Advertisement
০২ মে ২০২৪
International Women's Day Special

ঘরে ফিরলেও মেনে নেয় না সমাজ, পাচারের পর উদ্ধার হওয়া মেয়েদের নাছোড় লড়াই যেন থেমেও থামে না

মুর্শিদাবাদ জেলা নারী পাচারের ক্ষেত্রে বিপজ্জনক সারণিতে রয়েছে। সেখানে কোনও মহিলা পাচার হয়ে যাওয়ার পর নিজের চেষ্টায় গ্রামে ফিরলে তাঁকে আবার গ্রামছাড়া করার অভিযোগও রয়েছে বিস্তর।

representative image

— প্রতীকী চিত্র।

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
বেলডাঙা শেষ আপডেট: ০৮ মার্চ ২০২৪ ১৮:০১
Share: Save:

পাচার হয়ে গিয়েছিলেন। তার পর পাচারকারীদের চোখে ধুলো দিয়ে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে আবার মুর্শিদাবাদে নিজের বাড়িতে ফিরে আসেন। কিন্তু ‘সমাজ’ মেনে নেয়নি। তাই বাধ্য হয়ে আবারও ফিরতে হয় অনিশ্চয়তার জগতেই। ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর সর্বশেষ রিপোর্ট বলছে, মুর্শিদাবাদ নারী পাচারের ক্ষেত্রে ‘বিপজ্জনক’ হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে। সরকারি উদ্যোগ আগের তুলনায় অনেকটাই বৃদ্ধি পেয়েছে ঠিকই, কিন্তু সমাজ আজও ‘বিশুদ্ধতা’র দোহাই দিয়ে একঘরে করে দেয় প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে বাড়ি ফেরা মহিলাদের। নারী দিবস আসে-যায়, নারী পাচারের চক্রাকার আবর্তন শেষ হয় না।

মুর্শিদাবাদের বেলডাঙার গাঁয়ে কাপড় বিক্রি করতে আসা এক সুদর্শন পুরুষের প্রেমে পড়ে ঘর ছেড়েছিলেন। স্বপ্ন ছিল, পশমিনা শালের কাজ শিখবেন নিজেকে ‘কাশ্মীরি’ বলে পরিচয় দেওয়া যুবকের কাছে। সঙ্গে নিয়েছিলেন মাকেও। ছিলেন গ্রামের আরও কয়েক জন মহিলা। কিন্তু ট্রেনে উঠে জ্ঞান হারান। জ্ঞান ফিরলে বুঝতে পারেন, পাচারকারীদের ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেছেন। তার পরের ঘটনা হার মানাবে কোনও বাজারচলতি সিনেমাকেও। নানা বাধাবিপত্তি পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত মুর্শিদাবাদে গাঁয়ের বাড়িতে ফেরেন মা, মেয়ে। কিন্তু গ্রামবাসীরা তাঁদের মেনে নেননি। সূর্যাস্তের আগেই গ্রাম ছাড়ার নিদান দেন মোড়লরা। একবস্ত্রে আবার বাড়ি ছাড়তে হয় মা-মেয়েকে। বর্তমানে কলকাতায় আছেন তাঁরা। সামান্য রোজগারকে পাথেয় করে মা-মেয়ের সমাজের মূলস্রোতে ফেরার নাছোড় লড়াই আজও চলছে, সমান তালে।

এই কাহিনি গ্রামবাংলায় নতুন নয়। মুর্শিদাবাদের মা-মেয়ের মতো আরও কত নারীর কপালে যে সামাজিক নিদানের খাঁড়া নেমে এসেছে এ ভাবে, তা হিসাব করতে বসলে থই পাওয়া যাবে না। যদিও এমন ঘটনার কথা বেশি শোনা যায় মুর্শিদাবাদেই। ‘ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো’র সর্বশেষ পরিসংখ্যান বলছে, দেশের মধ্যে নারী পাচারের ক্ষেত্রে ‘বিপজ্জনক জেলা’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে বাংলার মুর্শিদাবাদ। ২০১৫ সালে নথিভুক্ত নারী পাচারের ঘটনা ছিল ৪২৯টি, ২০১৬ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৪৪২, ২০২২ সালে সেই সংখ্যাটা গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৭০০-র কাছাকাছি। অধিকাংশ মেয়েকেই আর উদ্ধার করা সম্ভব হয় না। সূত্রের খবর, ঘরছুট মেয়েদের একটা অংশ পাচার হয়ে যায় উত্তর ভারতে, আর কিছু মেয়েকে সীমান্ত পেরিয়ে পাচার করা হয় নেপাল ও বাংলাদেশে। এ তো গেল, খাতায়কলমে সরকারি হিসাব। তার বাইরেও যে কত মেয়ের জীবন এ ভাবে শেষ হয়ে যাচ্ছে, তা ভাবনার অতীত।

কিন্তু কী ভাবে চলে নারী পাচারের কারবার? জেলা প্রশাসন সূত্রে খবর, কখনও বিয়ের প্রতিশ্রুতি, কখনও কাজের টোপ, আবার কখনও মোটা টাকার লোভে অহরহ পাচারকারীদের জালে পা দেন মুর্শিদাবাদের মহিলারা। নারী পাচার নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে কাজ করে চলা জেলার একাধিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্যদের মতে, নিখোঁজ হয়ে যাওয়া মেয়েদের পরিবার বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই লোকলজ্জার ভয়ে ঘটনা চেপে যায়। থানা পর্যন্তও পৌঁছয় না খবর। কোথাও দেহব্যবসা, কোথাও অনৈতিক কাজের সঙ্গে মেয়েরা যুক্ত হয়ে গিয়েছেন, জানার পরে পুলিশ, এমনকি প্রতিবেশীদের থেকেও গোটা ঘটনা লুকিয়ে রাখে পরিবার। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মেয়েদের উপার্জিত অর্থ এসে পৌঁছয় বাড়িতে। অনেক ক্ষেত্রেই বাড়িতে ফিরতে নিষেধ করে দেন বাড়ির লোকেরাই। বাধাবিপত্তি পেরিয়ে বাড়িতে ফিরে এলেও শুরু হয় সামাজিক বয়কট। নানা তকমা সেঁটে দিয়ে তাঁদের ফিরে যেতে বাধ্য করা হয় পুরনো পেশায়।

নারী পাচার নিয়ে কী বলছে মুর্শিদাবাদ জেলা প্রশাসন? জেলাশাসক রাজর্ষি মৈত্র বলেন, ‘‘নারী ও শিশু পাচার রোধে সরকারের উদ্যোগে জনসচেতনতা বৃদ্ধির কাজ পুরোদমে চলছে। একাধিক সরকারি সামাজিক প্রকল্পে নারীদের যুক্ত করে তাদের আর্থিক উন্নতির চেষ্টা করা হচ্ছে। এর সুফলও মিলছে দ্রুত। আগের তুলনায় পাচারের ঘটনার সংখ্যা অনেক কম।’’ মুর্শিদাবাদ জেলা পুলিশ সুপার সূর্যপ্রতাপ যাদব বলেন, ‘‘চিরাচরিত পাচার পদ্ধতি ছাড়াও, সমাজমাধ্যমে ভালবাসার টোপ দিয়ে মেয়েদের অন্য রাজ্যে ডেকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কিছু ঘটনার তদন্তে গিয়ে উদ্ধার করা হয়েছে বেশ কয়েক জন মহিলাকে। নারী পাচার সংক্রান্ত কোনও অভিযোগ পেলেই অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে পদক্ষেপ করছে জেলা পুলিশ।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE