Advertisement
১৯ মে ২০২৪
CV Ananda Bose

মধ্যরাতে বোসের ‘পত্রবাণ’ কাকে লক্ষ্য করে? জল্পনা অনেক, কিন্তু দৌড়ে এখনও এগিয়ে সেই আর এক বোস

শনিবার মধ্যরাতের খানিক আগেই জোড়া ‘গোপনীয়’ চিঠি লিখেছেন রাজ্যপাল বোস। একটি পাঠিয়েছেন নবান্নে, অপরটি দিল্লিতে। সেই চিঠি কার উদ্দেশে, তার বিষয়ই বা কী, সেটা নিয়ে তৈরি হয়েছে নানা জল্পনা।

C. V. Ananda Bose.

রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস। —ফাইল চিত্র।

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৫:০০
Share: Save:

রবিবার ছুটির দিন। আর শনিবার মধ্যরাতে রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকারকে চিঠি পাঠিয়েছেন রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস। চিঠি গিয়েছে মুখবন্ধ খামে। রাজভবনের পক্ষে স্পষ্ট করেই জানানো হয়েছে চিঠির বিষয় ‘গোপনীয়’। যে কোনও গোপন বিষয় নিয়েই যেমন জল্পনা বেশি হয়, তেমনটা এই ক্ষেত্রেও। মধ্যরাতে তিনি ‘অ্যাকশন’ নিতে চলেছেন বলে আগেভাগেই জানিয়ে রেখেছিলেন বোস। ফলে কৌতূহল তৈরি হয়ে যায়। বিকাশ ভবন বনাম রাজভবনের চলতি সংঘাত নিয়েই যে ‘অ্যাকশন’, শনিবার সকালে তা-ও স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন রাজ্যপাল। দুপুরে ‘যুদ্ধের আগুনে ঘি’ ঢালেন শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু। ব্রাত্য তাঁর ‘এক্স’ হ্যান্ডলে ‘রক্তচোষা’ বলে আক্রমণ করেন। যদিও রাজ্যপালের নাম নেননি তিনি। তবে শনিবার মধ্যরাতকে ‘রাক্ষস প্রহর’ বলে তকমা দিয়ে, তার জন্য তিনি অপেক্ষায় রয়েছেন বলে লেখেন ব্রাত্য।

এই আবহই ইঙ্গিত দিচ্ছে, রাজ্যপাল বর্ণিত ‘অ্যাকশন’ ব্রাত্য তথা শিক্ষা দফতরের বিরুদ্ধেই হয়ে থাকতে পারে। এ নিয়ে কোনও মহল থেকে কোনও ঘোষণা না থাকলেও, রাজ্যপালের জোড়া পত্রবাণের লক্ষ্য কে, সেই জল্পনায় সবচেয়ে বেশি উঠে আসছে ব্রাত্যের নাম। তেমন ইঙ্গিত মিলছে তৃণমূল বা বিজেপি মুখপাত্রদের কথাতেও। রবিবার আনন্দবাজার অনলাইনকে প্রতিক্রিয়া দিতে গিয়ে তৃণমূল মুখপাত্র কুণাল ঘোষ এবং বিজেপির মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্যের মুখেও এসেছে শিক্ষামন্ত্রীর নাম।

আনন্দ এবং ব্রাত্য, দুই বোসের সংঘাত গড়াচ্ছে অনেক দিন ধরেই। যা মূলত উপাচার্য নিয়োগ নিয়ে। এ নিয়ে ব্রাত্য বিভিন্ন অভিধা দিয়ে আক্রমণ করেছেন বোসকে। তবে সেটা অন্য মাত্রা পায় শনিবার। রাজ্যপাল মধ্যরাতে ‘অ্যাকশন’ নেবেন বলে হুঁশিয়ারি দেওয়ার পরে ব্রাত্য লিখেছিলেন, ‘‘মধ্যরাত পর্যন্ত দেখুন, অ্যাকশন দেখুন।’’ তার পরেই ব্রাত্য লেখেন, ‘‘সাবধান! সাবধান! সাবধান! শহরে নতুন রক্তচোষা (ভ্যাম্পায়ার) এসেছে। নাগরিকেরা দয়া করে সতর্ক থাকুন। ভারতীয় পুরাণ অনুযায়ী, ‘রাক্ষস প্রহরের’ জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছি।’’ এর পরেই রাতে রাজ্যপালের জোড়া চিঠি। আর সেই কারণেই ব্রাত্যের নাম বেশি করে আসছে জল্পনায়। তবে ব্রাত্যের ‘বোমা’র পর বিকেলে রাজভবনে গিয়েছিলেন রাজ্যের মুখ্যসচিব হরিকৃষ্ণ দ্বিবেদী। রাজ্যপালের সঙ্গে তাঁর কী কথোপকথন হয়েছিল, তা অবশ্য কোনও পক্ষ থেকেই খোলসা করা হয়নি।

রাজ্যপালের ‘অ্যাকশন’ নেওয়ার আগাম ঘোষণা শুনে ধরে নেওয়া হয়েছিল, আবার কোনও প্রকাশ্য বার্তা দেবেন বোস। যেমন গত কিছু দিন ধরে প্রায়শ দিয়ে চলেছেন তিনি। মধ্যরাতের অপেক্ষায় ছিল শিক্ষা থেকে রাজনীতি সব মহলই। শনিবার মধ্যরাতের আট মিনিট আগেই, ১১টা ৪২ মিনিটে একটি সংক্ষিপ্ত এবং ‘রহস্যজনক’ বিবৃতি দেয় রাজভবন। তাতে বলা হয়, ‘‘পশ্চিমবঙ্গের মাননীয় রাজ্যপাল দু’টি গোপনীয় চিঠিতে সই করে আজ রাতে মুখবন্ধ করে একটি নবান্নে ও একটি দিল্লিতে পাঠিয়েছেন।’’

রাজভবনের এই বার্তাতেই ছিল ধোঁয়াশা। নবান্নের চিঠি তিনি রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে লিখেছেন বলে ধরে নেওয়া যায়। কিন্তু ‘দিল্লি’ বলে তিনি কী বোঝাতে চেয়েছেন? রাজ্যপালের নিয়োগকর্তা রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু। তিনি দিল্লির রাইসিনা হিলসের বাসিন্দা। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও দিল্লির বাসিন্দা। আবার যদি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কোনও বিষয় হয়ে থাকে তবে দিল্লির বাসিন্দা অমিত শাহকেও চিঠি দিয়ে থাকতে পারেন। কিন্তু রাজভবন শুধু ‘দিল্লি’ বলায় সেটি রাষ্ট্রপতি ভবন না কি কেন্দ্রীয় সরকার, তা নিয়েও ধোঁয়াশা থেকে যায়।

প্রথমেই জল্পনা তৈরি হয়, সংঘাতের আবহে রাজ্যপাল কি বাংলার দায়িত্ব থেকে মুক্তি চাইছেন? তবে তিনি ইস্তফাপত্র পাঠাতেই পারেন দিল্লিতে। তবে সেটা সাধারণ নিয়ম মেনে যাবে রাষ্ট্রপতি ভবনে। তা-ও আলাদা করে উল্লেখ করা ছিল না। আবার সেটাই সত্যি হলে সেই চিঠি নবান্নে পাঠাবেন কেন? তা ছাড়া, তিনি যে ভাবে সংঘাত চালাচ্ছেন তাতে ইস্তফা দেওয়ার মতো সিদ্ধান্তই বা নিতে যাবেন কেন? তাতে তো সরকারের কাছে নতিস্বীকার করা হয়ে যায়। তিনি যে তেমনটা চান না সেটাও একের পর এক পদক্ষেপে বুঝিয়ে দিতে চাইছেন। তিনি যে সমঝোতার পথেও হাঁটতে চান না সেটা বোঝাতেই তো মধ্যরাতে ‘অ্যাকশন’ নেওয়ার কথা বলেছিলেন। শনিবার সকালে বলেছিলেন, ‘‘আজ মধ্যরাতের জন্য অপেক্ষা করুন। অ্যাকশন কাকে বলে দেখতে পাবেন।’’ কিন্তু ইস্তফা তো কোনও ‘অ্যাকশন’ হতে পারে না!

শনিবার রাতে রাজ্যের রাজনৈতিক নেতারাও মুখে কুলুপ এঁটে ছিলেন। আসলে তাঁদের কাছেও বিষয়টা স্পষ্ট ছিল না। একটা মহল এমনটাও বলতে শুরু করে যে, রাজ্যপাল নিযুক্ত অন্তর্বর্তিকালীন উপাচার্যদের নিরাপত্তা চেয়ে নবান্ন এবং দিল্লিতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকে চিঠি পাঠিয়ে থাকতে পারেন। কিন্তু সেই সম্ভাবনাও ক্ষীণ। কারণ, নিরাপত্তাহীনতার কথা বলেছিলেন বোস নিযুক্ত রবীন্দ্রভারতী এবং প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শুভ্রকমল মুখোপাধ্যায়। আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কায় তিনি রবীন্দ্রভারতীতে যেতে পারছেন না বলে অভিযোগ তুলে বাড়ি থেকে কাজ করছিলেন। যদিও তিনি পরে দুই বিশ্ববিদ্যালয়েই যাওয়া শুরু করেছেন। রবিবার শুভ্রকমলকে এই বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি আনন্দবাজার অনলাইনকে বলেন, ‘‘রাজ্যপাল কী নিয়ে চিঠি লিখেছেন তা জানি না। সোমবার হয়তো জানা যাবে। তবে আমি নিরাপত্তার অভাব এখন আর বোধ করছি না।’’

এর পরে তৃতীয় জল্পনা তৈরি হয় তাঁর সঙ্গে প্রকাশ্য সংঘাতে জড়িয়ে পড়া শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্যের বিরুদ্ধে কোনও সুপারিশ করেই কি মাঝরাতের জোড়া চিঠি? সেই জল্পনায় স্পষ্ট উত্তর না-মিললেও কুণাল এবং শমীকের বক্তব্যে তার ইঙ্গিত রয়েছে। রবিবার আনন্দবাজার অনলাইনকে কুণাল বলেন, ‘‘রাজ্যপাল তো রাত জাগতে চাইছেন। নিশাচরীয় পদক্ষেপ করছেন। যা স্বাভাবিক নয়। কবি বলে গিয়েছেন, ‘জাগরণে যায় বিভাবরী, আঁখি হতে ঘুম নিল হরি’। অর্থাৎ, ব্রাত্য ওঁর ঘুম কেড়ে নিয়েছেন।’’ আবার শমীকের বক্তব্য, ‘‘রাতে যখন ‘দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে আছে পাড়া’, তখন ব্রাত্যের দুয়ারে কে কড়া নাড়ছেন?’’

কিন্তু একটি রাজ্যের নির্বাচিত সরকারের মন্ত্রীর বিরুদ্ধে কী-ই বা ব্যবস্থা নিতে পারেন রাজ্যপাল? মন্ত্রিসভায় কে থাকবেন, কে থাকবেন না তা তো একমাত্র মুখ্যমন্ত্রীই ঠিক করতে পারেন। তাতে রাজ্যপালের স্বাক্ষর প্রয়োজন হলেও তা রদবদলের ক্ষমতা কি আদৌ রয়েছে রাজ্যপালের? আর সেটা চাইলে দিল্লিকেই বা চিঠি পাঠাবেন কেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে প্রাক্তন রাজ্যপাল তথা বিজেপি নেতা তথাগত রায় বলেন, ‘‘সাধারণ ভাবে রাজ্যপাল এমন কিছু করতে পারেন না। কিন্তু যদি কোনও মন্ত্রী একেবারে প্রকাশ্যে বা সন্দেহাতীত ভাবে কোনও বেআইনি আচরণ করেন এবং সরকার কোনও পদক্ষেপ না করে, তবে রাজ্যপাল যে একেবারে ক্ষমতাহীন হয়ে বসে থাকবেন এমনটাও নয়। শুধু সংবিধান পড়লেই হবে না, এই বিষয়ে কোনও আদালতের রায় রয়েছে কি না সেটাও দেখতে হবে।’’

আরও একটি জল্পনার জন্ম হয়েছে যে, রাজ্যপাল রাজ্যের শিক্ষাক্ষেত্রে কোনও ভাবে কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপ চাইতে পারেন কি না! এই প্রসঙ্গে কংগ্রেসের আইনজীবী নেতা অরুণাভ ঘোষ বলেন, ‘‘এখনও পর্যন্ত এমন কিছু কোথাও হয়েছে শুনিনি। কেন্দ্র কী-ই বা হস্তক্ষেপ করবে?’’ একই সঙ্গে ব্রাত্যের বিরুদ্ধে ‘অ্যাকশন’ জল্পনা নিয়ে অরুণাভ বলেন, ‘‘তাঁকে অপমান করা হয়েছে বলে মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি দিয়ে নালিশ জানাতেই পারেন। কিন্তু কোনও মন্ত্রীকে সরানোর মতো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না রাজ্যপাল। তবে এই রাজ্যপাল ঠিক কী চাইছেন বুঝতে পারছি না। উনি অনেক কিছুই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে করছেন। ফলে সংবিধানের সঙ্গে ওঁর আচরণ মিলছে না অনেক সময়েই।’’

একই প্রশ্নের উত্তরে অনেকটাই আক্রমণাত্মক উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য ওমপ্রকাশ মিশ্র। শিক্ষা দফতরের সঙ্গে আলোচনা না-করেই বোস উপাচার্য পদ থেকে আচমকা সরিয়ে দিয়েছিলেন ওমপ্রকাশকে। শনিবার মধ্যরাতের চিঠি প্রসঙ্গে ওমপ্রকাশ বলেন, ‘‘হুমকির সুরে উনি রাজ্যবাসীকে জানিয়েছিলেন মধ্যরাতে তিনি অ্যাকশন নেবেন। জানা গেল না তিনি কী অ্যাকশন নিলেন। সবাইকে জাগিয়ে রেখে উনি মনে হয় ঘুমোতে চলে গেলেন। রাজভবনের থেকে সবাইকে জানানো উচিত ছিল। এটা এক ধরনের হেঁয়ালি এবং প্রতারণা বলব আমি। আর উনি যে আইনের ঊর্ধ্বে নন এই ব্যাপারটা রাজ্যবাসী এবং বিশিষ্টেরা মাঠে নেমে স্পষ্ট করে দিয়েছেন।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

CV Ananda Bose West Bengal
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE