ইটের ঘায়ে আহত পুলিশ কর্মী। নিজস্ব চিত্র
গ্রিলের গেটের বাইরে কয়েকশো তৃণমূল কর্মী ক্ষোভে ফুঁসছে। আর তালাবন্ধ গেটের ভিতরে থানায় বসে ভয়ে কাঁপছেন কিছু পুলিশকর্মী।
রবিবার বিকেল। থানার নাম চণ্ডীপুর। কিছু আগেই থানার অদূরে যুব তৃণমূলের সভামঞ্চে সপাট চড় খেয়েছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। ওই ঘটনার জেরেই এ দিন তৃণমূলের রোষের সাক্ষী রইল পূর্ব মেদিনীপুরের চণ্ডীপুর। হামলাকারী যুবককে নৃশংস মারধরের পাশাপাশি হল থানা ভাঙচুর। আক্রান্ত হলেন পুলিশকর্মীরা। প্রাণ বাঁচাতে মহিলা পুলিশকর্মীদের আশ্রয় নিতে হল থানা লাগোয়া বাড়িতে। যা অনেককেই মনে পড়িয়ে দিয়েছে সম্প্রতি কলকাতার আলিপুর থানায় তৃণমূলের তাণ্ডবের ঘটনাকে। এ দিন অবশ্য মারের হাত থেকে রেহাই পাননি সাংবাদিকেরাও।
এ দিন বিকেল পৌনে চারটে নাগাদ অভিষেককে চড়-ঘুষি মারার ঘটনাটি ঘটে। মুখ্যমন্ত্রী তথা দলনেত্রীর ভাইপোর গালে চড় বলে কথা! তাই আসরে নামতে দেরি করেননি তৃণমূল নেতা-কর্মীরা। যে যুবক মোবাইল ক্যামেরায় ছবি তোলার নাম করে মঞ্চে উঠে অভিষেককে মেরেছিলেন, সেই দেবাশিস আচার্যকে মঞ্চে ফেলেই শুরু হয় মারধর। পুলিশের উপস্থিতিতেই আইন হাতে তুলে নিয়ে প্রথমে শুরু হয় কিল, চড়, লাথি, ঘুষি। তার পর বাঁশ, লাঠি, এমনকী প্লাস্টিকের টেবিলের পায়া খুলে নিয়েও চলে বেধড়ক মারধর। ওই সময় অভিষেকের নিরাপত্তারক্ষীদেরও দেবাশিসকে মারধর করতে দেখা যায়। মারধর চলাকালীনই সভাস্থল ছেড়ে বেরিয়ে যান অভিষেক। কিছু নেতা থামানোর চেষ্টা করতে গিয়ে আক্রান্ত হন। হাতে চোট পান চণ্ডীপুরের তৃণমূল বিধায়ক অমিয়কান্তি ভট্টাচার্য, দলের স্থানীয় নেত্রী মিলা বেরা-সহ বেশ কয়েকজন। মঞ্চ থেকে বারবার ঘোষণা করেও কর্মীদের শান্ত করতে ব্যর্থ হন নেতারা।
ততক্ষণে রক্তাক্ত ওই যুবককে মঞ্চ থেকে লাথি মেরে নীচে ফেলে দিয়েছে তৃণমূল কর্মী-সমর্থকেরা। মার তারপরেও থামেনি। একটা সময় প্রাণে বাঁচতে কাঠের মঞ্চের নীচে ঢুকে পড়ার চেষ্টা করেন ওই যুবক। তবে লাভ হয়নি। টেনে-হিঁচড়ে সেখান থেকে বের করে ফের শুরু হয় গণপিটুনি। জুতো পায়ে ওই যুবকের মাথায় ঘনঘন আঘাত করা হয়। এই সময় ছবি তুলতে গিয়ে আক্রান্ত হন সাংবাদিকরা। আর ওই যুবককে রোষের হাত থেকে বাঁচাতে গিয়ে আক্রমণের মুখে পড়েন পুলিশকর্মীরা। সংবাদমাধ্যমের বেশ কয়েকজন প্রতিনিধির ক্যামেরা ভেঙে দেওয়া হয়। সব মিলিয়ে চার সাংবাদিক জখম হন। তাঁদের মধ্যে এক বৈদ্যুতিন চ্যানেলের প্রতিনিধিকে তমলুক হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে।
এ দিনের সভাস্থল চণ্ডীপুর ফুটবল ময়দান থেকে মাত্র একশো মিটার দূরেই চণ্ডীপুর থানা। শাসকদলের নেতা-কর্মীদের তাণ্ডবে পিছু হঠে পুলিশকর্মীরা সেই থানায় আশ্রয় নেন। তখন ইট ছুড়তে ছুড়তে থানা চত্বরে পৌঁছয় তৃণমূল কর্মী-সমর্থকেরা। শুরু হয় ভাঙচুর। ইটের ঘায়ে জখম হন তমলুকের এসডিপিও রাজ মুখোপাধ্যায়, নন্দকুমারের সিআই সুধারঞ্জন সরকার, চণ্ডীপুরের ওসি কল্যাণ ঘোষ-সহ জনা দশেক পুলিশ। শেষ পর্যন্ত থানার গেটে তালা ঝুলিয়ে ভেতরে সেঁধিয়ে যান পুলিশকর্মীরা। মহিলা পুলিশকর্মীরা ঠাঁই নেন আশপাশের বাড়িতে। জেলার অন্য থানা থেকে পুলিশবাহিনী এসে চণ্ডীপুরে পৌঁছয়। বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ পরিস্থিতি থিতোয়। বিকেলে ঘটনাস্থলে আসেন পূর্ব মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার সুকেশকুমার জৈন। তিনি বলেন, “পুলিশের উপর হামলার ঘটনার তদন্ত হচ্ছে। আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখছি।” এ দিনের ঘটনার রেশ গিয়ে পৌঁছয় অন্য জেলাতেও। কল্যাণী, কৃষ্ণনগর-সহ নদিয়ার একাধিক এলাকায় অভিষেককে চড় মারার প্রতিবাদে বিক্ষোভ-অবরোধে সামিল হন তৃণমূল কর্মীরা।
চণ্ডীপুরের ঘটনায় এক দিকে তৃণমূলের কোন্দল আর অন্য দিকে দলের বিশৃঙ্খল অবস্থা দায়ী বলে অভিযোগ বিরোধীদের। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু বলেন, “ঘটনাটি তৃণমূলের দলীয় দ্বন্দ্বের বহিঃপ্রকাশ। তৃণমূলের মুষল পর্বের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে এতে।” বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের কথায়, “এই ঘটনা প্রমাণ করল তৃণমূলের লোকজন কী ভাবে আইন হাতে তুলে নিচ্ছেন।” তৃণমূলের তরফে কর্মী-সমর্থকদের তাণ্ডবের ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। চণ্ডীপুরের বিধায়ক অমিয়বাবু (যিনি নিজেও উত্তেজিত সমর্থকদের থামাতে গিয়ে আক্রান্ত) বলেন, “জেলায় মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপোর প্রথম সভা ছিল। সকলে তাঁর বক্তব্য শুনতে উদগ্রীব ছিলেন। কিন্তু এই ঘটনায় (অভিষেকের চড় খাওয়া) কর্মী-সমর্থকেরা উত্তেজনায় মাথা ঠিক রাখতে পারেননি।” তাই বলে পুলিশ, সাংবাদিকদের আক্রমণ? এ বার মুখে কুলুপ এঁটেছেন জেলার তৃণমূল নেতৃত্ব। দলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “একটা ঘটনা ঘটেছে। তার প্রতিক্রিয়ায় কিছু ঘটতে পারে। না জেনে কিছু বলব না।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy