Advertisement
E-Paper

কোল দিচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়, নিজ পরিচয়েই ঠাঁই বৃহন্নলাদের

দায়ে পড়ে বৃহন্নলা হতে হয়েছিল অর্জুনকে। কিন্তু তৃতীয় পাণ্ডব যদি জন্মসূত্রে বৃহন্নলা হতেন, দ্রোণাচার্য কি তাঁকে নিজের গুরুকুলে নিতেন? গুরু দ্রোণের উত্তর না-মিলুক, আধুনিক উচ্চশিক্ষা প্রাঙ্গণ অবশেষে কোল পেতে দিচ্ছে হিজড়ে, বৃহন্নলা, রূপান্তরকামীদের জন্য। এক কথায় যাঁরা ‘তৃতীয় লিঙ্গ’, তাঁরা এ বার নিজেদের পরিচয়েই ভর্তির আবেদন করতে পারবেন বিশ্ববিদ্যালয়ে।

সাবেরী প্রামাণিক

শেষ আপডেট: ১৪ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:১২
মানবী বন্দ্যোপাধ্যায়

মানবী বন্দ্যোপাধ্যায়

দায়ে পড়ে বৃহন্নলা হতে হয়েছিল অর্জুনকে। কিন্তু তৃতীয় পাণ্ডব যদি জন্মসূত্রে বৃহন্নলা হতেন, দ্রোণাচার্য কি তাঁকে নিজের গুরুকুলে নিতেন?

গুরু দ্রোণের উত্তর না-মিলুক, আধুনিক উচ্চশিক্ষা প্রাঙ্গণ অবশেষে কোল পেতে দিচ্ছে হিজড়ে, বৃহন্নলা, রূপান্তরকামীদের জন্য। এক কথায় যাঁরা ‘তৃতীয় লিঙ্গ’, তাঁরা এ বার নিজেদের পরিচয়েই ভর্তির আবেদন করতে পারবেন বিশ্ববিদ্যালয়ে।

কলকাতা, যাদবপুর, প্রেসিডেন্সি, রবীন্দ্রভারতী, বর্ধমান-সহ রাজ্যের প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর স্তরে ভর্তির আবেদনপত্রে পুরুষ ও মহিলার সঙ্গে সঙ্গে এ বারেই প্রথম ‘অন্যান্য’ শব্দবন্ধনী থাকছে লিঙ্গ হিসেবে। এবং ২০১৫-’১৬ শিক্ষাবর্ষ থেকেই তা চালু হয়ে যাবে বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়গুলির কর্তারা। রাজ্যের শিক্ষা দফতর সূত্রের খবর, বিভিন্ন কলেজের কর্তৃপক্ষও একই পথ অনুসরণ করতে চলেছেন।

দেশের প্রত্যেক নাগরিকের সমানাধিকারের কথা বলে ভারতের সংবিধান। তা সত্ত্বেও চাকরি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রে হিজড়ে ও রূপান্তরকামীরা কেন ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ হিসেবে আবেদন করতে পারবেন না, সেই বিতর্ক দীর্ঘদিনের। আইনি লড়াইয়ে হিজড়ে-বৃহন্নলাদের জয় হয় বছরখানেক আগে। গত বছরের এপ্রিলে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে এই সংক্রান্ত যাবতীয় প্রশ্ন ও বিতর্কের অবসান ঘটে। সর্বোচ্চ আদালত জানিয়ে দেয়, তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবেই ওঁরা আবেদন করতে পারবেন। সেই রায়ের ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বা ইউজিসি গত জুলাইয়ে দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে নির্দেশিকা পাঠিয়ে জানিয়ে দেয়, উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে স্কলারশিপ, ফেলোশিপের জন্য তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবেই আবেদন জানাতে পারবেন হিজড়ে ও রূপান্তরকামীরা।

সমাজের নানা ক্ষেত্রে উঠতে-বসতে বিদ্রুপের শিকার হতে তো হয়ই। এত দিন বৃহন্নলারা নিজস্ব পরিচয়ে উচ্চশিক্ষার আবেদনও করতে পারতেন না। আবেদনপত্রের ‘লিঙ্গ কলাম’-এ নিজেদের পুরুষ বা মহিলা হিসেবে পরিচয় দিতে বাধ্য হতেন তাঁরা। রাজ্যের শিক্ষা দফতরের এক কর্তা জানান, বাধ্যতামূলক সেই ছদ্ম পরিচয়ের পালা সাঙ্গ হতে চলেছে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সুরঞ্জন দাস জানান, ইউজিসি-র নির্দেশ মেনে ২০১৫-’১৬ শিক্ষাবর্ষ থেকে ভর্তির আবেদনপত্রে তৃতীয় লিঙ্গের উল্লেখ রাখার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ‘‘নৈতিক ভাবে আমরাও এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি,’’ বললেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার প্রদীপ ঘোষ।

একই বক্তব্য প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের। এবং সেখানকার কর্তৃপক্ষ জানাচ্ছেন, এই কাজ করতে গিয়ে ছাত্রছাত্রীদের দাবিকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কর্তার কথায়, ‘‘আমাদের ছাত্রছাত্রীরা গত বছরই তৃতীয় লিঙ্গের উল্লেখ রাখতে বলেছিল। সম্প্রতি এই বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানোর কর্মসূচিও নেয় ওরা। ইউজিসি-র নির্দেশিকা আর পড়ুয়াদের দাবি— দুই মিলিয়ে তৃতীয় লিঙ্গের সুযোগ রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে।’’ রবীন্দ্রভারতীর উপাচার্য সব্যসাচী বসু রায়চৌধুরী জানান, একই পথে হাঁটছেন তাঁরাও।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলির এই সিদ্ধান্তকে প্রত্যাশিত ভাবেই স্বাগত জানিয়েছে আন্দোলনকারীদের সংগঠন ‘অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রান্সডজেন্ডার/ হিজড়ে ইন বেঙ্গল’। সংগঠনের সম্পাদিকা রঞ্জিতা সিংহ বলেন, ‘‘খুবই ভাল উদ্যোগ। তবে এর সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক সচেতনতাও বাড়াতে হবে। কারণ, অনেকেই এখনও আড়ালে থেকে গিয়েছেন। তাঁদের কাছেও এই সুযোগের কথা পৌঁছে দিতে হবে। তা ছাড়া সমাজে আমাদের গ্রহণযোগ্যতা না-বাড়লে হেনস্থার আশঙ্কা থেকেই যাবে।’’

রঞ্জিতার আশঙ্কা স্বাভাবিক বলে মনে করেন অনেকেই। তাঁদের প্রশ্ন, উচ্চশিক্ষায় এই ব্যবস্থার ফলে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ হয়তো পাওয়া গেল। কিন্তু সামাজিক স্বীকৃতি কতটা মিলবে?

অভিজ্ঞ শিক্ষকদের অনেকে মনে করছেন, সত্যিকারের পরিবর্তনের জন্য দরকার মানসিকতার বদল। শুধু আইন বা নির্দেশ জারি করে তৃতীয় লিঙ্গের সমানাধিকার আসবে না। তবে দীর্ঘ লড়াইয়ের পরে এই সুযোগ পরিস্থিতি বদলাতে অনেকটাই সাহায্য করবে বলে তাঁদের ধারণা।

মনস্তত্ত্ববিদ নীলাঞ্জনা সান্যালও স্বাগত জানিয়েছেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্তকে। তিনি মনে করেন, যদি কারও মানসিকতা প্রাচীন বা রক্ষণশীল হয়, তা হলে তাঁর সমস্যা হতে পারে। ‘‘তবে এখনকার পৃথিবী অনেকটাই খোলামেলা। ছাত্রছাত্রীরা তো বটেই, শিক্ষক-শিক্ষিকাদেরও বড় অংশ এই ধরনের মানুষদের আলাদা ভাবে দেখেন না। তাই কোনও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়,’’ বলছেন নীলাঞ্জনাদেবী।

তাঁর মতো মানুষগুলি নিজের নিজের পরিচয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে পড়ার সুযোগ পাবেন জেনে উচ্ছ্বসিত মানবীদেবী। জন্মসূত্রে পাওয়া পুরুষের পরিচয় দীর্ঘ লড়াই চালিয়ে বদলে ফেলে নারী হয়ে ওঠা মানবী বন্দ্যোপাধ্যায়। তৃতীয় লিঙ্গের আপন ভাগ্য জয়ের গাথায় নতুন মাত্রা জুড়েছেন তিনি। সম্প্রতি কৃষ্ণনগর উইমেন্স কলেজের অধ্যক্ষা নির্বাচিত হয়েছেন মানবীদেবী। সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরে নিজেকে তৃতীয় লিঙ্গভুক্ত হিসেবে উল্লেখ করেই মানবীদেবী অধ্যক্ষা হয়েছেন, এক কথায় যা প্রায় নজিরবিহীন। আগামী মাসেই কলেজ-প্রধানের সেই নতুন দায়িত্ব নিতে চলেছেন তিনি।

উচ্চশিক্ষায় বৃহন্নলাদের স্ব-পরিচয়ে ভর্তির বিষয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘোষণার পরে মানবীদেবী বলেন, ‘‘যে-মানুষগুলি দীর্ঘদিন ধরে নিজেদের অধিকারের জন্য আন্দোলন করে চলেছেন, এতে তাঁদের লড়াই আরও এক ধাপ এগোল। ওঁদের অভিনন্দন।’’

University third gender kolkata rabindrabharati burdwan saberi pramanik UGC Manabi Bandopadhyay abpnewsletters
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy