছেন? সাতসকালে তাঁর কৃষ্ণনগর পোস্ট অফিস রোডের বাড়িতে বসে মহুয়া চওড়া হেসে বললেন, ‘‘চাওয়া-পাওয়ার কথা বলছেন। আদর করছেন। ভালবাসা দিচ্ছেন। কেউ বলছেন, মা তুমি এসেছ এটাই অনেক। কেউ আবার, ঘরটা দেইখ্যা যাও। রাস্তাটা কইর‌্যা দাও তার পর ভোট দিব, বলছেন।’’ একটু থেমে,‘‘আসলে ওঁদের রাগটাও তো বুঝতে হবে।’’

‘‘রাগ তো অন্য কারণে,’’— বলছেন সিপিএম প্রার্থী শান্তনু ঝা। পলাশিপাড়া বাজারের পাশের মাঠে তাঁর সভা। লোকজন হয়েছে। কিন্তু বড় মাঠ তখন অর্ধেকও ভরেনি। মাঠের মধ্যে বসেই বললেন, ‘‘এটা সব অর্থেই তৃণমূলের সর্বনাশের নির্বাচন।’’ জানতে চাওয়া গেল, কেন? কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শান্তনু বললেন, ‘‘গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে গণতান্ত্রিক অধিকারে হস্তক্ষেপ হয়েছে। মানুষ সেটা প্রত্যাখ্যান করেছে। মানুষের উপরে আক্রমণটা সর্বমুখী। আর সেই রাগটাই টের পাবে এ বার তৃণমূল।’’

চাপড়ার কৃষক ইমতিয়াজ হোসেন এটাকে রাগ বলতে নারাজ। তিনি তৃণমূলকেই সমর্থন করেন। বললেন, ‘‘এটা ঠিক রাগ নয়। কিছু জায়গায় লোকের খারাপ লেগেছে। সেই খারাপ লাগাটা চলেও গেছে। এ বারের ভোটটা তো আর পঞ্চায়েতের নয়, লোকসভার। এখন ও সব মনে রাখলে চলবে না।’’ তার পাশে বসে শেখ আবদুল যদিও তখন হাসছেন। বার বার জিজ্ঞেস করেও সে হাসির কারণ জানা গেল না। কৃষ্ণনগরের সংখ্যালঘু ভোট ৩৫ শতাংশের কাছাকাছি। তৃণমূল সেই ভোটের ভরসাতেই জেতার কথা ভাবছে। কারণ তারা ধরেই নিয়েছে, সংখ্যালঘু ভোট কোনও ভাবেই বিজেপিতে যাবে না। আবার সিপিএমের দাবি, তৃণমূল যে সংখ্যালঘু ভোটের ভরসায় বসে আছে, এ বার সেটা তারাই পাবে।

সংখ্যালঘু ভোট তা হলে কোন দিকে যাবে? সরাসরি এ প্রশ্নের জবাব দিলেন না বেতাইয়ের আকবর আলি। তবে তাঁর কথাবার্তায় একটা আভাস পাওয়া যায়। আর সেই আভাসে বোঝা যায়, তৃণমূলের দাবি খুব একটা অন্যায্য না হলেও, একটা অংশ সিপিএম এবং কংগ্রেসকেও ভোট দেবেন। কংগ্রেসের প্রার্থী ইনতাজ আলি শেখও সেই ভরসাতে আছেন।

প্রচারে বেরিয়েছেন তৃণমূল প্রার্থী মহুয়া মৈত্র। —নিজস্ব চিত্র।

পঞ্চায়েত নির্বাচনে ভোট দিতে না পারার পাশাপাশি শাসক দলের বিরুদ্ধে কৃষ্ণনগরের আরও একটা ক্ষোভের কারণ বললেন শান্তনু ঝা। এই এলাকার একটা বড় অংশের মানুষ চিটফান্ডে টাকা খুইয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘‘চিটফান্ডের টাকা তো লুঠ হয়েছিল। কৃষ্ণনগরের গত দু’বারের সাংসদ তৃণমূলের তাপস পাল। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি একটি চিটফান্ড কোম্পানির কাছ থেকে বাড়তি সুবিধা গ্রহণ করেছেন। অর্থাৎ, ওই লুঠের টাকার ভাগ পেয়েছেন। মানুষ সেই দলকে আর ভোট দেবে না।’’ সঙ্গে কিন্তু তিনি আরও একটা বাক্য জুড়লেন, ‘‘যদি এ বার ওরা ভোট দিতে দেয়!’’

জাতীয় দলের প্রাক্তন ফুটবলার কল্যাণ চৌবে এই কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থী। তিনিও সেই ‘ভোট দিতে পারা’র প্রসঙ্গই তুললেন। বললেন, ‘‘বিজেপির ভাল হাওয়া। মানুষ চাইছেন ভোট দিতে। কিন্তু ভোট দিতে পারবেন কি না,সেটা নিয়ে একটা কিন্তু রয়েছে।’’ কল্যাণের কথায়, ‘‘যে ভাবে পঞ্চায়েত নির্বাচনে একটা সন্ত্রাস হয়েছে, অত্যাচার হয়েছে— আশঙ্কা করা হচ্ছে এ বারের নির্বাচনেও কৃষ্ণনগরে তেমনটাই হবে। সাধারণ মানুষ একটু ভীত। তাঁদেরকে ভয় দেখানো হচ্ছে। বলা হচ্ছে, গ্রাম থেকে বেরনোর দরকার নেই।’’

গ্রামে গ্রামে ঘুরছেন বিজেপি প্রার্থী কল্যাণ চৌবে। —নিজস্ব চিত্র।

কল্যাণ কি তা হলে সে সবে ভয় পেয়ে গেলেন? প্রশ্নটা শুনে সামান্য হাসলেন, ‘‘নিজেকে নিয়ে ভয় নয়। আমার ভয় সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিয়ে।পঞ্চায়েত নির্বাচনে প্রচুর মানুষ আক্রান্ত হয়েছিলেন। মারাও গিয়েছিলেন কয়েক জন। নির্বাচনে অশান্তিকে কেন্দ্র করে কারও প্রাণ যাক, এটা চাই না।’’ যদিও প্রচারে গিয়ে কল্যাণ মানুষকে ভয় পেতে বারণ করছেন। বুথ অবধি পৌঁছতে বলছেন। মানুষকে নিজের ভোট নিজেকে দিতে বলছেন। কেন্দ্রীয় বাহিনীর ভরসার কথা শোনাচ্ছেন। তার পরেও তাঁর অভিযোগ, ‘‘গ্রামবাসীদের ভয় দেখানো হচ্ছে। বলা হচ্ছে, কেন্দ্রীয় বাহিনী তো ২৯ তারিখের পর চলে যাবে, তখন কী হবে? যদিও সব কিছুর শেষে আমরাই জিতব।’’

আরও পড়ুন: মহুয়ার নামে অশালীন মন্তব্য, ৪৮ ঘণ্টার নিষেধাজ্ঞা বিজেপি নেতার উপর​

খেলোয়াড় হিসেবে কল্যাণের বিপুল পরিচিতি। রাজনীতির উঠোনে সদ্য পা ফেলা সেই কল্যাণকে কৃষ্ণনগরে প্রার্থী করার পর স্থানীয় বিজেপির অন্দরে একটু অসন্তোষ তৈরি হয়। কারণ, এই কেন্দ্র থেকে ১৯৯৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে এনডিএ জোটের বিজেপি প্রার্থী ছিলেন সত্যব্রত মুখোপাধ্যায় (জলু)। তিনি জিতেছিলেন। ২০১৪-র নির্বাচনেও তিনি ভালই ভোট পেয়েছিলেন। স্থানীয় বিজেপি নেতাদের যুক্তি ছিল, জলুবাবুকে প্রার্থী করলে বিজেপির জেতাটা আরও নিশ্চিত হতে পারে। কয়েক দিনের মধ্যে যদিও রাজ্য বিজেপি সেই অসন্তোষ নিভিয়ে ফেলতে সমর্থ হয়।

দলীয় কর্মীদের নিয়ে গোটা কেন্দ্র কার্যত চষে ফেলেছেন কল্যাণ। বিজেপি কর্মীদের পাশাপাশি তাঁর সঙ্গে ঘুরছেন সংঘ পরিবারের সদস্যরাও। উত্তরপ্রদেশের মুজফ্‌ফরনগর থেকে এসেছেন বছর তেইশের হেমু বিক্রমাদিত্য।তিনি জানালেন, গোটা কৃষ্ণনগর কেন্দ্রে তাঁর মতো অনেক যুবকই কল্যাণের হয়ে কাজ করতে এসেছেন। তাঁরা মানুষের সঙ্গে কথা বলছেন। বিজেপির ‘বিচারধারা’ বোঝাচ্ছেন। বুথ পর্যন্ত পৌঁছনোর কথা বলছেন। কিন্তু ভাষা সমস্যা হচ্ছে না? হাসিতে জবাব দিলেন, ‘‘খুবই সামান্য।’’

দলীয় কর্মীদের সঙ্গে ভোট প্রচারে বাম প্রার্থী শান্তনু ঝা। —নিজস্ব চিত্র।

কৃষ্ণনগর ঘুরলে বোঝা যায়, পদ্মফুলের একটা হাওয়া যেন ঘুরপাক খাচ্ছে। শহরের বাসিন্দা অমর বাগচী যেমন বলছেন, ‘‘এমনিতেই কৃষ্ণনগরে বিজেপির একটা পুরনো প্রভাব রয়েছে। সাম্প্রতিক কালে বিজেপি যথেষ্ট শক্তিবৃদ্ধি করেছে। আর ফিকে হয়ে যাচ্ছে বামেরা। গোটা কেন্দ্রতে তাই বিজেপির হাওয়া। আর সঙ্গে জুড়েছে পঞ্চায়েতে ভোট না দিতে পারার ক্ষোভ। সব মিলিয়ে পরিস্থিতিটা এমনই। ভোটটা এখা‌নে তৃণমূল বনাম বিজেপিই হচ্ছে। তবে, শাসকদলের একটা অ্যাডভান্টেজ তো থাকেই।’’

মহুয়া কিন্তু তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে কল্যাণের কথা ভাবতেই চাইছেন না। তিনি বরং এগিয়ে রাখছেন শান্তনুকে। বলছেন, ‘‘এই কেন্দ্রে শেষ দুটো ভোটে সিপিএম ভাল ভোট টেনেছে। গত বার তো ৩ লাখ ৮০ হাজার ভোট পায়। প্রার্থীও খুব যোগ্য। পিএইচডি, সংযত, এডুকেটেড, ভদ্রলোক একেবারে। তাঁকে কোনও ভাবে অগ্রাহ্য করতে পারি না।’’ তৃণমূল তাঁকে গুরুত্ব দিতে না চাইলেও কল্যাণ কিন্তু বলছেন, ‘‘আমরা এটাকে প্রতিষ্ঠানবিরোধী ভোট হিসেবে দেখছি। প্রতিষ্ঠানে যে হেতু তৃণমূল সরকার রয়েছে, আমাদের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী তাই তৃণমূল।’’

পায়ে পায়ে প্রচারে কংগ্রেস প্রার্থী ইনতাজ আলি শাহ। —নিজস্ব চিত্র।

আর তৃণমূল যাঁকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবছে সেই শান্তনু ঝা বলছেন, ‘‘শেষ লোকসভা নির্বাচনে এখানকার বিজেপি প্রার্থী ২৩ শতাংশের কাছাকাছি ভোট পেয়েছিলেন। কিন্তু ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির সেই ভোট শতাংশ ১০-এর নীচে নেমে যায়। অর্থাৎ বিজেপির নির্দিষ্ট কোনও ভোট নেই। ভোটটা যাতায়াত করছে। বিজেপির কোনও সম্ভাবনা নেই। ফল পুরোপুরি বামেদের পক্ষেই আসবে।’’

আরও পড়ুন: গম্ভীরের ২টি ভোটার কার্ড! ফৌজদারি মামলা আপ প্রার্থীর​

রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা যদিও এত সবের মধ্যে বিজেপির লাভের সম্ভাবনাই দেখছেন। তাঁদের মতে, তৃণমূল, সিপিএম এবং কংগ্রেসের মধ্যে ভোট কাটাকুটির ফল পেতে পারে বিজেপি। যদিও এই সমীকরণের গোটাটাই ঘেঁটে দিতে পারে সংখ্যালঘু ভোট। সেই ভোট যদি তৃণমূলে অটুট থাকে, তা হলে মহুয়ার হাসি আরও চওড়া হবে। কিন্তু এখানেই বাধ সেধেছে কংগ্রেস ও সিপিএম। কংগ্রেস তো আবার সংখ্যালঘু মুখকে প্রার্থী করে ভোটে নেমেছে। সেই প্রার্থী ইনতাজ আলি যদিও এত হিসেবে যেতে নারাজ। তাঁর কথায়, “সকলে যাতে ভোট দিতে পারে, তার অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি করতে হবে।”

আর রাজনৈতিক এই সব সমীকরণের কথা শুনে মহুয়া শুধু বলছেন ‘‘করিমপুর জিতেছিলাম। এ বার কৃষ্ণনগরও জিতব।’’

Lok Sabha Election 2019 Krishnanagar Trinamool BJP CPM Mahua Moitra Mamata Banerjee
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy