Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
Religion

‘আপন-পর’ চেনাল করোনা

দক্ষিণ কলকাতার যৌথ পরিবারে বেড়ে ওঠা সামারা বেলেঘাটা আইডি হাসপাতালের কোভিড ওয়ার্ডে কাজ করার সময়ে করোনায় সংক্রমিত হন।

ললিতা বসাক। নিজস্ব চিত্র

ললিতা বসাক। নিজস্ব চিত্র

সৌরভ দত্ত
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৯ জুন ২০২০ ০২:৫৪
Share: Save:

রোগমুক্তির স্বস্তি দ্রুত মানসিক বিপর্যয়ে পরিণত হতে সময় লাগেনি।

অভিযোগ, সুস্থ হওয়ার পরেও পরিস্থিতির চাপে করোনা রোগীকে বাড়ি ফিরতে দেননি পরিজনেরাই। ওই ঘটনায় সরকারি হাসপাতালের নার্স সামারা খান (নাম পরিবর্তিত) মাানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। কঠিন সময়ে তাঁর পাশে দাঁড়ান আর এক করোনা রোগী। বেলেঘাটা আইডি- হাসপাতালেই ভর্তি থাকার সময়ে তাঁদের পরিচয়। পেশায় সরকারি হাসপাতালের নার্স ললিতা বসাক নামে ওই তরুণীর ফ্ল্যাটেই আশ্রয় পান সামারা। নাম-পদবি-ছোঁয়াচে মনের দূরত্ব ঘুচিয়ে জিতল সেবা ধর্ম।

দক্ষিণ কলকাতার যৌথ পরিবারে বেড়ে ওঠা সামারা বেলেঘাটা আইডি হাসপাতালের কোভিড ওয়ার্ডে কাজ করার সময়ে করোনায় সংক্রমিত হন। করোনা ওয়ার্ডে কর্তব্যরত চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীদের একটা সময়ের পরে ১৪ দিনের জন্য কোয়রান্টিনে পাঠানো হয়। সাত দিন হস্টেলে কাটিয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন সামারা। তখন এক বার তাঁর জ্বর হলেও এক দিনে কমে যায়। সপ্তাহখানেক পরে হাসপাতালে কাজের সময়ে আবার কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে। পরের দিন তরুণীকে করোনা পরীক্ষা করাতে পরামর্শ দেন আইডি-র চিকিৎসক কৌশিক চৌধুরী। দু’ দিন পরে বাড়িতে থাকাকালীনই তরুণী জানতে পারেন, তিনি করোনা পজ়িটিভ। পরিবারের লোকজনের হেনস্থা এড়াতে বাড়ির সামনে সরকারি অ্যাম্বুল্যান্স ডাকেননি সামারা। পাড়ার রাস্তার মোড় থেকে অ্যাম্বুল্যান্সে উঠে আইডি পৌঁছন তিনি।

আরও পড়ুন: আত্মীয়তায় বাঁধা পড়ে এ শহরই চিনাদের ভাল-বাসা

দিন তিনেক পরে আইডিতেই ভর্তি হন স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিনের নার্স ললিতা। মালদহের বাসিন্দা ললিতা উত্তর শহরতলিতে নিজের ফ্ল্যাটে একাই থাকেন। আরটি-পিসিআরে নমুনা পরীক্ষার রিপোর্ট নেগেটিভ আসার পরে গত ২৬ মে দু’জনকে ছুটি দেওয়া হবে বলে জানিয়েছিল আইডি। চিকিৎসকদের পরামর্শ ছিল, ছুটির পরে বাড়িতে কিছু দিন বিশ্রামে কাটিয়ে তাঁরা যেন কাজে যোগ দেন।

ছুটির আগের রাতে মাকে ফোন করে আইডি-র নার্স জানতে পারেন তাঁর বাড়ি ফেরা নিয়ে যৌথ পরিবারের অন্য সদস্যদের আপত্তি আছে! সামারার অভিযোগ, আক্রান্ত অবস্থায় তিনি বাড়িতে যাওয়ায় প্রতিবেশীদের একাংশ ভর্ৎসনা করেন তাঁর পরিবারের লোকজনকে। অবশ্য পড়শিদের একাংশ সামারাদের পাশেও দাঁড়ান। সেই ঘটনাকে ঘিরে মেয়েকে বাড়ি ফিরতে বারণ করা হয়। যৌথ পরিবারের এক সদস্য তরুণীকে জানান বাড়ির বয়স্ক মানুষদের নিরাপত্তার কারণেই তিনি যেন আগামী দু`-তিন মাস না ফেরেন!

আরও পড়ুন: বিক্রি নেই, ভয়েই রথের চাকা ‘বসে গিয়েছে’

সামারা বলেন, ‘‘পড়শিদের চাপে নিজের লোক আমায় বাড়ি ফিরতে বারণ করছেন শুনে মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছিলাম। রাতে ঘুম আসত না। কান্নাকাটি করতাম। মানসিক চাপে মনে হত আমার কিছু একটা হয়ে যাবে!’’

কিন্তু সামারার কিছু হতে দেননি ললিতা। সামারার অসহায় অবস্থার কথা শুনে তিনি তাঁকে নিজের উত্তর শহরতলির ফ্ল্যাটে থাকার জায়গা দেন। এই সিদ্ধান্তে পাশে দাঁড়ান তাঁর পরিবারের সদস্যেরাও। ললিতার কথায়, ‘‘আইডি-র চিকিৎসকও ফোনে সামারার পরিবারের সঙ্গে কথা বলে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন যে সুস্থ হওয়ার পরে রোগীর থেকে ভাইরাস ছড়ানোর নজির নেই। কিন্তু লাভ হয়নি।’’

সামারা এখন কাজে যোগ দিয়েছেন। দু’জনেই এখন বন্ধু। কিন্তু কর্মস্থলেও সহকর্মীদের একাংশের আচরণে বিস্মিত সামারা। তাঁর কথায়, ‘‘আমার বাড়ির লোকেরা তো এ বিষয়ে অজ্ঞ। কিন্তু স্বাস্থ্য পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত হয়েও হস্টেলের কিছু সিনিয়র এমন ভাব করছেন যেন আমি অচ্ছুৎ!’’ এ প্রসঙ্গে ললিতা বলেন, ‘‘এ তো জন্মগত রোগ নয়। যাঁরা এমন আচরণ করছেন তাঁদের এই রোগ হবে না, সে নিশ্চয়তা কোথায়?’’

সুস্থ হয়ে ওঠা করোনা রোগীদের এমন সমস্যার কারণেই বেলেঘাটা আইডি হাসপাতালে ‘পোস্ট করোনা ক্লিনিক’ চালু হয়েছে। আইডি-র চিকিৎসক সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, করোনাভাইরাস যত না মারাত্মক তার চেয়ে অনেক বেশি বিপজ্জনক রোগীর আশপাশের লোকজনের আচরণ। তাঁর কথায়, ‘‘চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য থালা, করতালি, পুষ্পবৃষ্টি বা মোমবাতি জ্বালানোর প্রয়োজন নেই। সরকারি হাসপাতালের দুই নার্স সম্প্রীতির পথে যে দৃষ্টান্ত তৈরি করলেন সেটাই আসল।’’

বেলেঘাটা আইডি হাসপাতালের অধ্যক্ষা অণিমা হালদার জানান, বাড়িতে ফিরতে সমস্যার কথা জানার পরে ওই নার্সকে হস্টেলে রাখার কথা ভাবা হয়েছিল।

কিন্তু নার্সিং হস্টেলের নার্সদের একাংশ তা নিয়ে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন। অধ্যক্ষা বলেন, ‘‘নার্সেরা সব জেনেও যদি বিক্ষোভ দেখান তা হলে বলার কিছু নেই। সকলে সচেতন না হলে এই রোগে আক্রান্তেরা সুস্থ হয়ে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়বেন।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Religion Coronavirus in West Bengal Nurse
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE