রাতের অন্ধকারে মালগাড়িতে ধাক্কা মেরেছিল করমণ্ডল এক্সপ্রেস। গত শুক্রবার ওড়িশার বাহানাগার ওই দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা ৩০০ ছুঁইছুই। মৃতদের মধ্যে রয়েছে পূর্ব মেদিনীপুরের একাধিক বাসিন্দা। আর এই ভয়াবহ দুর্ঘটনা জেলার বহু প্রবীণ বাসিন্দাকে মনে করাচ্ছে এই জেলার আরেক ভায়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনার কথা। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ওই দুর্ঘটনায় রূপনারায়ণের জলও মৃতদের রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিল। মারা গিয়েছেন কমপক্ষে ৪০০ জন যাত্রী।
দিনটা ছিল ১৯৪৮ সালের ১৪ অক্টোবর। কোলাঘাটের ইলিশের স্বাদ সে সময় ছিল জগৎজোড়া। শোনা যায়, পরাধীন ভারতে বহু ভারতীয় কোলাঘাটের ইলিশ খাইয়ে সাহেবদের তোষামোদ করতেন। মাছ অন্যত্র রফতানির জন্য কোলাঘাট রেল স্টেশনে নিয়মিত ট্রেন থামনো হতো। এর জন্য অতিরিক্ত সময় বরাদ্দ করে রাখা হতো নির্দিষ্ট কিছু ট্রেনের জন্য। তখন রূপনারায়ণ নদের উপর দুই দিক খোলা রেলের দু'টি সেতুও ছিল।
১৯৪৮ সালের ১৪ অক্টোবরের দুর্ঘটনার রাতে তুমুল বৃষ্টি হচ্ছিল। তা চলছিল কয়েক দিন ধরেই। বৃষ্টির জেরে রূপনারায়ণের গাঙে জেলেদের জালে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ছিল। রাত ৯ টা নাগাদ হাওড়া থেকে ছেড়ে পুরুলিয়া এক্সপ্রেস এসে থামে কোলাঘাট স্টেশনে। ট্রেনে তখন ইলিশের ঝাঁকা তোলা চলছিল। হঠাৎই একই লাইনে এসে পড়ে হাওড়াগামী নাগপুর এক্সপ্রেস। প্রচণ্ড গতিতে পুরুলিয়া এক্সপ্রেসের ইঞ্জিনে ধাক্কা মারে সেটি। দুমড়ে মুচড়ে যায় দু'টি ট্রেনের একাধিক কামরা।রেল স্টেশন চত্বর এবং কোলাঘাটের পাড়ে ছড়িয়ে পড়ে অসংখ্য মৃতদেহ। 'কোলাঘাট সম্পদ' নামে স্থানীয় একটি পত্রিকা থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, ওই ট্রেন দুর্ঘটনায় প্রায় ৪০০ জনের মৃত্যু হয়েছিল। আহত হয়েছিলেন এক হাজারেরও বেশি মানুষ। রক্তে ভেসে গিয়েছিল রূপনারায়ণের পাড় এবং জল। দুর্ঘটনার সুযোগ নিয়ে সে সময় দুর্ঘটনাগ্রস্ত ট্রেন দু'টিতে ব্যাপক লুঠপাঠও চলেছিল বলে অভিযোগ। তখন কোলাঘাট ছিল পাঁশকুড়া থানার অধীন। পরের দিন পাঁশকুড়া থানার পুলিশ এসে দেহগুলি উদ্ধার করে ময়নাতদন্তে পাঠায়। রেলের উদ্যোগে বহু দেহ কোলাঘাট স্টেশনের নীচে রেলের কাঠের পুরনো স্লিপার দিয়ে দাহ করা হয়েছিল।
এবার করমণ্ডল এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনায় কোলাঘাটের দু'জন পরিযায়ী শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। নিখোঁজ রয়েছেন একজন। আহত একাধিক। করমণ্ডল দুর্ঘটনার ভয়াবহতার সঙ্গে সেদিনের দুর্ঘটনার মিল খুঁজে পাচ্ছেন কোলাঘাটের প্রবীণ নাগরিকেরা। মহাদেব সেনগুপ্ত নামে কোলাঘাটের এক সমাজসেবী বলেন, "সেদিনের দুর্ঘটনার পর একাধিক গাড়িতে করে পুলিশ মৃতদেহ বয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। সে ছবি এখনও আমার চোখে ভাসছে। করমণ্ডল দুর্ঘটনার মতোই ভয়াবহ ছিল স্বাধীন ভারতের প্রথম বড় রেল দুর্ঘটনা।’’ কোলাঘাটের বাসিন্দা বাগনান কলেজের প্রাক্তন অধ্যাপক জয়মোহন পাল বলেন, "সেদিন বৃষ্টির জন্য কোলাঘাটে জেলেদের জালে টনটন ইলিশ উঠছিল।মাছ তোলার জন্য ট্রেন অতিরক্ত সময় ধরে দাঁড়িয়েছিল। সম্ভবত ভুল সিগন্যালের জন্যই দুর্ঘটনা ঘটেছিল। প্রায় ৪০০ জন মানুষ সেদিনের দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছিলেন।’’
করমণ্ডল এক্সপ্রেস দুর্ঘটনার পর এক শ্রেণির মানুষের বিরুদ্ধে হতভাগ্য রেলযাত্রীদের জিনিসপত্র চুরি করার অভিযোগ উঠেছে। সেদিনও কোলাঘাটে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছিল বলে অভিযোগ। রেল দুর্ঘটনায় লুঠপাঠের টাকায় বেশ কিছু লোক রাতারাতি বহু টাকা উপার্জন করেছিলেন বলে শোনা যায়। অসীম দাস নামে কোলাঘাটের এক সমাজসেবী বলেন, "ট্রেন দুর্ঘটনার পর মানুষের অসহায়তার সুযোগ এক শ্রেণির অসাধু মানুষ লুঠপাঠ চালায়। কোলাঘাটে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছিল বলে জনশ্রুতি রয়েছে।’’
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)