Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

বিচার চেয়ে চরকিপাক

আইনজীবীরা দাবি করছেন, বিচারপ্রার্থীদের স্বার্থেই তাঁদের কর্মবিরতি। তবে বেশিরভাগ বিচারপ্রার্থী এই দাবি মানছেন না। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক বিচারপ্রার্থীর কথায়, ‘‘কর্মবিরতিতে কোনও সুরাহা হয় না।

অপেক্ষা: মেদিনীপুর আদালত চত্বরে বসে রয়েছেন বিচারপ্রার্থীরা। বুধবার। ছবি: সৌমেশ্বর মণ্ডল

অপেক্ষা: মেদিনীপুর আদালত চত্বরে বসে রয়েছেন বিচারপ্রার্থীরা। বুধবার। ছবি: সৌমেশ্বর মণ্ডল

নিজস্ব সংবাদদাতা
মেদিনীপুর শেষ আপডেট: ১৮ জুলাই ২০১৯ ০০:১৮
Share: Save:

তিন মাসে দু’দফায় এখনও পর্যন্ত পাঁচ সপ্তাহ। এটা মেদিনীপুর আদালতে আইনজীবীদের কর্মবিরতির হিসেব!

আইনজীবীরা দাবি করছেন, বিচারপ্রার্থীদের স্বার্থেই তাঁদের কর্মবিরতি। তবে বেশিরভাগ বিচারপ্রার্থী এই দাবি মানছেন না। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক বিচারপ্রার্থীর কথায়, ‘‘কর্মবিরতিতে কোনও সুরাহা হয় না। বিচার বন্ধ থাকলে আদালতে আরও বেশি করে মামলা জমে। বিচারপ্রার্থীরা আরও বেশি সমস্যায় পড়েন।’’ বুধবার দুপুরে এক বিচারপ্রার্থীর ক্ষোভ, ‘‘বাসে করে জেলা আদালতে এসেছিলাম। কাজ হল না। আবার বাসে চেপেই বাড়ি ফিরে যেতে হবে। টাকা যেমন খরচ হল, তেমন দিনটাও পণ্ড হয়ে গেল!’’

হাওড়া আদালতের কিছু আইনজীবী আক্রান্ত হয়েছেন, এই অভিযোগে গত মে মাসে গোটা রাজ্যে কর্মবিরতির ডাক দিয়েছিলেন আইনজীবীরা। মেদিনীপুরেও সেই কর্মবিরতি হয়। তখন সপ্তাহ তিনেক ধরে কর্মবিরতি চলে। জুলাইয়ের গোড়া থেকে ফের মেদিনীপুর আদালতে আইনজীবীদের কর্মবিরতি শুরু হয়েছে। দু’সপ্তাহ পেরিয়ে তা এখনও চলছে। এরমধ্যে একদিন আদালতের সামনে অবরোধও করেছিলেন আইনজীবীরা। অবরোধের জেরে ওই দিন মেদিনীপুরের জেলা ও দায়রা বিচারক অনন্যা বন্দ্যোপাধ্যায় সহ অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা বিচারকেরা আদালতে ঢুকতে পারেননি। আন্দোলনরত আইনজীবীদের দাবি, খড়্গপুরে অবৈজ্ঞানিক ভাবে নতুন আদালত চালু করার চেষ্টা হচ্ছে। ইতিমধ্যে আইনমন্ত্রী মলয় ঘটক থেকে জেলাশাসক রশ্মি কমল, জেলা পুলিশ সুপার দীনেশ কুমারের কাছে নিজেদের আট দফা দাবিও জানিয়েছেন তাঁরা।

অবস্থা এমনই যে রোদে তেতে পুড়ে কিংবা ঝড়- জলে ভিজে বিচার চাইতে আসা বিচারপ্রার্থীরা বুঝতেই পারছেন না, আদালত কবে আবার স্বাভাবিক হবে! কর্মবিরতির ফলে আদালতে মামলার পাহাড় জমছে। অনেক মামলার রায় ঘোষণা স্থগিত হয়ে যাচ্ছে। গ্রেফতার হওয়া অভিযুক্তরা জামিনও পাচ্ছেন না। শুধু যে জামিনের আবেদন (বেল মুভ) জানানো যাচ্ছে না তা নয়, আগাম জামিন, সিভিল- ক্রিমিন্যালের মতো মোকদ্দমার ফাইল, এফিডেভিট- সব ফাইলবন্দি হয়ে যাচ্ছে।

বুধবার দুপুরে আদালত চত্বরে গিয়ে দেখা গেল, স্বাভাবিক দিনের চেনা সেই থিকথিকে ভিড় উধাও। আদালতের কাজকর্ম প্রায় বন্ধ। আইনজীবীদের বেশিরভাগ সেরেস্তা খাঁ খাঁ করছে। আইনজীবীরা কাজ বন্ধ রাখায় বিচারপ্রার্থী, করণিক, টাইপিস্টরা যেমন সমস্যায় পড়েছেন, তেমনই সমস্যায় পড়েছেন আদালত চত্বরের ছোট হোটেল বা খাবারের দোকানের মালিকেরাও। যে খাবারের দোকানগুলিতে অন্য দিন বসার ঠাঁই মেলে না, সেগুলিও প্রায় বন্ধ।

চারপাশে ঘুরে দেখা মিলল কিছু অসহায় মুখের। যেমন মিনতি অধিকারী। বেলদার পাতলির বাসিন্দা মিনতি দুর্ঘটনাজনিত এক মামলার কাজে মেদিনীপুরে এসেছিলেন। মিনতির ক্ষোভ, ‘‘শুনছি এখন মামলার শুনানি বন্ধ রয়েছে। আইনজীবীরা কাজ করছেন না। কবে আবার শুনানি শুরু হবে তাও বুঝতে পারছি না।’’ তাঁর এক পরিচিত বলছিলেন, ‘‘একটি দিন পিছিয়ে যাওয়া মানে আরও কত মাস যে পিছিয়ে গেল, কে জানে!’’ বুধবার বিকেলে এক পেশকার বলছিলেন, ‘‘বিচারক সাহেব এজলাসে বসেছিলেন। আইনজীবীরা না থাকায় মামলার নথিতে সইসাবুদ সেরে চেম্বারে ফিরে গিয়েছেন।’’

তবে এত কিছুর পরেও বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তির কথা সরাসরি মানতে চাইছেন না মেদিনীপুর বার অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক মৃণাল চৌধুরী। তাঁর দাবি, আইনজীবীরা ইতিমধ্যে তাঁদের মক্কেলদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করে কর্মবিরতির বিষয়টি জানিয়ে দিয়েছেন। মৃণাল বলেন, ‘‘কর্মবিরতিটা আসলে প্রতিবাদ। এটাও ঠিক যে, বিচারপ্রার্থীরা সমস্যায় পড়ছেন। কিন্তু, তাঁদের স্বার্থেই আমাদের এই প্রতিবাদ-আন্দোলন। ১৯৯৭ সাল থেকে আমাদের এই আন্দোলন চলছে। ন্যায্য দাবিতেই আমরা আন্দোলন করছি।’’ গত কয়েক দিনের মতো এদিনও আদালত চত্বরে মিছিল করেছেন আইনজীবীরা। মিছিল থেকে স্লোগান উঠেছে, ‘আমাদের দাবি ন্যায্য দাবি, এই দাবি মানতে হবে।’

অসহায় মুখে বসে থেকে সেই স্লোগান শুনে এক বিচারপ্রার্থী বিড়বিড় করে ওঠেন, ‘‘বিচারের বাণী সত্যিই নীরবে কাঁদে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Justice Lawyer Protest Midnapore Court
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE