Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪
প্রকল্পে সরকারের ভর্তুকি দেওয়ার খবর জানেন না চাষিরাই

প্রচারে অভাব, মার বর্ষাতি পেঁয়াজ চাষে

খোলা বাজারে পেঁয়াজের মূল্য বৃদ্ধি রুখতে চাষিদের উৎসাহী করতে চাইছে রাজ্য সরকার। উৎপাদনের ঘাটতি মেটাতে রাজ্যে খরিপ বা বর্ষাতি পেঁয়াজের জমি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য উদ্যানপালন দফতর।

রাজদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
বাঁকুড়া শেষ আপডেট: ১৩ জুলাই ২০১৬ ০১:১৯
Share: Save:

খোলা বাজারে পেঁয়াজের মূল্য বৃদ্ধি রুখতে চাষিদের উৎসাহী করতে চাইছে রাজ্য সরকার। উৎপাদনের ঘাটতি মেটাতে রাজ্যে খরিপ বা বর্ষাতি পেঁয়াজের জমি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য উদ্যানপালন দফতর। এ জন্য চাষিদের ভর্তুকিরও ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু যাঁদের জন্য এই প্রকল্প, প্রত্যন্ত এলাকার সেই চাষিদের একটা বড় অংশই দাবি করছেন, তাঁদের কাছে এই প্রকল্পের খবর নেই!

ফি বছর দুর্গাপুজোর আগে খোলা বাজারে পেঁয়াজ অগ্নিমূল্য হয়ে যায়। রাজ্যে বর্ষাতি পেঁয়াজের চাষ না হওয়াই এর কারণ। মূল্যবৃদ্ধি রুখতে ও চাষিদের আমন ধানের বিকল্প চাষের সন্ধান দিতেই বছর তিনেক আগে বর্ষাতি পেঁয়াজ চাষ প্রকল্প চালু করে রাজ্য সরকার। এই প্রকল্প চাষিদের জানাতে জেলার প্রতিটি ব্লকে দৈনিক তিনটি করে সচেতনতা ও প্রশিক্ষণ শিবিরের আয়োজন করার নির্দেশ দিয়েছিল রাজ্য উদ্যান পালন দফতর। গত মাসের শেষে সেই নির্দেশিকা জেলায় এসে পৌঁছলেও একটি শিবিরও করে উঠতে পারেনি বাঁকুড়া। এ দিকে বর্ষাতি পেঁয়াজের বীজ লাগানোর সময় শুরু হয়ে গিয়েছে। এই ঘটনার জন্য উদ্যানপালন দফতরের পরিকাঠামোকেই দুষছেন জেলা প্রশাসনের কিছু আধিকারিক।

ঘটনা হল, বাঁকুড়া জেলার ২২টি ব্লকের মধ্যে বাঁকুড়া ২, গঙ্গাজলঘাটি, বড়জোড়া, ছাতনা, ইঁদপুর ও সিমলাপাল ছাড়া বাকি ব্লকগুলিতে উদ্যানপালন দফতর থাকলেও কোনও কর্মী নিয়োগ হয়নি। সে কারণে ওই সব ব্লকের চাষিদের বাঁকুড়ার জেলা দফতরে ছুটে আসা ছাড়া গতি নেই। লোকজন না থাকায় ওই ব্লকগুলিতেও চাষ সংক্রান্ত অনুষ্ঠান করতে গিয়ে সমস্যায় পড়তে হয় দফতরের আধিকারিকদের। জেলায় উদ্যানপালন দফতরের ফিল্ড অফিসারও অপ্রতুল। মাত্র ছ’জন ফিল্ড অফিসার রয়েছেন। ফলে চাষিদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগের ঘাটতি রয়েই গিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে বর্ষাতি পেঁয়াজ চাষের প্রকল্পের খবর চাষিদের কাছে পৌঁছে দেবে কারা? সেই প্রশ্ন উঠছে।

দফতরের কর্মীরাই জানাচ্ছেন, গত তিন বছর ধরে বর্ষাতি পেঁয়াজ চাষের প্রকল্পে লক্ষ্যমাত্রা ছুঁতে পারেনি বাঁকুড়া জেলা উদ্যানপালন দফতর। গত বছর জেলায় ৩০০ বিঘা বর্ষাতি পেঁয়াজ চাষের লক্ষ্যমাত্রা নিয়েও প্রায় ১৫০ বিঘাতেই ওই চাষ আটকে গিয়েছিল।

অথচ এই প্রকল্পটি যে বেশ লাভজনক তা মানছেন রাজ্য উদ্যানপালন দফতরের প্রাক্তন উপদেষ্টা শুভাশিস বটব্যাল। তিনি জানাচ্ছেন, আমন ধানের তুলনায় বর্ষাতি পেঁয়াজ চাষে লাভ অনেক বেশি। জুলাই ও অগস্ট মাসে চাষ শুরু করতে হয়। দু’মাসের কিছু বেশি সময়েই এই পেঁয়াজ বাজারে বিক্রি করার যোগ্য হয়ে ওঠে। ওই সময় বাজারে পেঁয়াজের চাহিদাও থাকে তুঙ্গে। ফলে ফড়েরা চাষিদের সঙ্গে নিজেরাই যোগাযোগ করে সরাসরি জমি থেকেই ফসল তুলে নেন।

জেলা উদ্যানপালন দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রতি মাসে বাঁকুড়া জেলায় গৃহস্থ, বিভিন্ন হোটেল-রেস্তোরাঁয় পেঁয়াজের চাহিদা থাকে কমবেশি ১৫ টন। রাজ্যে শীতকালীন পেঁয়াজ সুখসাগর চাষের চল রয়েছে। তাই গ্রীষ্মকালে পেঁয়াজের জোগানের অসুবিধা হয় না। কিন্তু বর্ষায় পেঁয়াজ চাষের চল না থাকায় শরতের শুরু থেকে শীতের শেষ পর্যন্ত বাজারে ঘাটতি দেখা যায়। সেই সময় নাসিক থেকে পেঁয়াজ আমদানি করা হয়। তরতরিয়ে দর বাড়ে খোলা বাজারে।

এই জেলায় তাই যাঁরা বর্ষাতি পেঁয়াজ চাষ করেছেন, তাঁরা লাভবান হয়েছেন। যেমন ছাতনার ক্ষীরশোল এলাকার চাষি স্বপন পাল নিজের ১০ বিঘা জমিতে গত বছর এই চাষ করেছিলেন। তার আগে বর্ষায় গতানুগতিক আমন ধান চাষ করতেন তিনি। স্বপনবাবু জানাচ্ছেন, গত বছর বিঘা প্রতি ২০ কুইন্ট্যাল বর্ষাতি পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছিল। আমন ধানের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি লাভ পেয়েছেন তিনি। একই ভাবে এই চাষ করে লাভের মুখ দেখেছেন ছাতনার ঝাঁটিপাহাড়ির বামাপ্রসাদ দে, মেজিয়ার গোপালগঞ্জ এলাকার অশোক মাঝিও। স্বপনবাবু, বামাপ্রসাদবাবু, অশোকবাবুদের সাফল্য দেখে তাঁদের গ্রামের বহু চাষিই বর্ষাতি পেঁয়াজ চাষে আগ্রহ দেখিয়েছেন।

তবে সীমিত কিছু চাষি ছাড়া জেলার বৃহত্তর অংশেই এই প্রকল্পের কথা তেমন ছড়ায়নি। রাইপুরের সোনাগাড়ার চাষি গনেশ দুলের বিঘা তিনেক জমি রয়েছে। উঁচু জমি হওয়ায় তাঁর জমিতে জল দাঁড়ানোর সমস্যাও নেই। এমন জমিই পেঁয়াজ চাষের জন্য আদর্শ। কিন্তু এই প্রকল্পের কথা তাঁর জানাই নেই। তিনি বলেন, “বর্ষায় পেঁয়াজ চাষ হয় বলে শুনিনি। সরকার থেকে এমন কোনও প্রকল্প নিয়েছে বলেও কিছু জানি না তো!” বিষ্ণুপুরের ঘুগিমুড়া এলাকার চাষি অমল দাসেরও এক কথা। তিনি বলেন, “শীতে অল্প পেঁয়াজ চাষ করি। তবে বর্ষায় পেঁয়াজ চাষ করতে কাউকেই দেখিনি।”

জেলার জঙ্গলমহল ব্লক রাইপুর, রানিবাঁধ, সিমলাপার ও সারেঙ্গায় প্রচুর পরিমাণ পেঁয়াজ চাষের উপযুক্ত উঁচু জমি রয়েছে। অথচ এই তল্লাটে এখনও বর্ষাতি পেঁয়াজ চাষ শুরুই হয়নি। জেলা উদ্যানপালন দফতরের উপ-অধিকর্তা মলয় মাজি বলছেন, “আমরা শীঘ্রই সচেতনতা শিবির শুরু করব জেলা জুড়ে। সেই অনুযায়ী প্রস্তুতিও শুরু করে দিয়েছি।” এতদিন করেননি কেন? জবাব এড়িয়ে দফতরের ফিল্ড অফিসার সঞ্জয় সেনগুপ্ত জানাচ্ছেন, জেলা দফতর থেকে বর্ষাতি পেঁয়াজের বীজ বিক্রি শুরু হয়ে গিয়েছে। প্রতি কেজি বীজের দর ১০৫০ টাকা। এই চাষ করলে চাষিদের বিঘা পিছু ২৬০০ টাকা ভর্তুকিও দেওয়া হচ্ছে। চলতি বছরে জেলায় বর্ষাতি পেঁয়াজ চাষের লক্ষ ৫০ হেক্টর। লক্ষ ছোঁয়া যাবে তো? প্রশ্নটা রয়েই গেল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

subsidies onions
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE