Advertisement
০৫ মে ২০২৪

মাঠে খেটে আলু নিয়ে ফেরেন বিন্দুরা

রুখা-শুখা পাথুরে মাটিতে ফি বছর ফসল বলতে ধান আর অড়হর কলাইয়ের চাষ হয়। জলের অভাবে বছরে একবার কোনও রকমে সেই ধান আর ডালশস্য হলেও তেমন ফলন নেই আলুর। ঝাড়খণ্ডের ডিমুডি, কুমগারা, কোলহোর, পাতাবাড়ি, কেন্দপাহাড়ির শিবধন হাঁসদা, বিনারাম মুর্মু, হেমলতা, ফুলমনি টুডুরা তাই সারা বছরের আলুর জোগানের জন্য এ রাজ্যে আলু তোলার মরসুমে পাড়ি দেন। মাঠে আলু তোলার কাজ করে, টাকার বিনিময়ে বাড়ি ফেরেন আলু নিয়েই!

বাড়ি ফেরার আগে চলছে প্রাপ্য আলু বুুঝে নেওয়ার হিসেব।

বাড়ি ফেরার আগে চলছে প্রাপ্য আলু বুুঝে নেওয়ার হিসেব।

অনির্বাণ সেন
সাঁইথিয়া শেষ আপডেট: ১৩ মার্চ ২০১৫ ০১:৩৪
Share: Save:

রুখা-শুখা পাথুরে মাটিতে ফি বছর ফসল বলতে ধান আর অড়হর কলাইয়ের চাষ হয়। জলের অভাবে বছরে একবার কোনও রকমে সেই ধান আর ডালশস্য হলেও তেমন ফলন নেই আলুর। ঝাড়খণ্ডের ডিমুডি, কুমগারা, কোলহোর, পাতাবাড়ি, কেন্দপাহাড়ির শিবধন হাঁসদা, বিনারাম মুর্মু, হেমলতা, ফুলমনি টুডুরা তাই সারা বছরের আলুর জোগানের জন্য এ রাজ্যে আলু তোলার মরসুমে পাড়ি দেন। মাঠে আলু তোলার কাজ করে, টাকার বিনিময়ে বাড়ি ফেরেন আলু নিয়েই!

শুনতে আশ্চর্য ঠেকলেও, ইন্টারনেট ব্যাঙ্কিং, অনলাইন শপিং আর ক্রেডিট কার্ডের যুগেও এখনো এভাবেই চলছে পণ্যবিনিময় প্রথা। ঠিক কবে থেকে যে ঝাড়খণ্ড থেকে রাজ্যে আলু তোলার মরসুমে শিবধন-হেমলতারা আসছেন, জানা নেই তাঁদেরও। ফি বছর মাঘ মাসের মাঝামাঝি করে ঝাড়খণ্ডের ওই সমস্ত গ্রাম গুলি থেকে দু-একজন আগে এসে খোঁজ নিয়ে যান। কোন গ্রামে কত শ্রমিক লাগতে পারে। দীর্ঘদিন ধরে কাজের সুবাদে জমির মালিকদের সঙ্গে সখ্যতাও গড়ে উঠেছে এই শ্রমিকদের। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, জমি থেকে আলু তোলার সময় আসার আগেই কোনও কোনও জমির মালিকরা নিজেরাই তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ডেকে আনেন।

ফি বছর ফাল্গুন মাসের প্রথম সপ্তাহের পর থেকেই এ রাজ্যে দল বেঁধে এসে ডেরা বাঁধেন ঝাড়খণ্ডের এই শ্রমিকরা। এখানে নিজের নিজের ঠিকা নেওয়া জমি সংলগ্ন নদীর পাড় বরাবর ফাঁকা জায়গায়, কখনো কোনও স্কুলের মাঠেও ডেরা করেন। ডেরা বলতে চারটে লাঠি পুঁতে একটা করে মশারি খাটিয়ে নেওয়া। সেই মশারির পাশেই থাকে বাসনপত্র, জামাকাপড়, আয়না-চিরুনি। বাড়ি থেকে আসার সময়ই সঙ্গে নিয়ে আসা প্রয়োজনের চাল, ডাল, নুন, জ্বালানীর কাঠও থাকে সেই মশারি-ঘরের পাশে। এমনকী পারিশ্রমিক বাবদ প্রাপ্ত আলু নিয়ে বাড়ি যাওয়ার জন্য সঙ্গে আনে ভাড়া বাবদ কিছু টাকাও।

ঝাড়খণ্ডের মূলপাহাড়ি গ্রামের বাসিন্দা ইলিয়াস হাঁসদা, করন্তি সোরেনরা বলেন, “ঘুম থেকে সেই ভোরে উঠতে হয়। উঠে রান্নার কাজ সেরে ফেলতে হয়।” রান্না বলতে ভাত আর আলু সিদ্ধ। কোনও কোনও দিন বাড়ি থেকে নিয়ে আসা গুঁড়ো করা অড়হর কলাই-য়ের ডাল। অথবা, সেই গুড়ো গড়ম জল দিয়ে মেখে নেওয়া। সেই খেয়েই ইলিয়াস-করন্তিরা বেড়িয়ে পড়েন আলু তোলার কাজে। দুপুরের জন্যও খাবার নিয়ে যান। দিন শেষে ডেরায় ফিরেই প্রথম কাজ সেদিনের প্রাপ্ত আলু নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করা। তারপর ক্লান্ত শরীরে স্নান সেরে আবার রাতের রান্নার প্রস্তুতি। সন্ধে রাতেই খেয়ে শুয়ে পড়তে হয়, নইলে যে ভোর ভোর ওঠা যাবে না। টানা প্রায় ১২-১৫ এই রুটিনেই চলে এ রাজ্যে থাকার দিনগুলোতে।

শিবধন, বিনারাম, ইলিয়াস, ফুলমনি, হেমলতারা এখনো কেন পণ্যের বিনিময়ে এমন কায়িক শ্রম দেন? তাঁদের কথায়, “ঝাড়খণ্ডের গ্রামে বেশিরভাগ জমি পাথুরে। জলের খুব অভাব। বছরে একবার কোনও রকমে ধান ফলাতে হয়। একটু আধটু অড়হর কলাইয়ের চাষ করতে পারলেও আলু বা অন্য কোনও সব্জী চাষ প্রায় অসম্ভবই। তাই এভাবেই আলুর বিনিময়ে অন্যের জমি থেকে আলু তুলে দিয়ে নিজেদের জন্য সারা বছরের আলু সংগ্রহ করে নিয়ে যাই।”

এমন পদ্ধতিতে জমি থেকে আলু তোলায় খুশি জমির মালিকরাও। বহড়ার বিষ্ণুপদ মণ্ডল, নির্মল মণ্ডল, নারায়ণপুরের নারায়ণ পালেরা বলেন, “চাষের পিছনে দিন দিন খরচ বাড়ছে। আর আলুর দম কমছে। তার উপরে আবার যদি নগদ টাকা দিয়ে শ্রমিক লাগিয়ে জমি থেকে ফসল ঘরে তুলতে হয় তাহলে তো আর কথাই নেই। চাষ করতে গিয়ে একেবারে ঘটি-বাটি বিক্রির অবস্থা হয়ে দাঁড়ায়। সেখানে ঝাড়খণ্ড থেকে ওঁরা কাজ করতে আসেন, এতে সুবিধাই হচ্ছে।”

সাঁইথিয়া ও ময়ূরেশ্বর থানার বিভিন্ন গ্রামে পুরদমে চলছে আলু তোলার কাজ। আর দিন কয়েক পরেই ঘরে ফেরার পালা হেমলতা, ফুলমনিদের। দিনভর কাজ করে কি পরিমাণ আলু নিয়ে ঘরে ফেরেন? জানা গেল, জমি থেকে এক বস্তা অর্থাত্‌ ৫০ কেজি আলু তুললে তার বিনিময়ে তাঁরা চার কেজি আলু পান। সেই দিয়েই চলতে হয় সারা বছর।

ফুলমনি বলেন, “জমি থেকে কাছের বড় রাস্তা পর্যন্ত আলু এনে দিলে, বিনিময়ে জমি থেকে রাস্তার দূরত্ব অনুযায়ী বস্তা প্রতি তিন থেকে আড়াই কেজি বাড়তি আলু পাই। ওই আমাদের সারা বছরের ভাতের পাশে থাকে। অড়হরের ডাল খেতে খেতে মুখ বদলের ওই ভরসা!”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

anirban sen sainthia potato
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE