Advertisement
E-Paper

পুলিশকে ‘বম্’ মারতে বলেও পার পেয়েছিলেন, ঘড়ি দেখিয়ে হুমকিও দিয়েছিলেন, তখন ছাড় পেয়েও এখন কেন কোপে কেষ্ট

অনুব্রতের সঙ্গে বোলপুরের আইসির কথোপকথন গত ২৭ মে, মঙ্গলবারে। যা বৃহস্পতিবার রাত ৮টার পর থেকে সমাজমাধ্যমে ছড়াতে শুরু করে।

শোভন চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ৩০ মে ২০২৫ ২০:০৩
Why did TMC and police take action against Anuvrata Mandal

গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

ঠিক ১২ বছর আগে গোটা বাংলা জেনেছিল, বীরভূমে অনুব্রত মণ্ডল নামে এক নেতা আছেন। যাঁকে সকলে কেষ্ট মণ্ডল বলে চেনেন। যিনি তৃণমূলের জেলা সভাপতি। কারণ, প্রকাশ্য মঞ্চে দাঁড়িয়ে পুলিশকে বোমা মারার নিদান দিয়েছিলেন তিনি। ২০১৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রাক্কালে কেষ্ট বলেছিলেন, ‘‘যদি কোনও প্রশাসন ভাবে নির্দলকে সমর্থন করব, সেই প্রশাসনের পুলিশের উপর বম্ (বোমা) মারুন! আমি বলছি বম্ মারতে!’’

সেই সময় কেষ্টর বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেয়নি তৃণমূল। নীরব ছিল পুলিশ।

২০১৭ সালে বোলপুরে এক পুলিশ আধিকারিককে ঘড়ি দেখিয়ে বলেছিলেন, ‘‘এখন ৪টে (বিকাল) বাজে। ৮টা (রাত) পর্যন্ত আপনাকে সময় দিলাম। না হলে আমি ঢুকে যাব। ভয়ঙ্কর খেলা খেলে দেব। একটা বাড়িও আস্ত রাখব না। একদম চড়িয়ে দেব। সব ক’টাকে অ্যারেস্ট করুন। এক ধার থেকে অ্যারেস্ট করুন!’’

সে বারও কেষ্টর বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেয়নি তৃণমূল। নিশ্চুপ ছিল পুলিশ।

২০২৫ সালের মে মাস। সেই কেষ্টর অডিয়ো ক্লিপ নিয়ে তোলপাড় পড়ে গিয়েছে প্রশাসন এবং শাসকদলে। এ বার পুলিশ নীরব থাকেনি। এফআইআর করেছে। আর দল নিঃশর্তে ক্ষমা চাইতে বলল কেষ্টকে। কেষ্ট সুড়সুড় করে ক্ষমা চাইলেন। শুধু তা-ই নয়, প্রথমে যে বয়ানে ক্ষমা চেয়েছিলেন, পরে দলের ধমক খেয়ে তা বদলও করতে হল তাঁকে। কিন্তু এ বার কেন অনুব্রতকে রেয়াত করল না তৃণমূল? কেন এত ‘সক্রিয়’ হল পুলিশ?

তৃণমূল বদলে গিয়েছে? না কি পুলিশ বদলে গিয়েছে?

তৃণমূল একই আছে। পুলিশও। বদলে গিয়েছে সময়। তৃণমূলের প্রথম সারির নেতারা একান্ত আলোচনায় বলছেন, শুধু পুলিশকে হুমকি দেওয়া নয়। বোলপুরের আইসি লিটন হালদারকে কেষ্ট যে অশ্রাব্য ভাষা বলেছেন এবং তাঁর স্ত্রী আর মাকে জড়িয়ে যে সমস্ত ‘ধর্ষকামী’ মন্তব্য করেছেন, তার কারণেই কেষ্টর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করেছেন দলের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব। কারণ, তাঁরা মনে করছেন, কেষ্টর কথায় সামগ্রিক ভাবে মহিলাদের প্রতি কুরুচিকর মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে। শাসকদলের এক প্রথম সারির নেতার কথায়, ‘‘পুলিশ এফআইআর করেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশেই। আর দলও পদক্ষেপ করেছে তাঁর কথাতেই।’’ অর্থাৎ, অতীতে যে মমতা নানা বিতর্কে তাঁকে ‘আড়াল’ করতেন বলে অভিযোগ উঠত, সেই তিনিও ক্ষুব্ধ। মতান্তরে ক্রুদ্ধ। তৃণমূলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ বলেন, ‘‘যে ভাষায় উনি (কেষ্ট) কথা বলেছেন, তাতে দল বিরক্ত। তাই সঙ্গে সঙ্গে দল পদক্ষেপ করেছে।’’ অতীতে দল কেন বিরক্ত হয়নি, সে প্রশ্নের জবাব কুণাল সরাসরি দেননি। তবে এ বার যে ভাষাই মূল কারণ, তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন দলের অন্যতম মুখপাত্র।

প্রসঙ্গত, অনুব্রতের সঙ্গে বোলপুরের আইসি-র কথোপকথন গত ২৭ মে, মঙ্গলবারের। ঘটনাচক্রে, বৃহস্পতিবার রাত ৮টার পর থেকে তা সমাজমাধ্যমে ছড়াতে শুরু করে। এমন সময়ে বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে, যখন ‘অপারেশন সিঁদুর’ নিয়ে আলিপুরদুয়ারের সভায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বক্তৃতার পাল্টা মমতার সাংবাদিক বৈঠকের বক্তব্য নিয়ে সমাজমাধ্যমে লড়াইয়ে নেমেছে তৃণমূল। শাসকদল এই ভাষ্য তৈরি করতে চাইছিল যে, মোদী আসলে মা-বোনেদের সিঁদুরে রাজনীতির রং মিশিয়েছেন। সামগ্রিক ভাবে মহিলাদেরই অপমান করেছেন। কিন্তু তাদের নেতা কেষ্ট পুলিশের আইসি-র সঙ্গে যে ভাষায় কথা বলেছেন, যে ভাবে তাঁর স্ত্রী ও মাকে টেনে মন্তব্য করেছেন এবং ওই অডিয়ো ক্লিপ যে ভাবে ঝড়ের গতিতে ছড়াতে শুরু করেছে, তাতে তৃণমূলের মূল উদ্দেশ্য মার খেয়ে যায়। মোদীর পাল্টা মমতার বক্তব্য প্রচারের আলো পাওয়ার বদলে তা কেড়ে নেয় কেষ্টর ‘অডিয়ো ক্লিপ’।

তৃণমূলের মহিলা সাংসদ এবং বিধায়কেরাও গোটা ঘটনায় ক্রুদ্ধ। সেই ‘চাপ’ও দলের উপর ছিল। শুক্রবার দক্ষিণবঙ্গের এক মহিলা তৃণমূল সাংসদ বলেন, ‘‘কাল (বৃহস্পতিবার) অনেক রাতে আমি একটি অনুষ্ঠান থেকে ফেরার সময়ে ফোন পাই। আমার এক আত্মীয় আমায় হোয়াট্সঅ্যাপে ওই অডিয়ো ক্লিপ পাঠিয়ে বলেন, এ সব কী হচ্ছে? বিশ্বাস করুন, ওই অডিয়ো ক্লিপের পুরোটা আমি শুনতেও পারিনি।’’ ওই সাংসদ আরও বলেন, ‘‘রাত সওয়া ১টায় আমি দলের সর্বোচ্চ স্তরের নেতৃত্বকে মোবাইলে বার্তা পাঠিয়ে আমার অস্বস্তির কথা জানাই। সকালে জানতে পারি, দল পদক্ষেপ করবে।’’

বীরভূমের পুলিশ সুপার অমনদীপ সিংহ জানিয়েছেন, যেহেতু আইসি-কে ফোনে ওই ধরনের হুমকি দেওয়া হয়েছে, তাই পুলিশ পদক্ষেপ করেছে। বাস্তব হল, পুলিশকে হুমকি কেষ্ট প্রথম দিলেন এমন নয়। এর আগে পুলিশকে সামনে দাঁড় করিয়ে বলেছিলেন ভয়ঙ্কর খেলা খেলে দেবেন। প্রকাশ্য মঞ্চ থেকে বলেছিলেন ‘বম্’ মারতে। সেই সময়ে পুলিশ ছিল নির্বাক দর্শক। ফলে পুলিশের বিষয়টি মুখ্য বলে মনে করছেন না তৃণমূলের নেতারাও। এ বার দল কেষ্টর পাশে দাঁড়ায়নি। কারণ, তাঁর কথায় ‘ধর্ষকাম’ প্রকাশিত হয়েছে। তৃণমূল জানে, বছর ঘুরলে বিধানসভা ভোট। মমতার জনসমর্থনের অন্যতম পুঁজি মহিলা ভোট। যে ভোটে থাবা বসাতে চাইছে বিজেপি। পরিস্থিতি বুঝেই অনুব্রতের অডিয়োকাণ্ডে পদক্ষেপ করতে কালক্ষেপ করেনি তৃণমূল। তবে যে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে, ক্ষমা চেয়েই কি পার পাবেন কেষ্ট? কোনও ‘দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি’ কি তাঁকে দেবে না দল?

Anubrata Mondal Tmc Leader Birbhum Police Controversial comments
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy