Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

নিজের সেই মহল্লাতেই বিস্মৃত গওহর

নবসজ্জিত নাখোদা মসজিদের ঠিক পাশে, সাবেক সালেহজি মুসাফিরখানার উল্টো ফুটপাতে আজকের ৯২ নম্বর রবীন্দ্র সরণি!

গওহর জান।

গওহর জান।

ঋজু বসু
শেষ আপডেট: ২৭ জুন ২০১৮ ০২:৫২
Share: Save:

গুগলের তল্লাশির পাতায় তখন রানির মতো আদরের বেড়াল কোলে বসে রয়েছেন তিনি! মঙ্গলবার, ‘ভারতের বুলবুল’ গওহর জানের ১৪৬তম জন্মদিনের সকালে তাঁর চিৎপুরের বাড়ি জুড়ে দিনেই অনন্ত অন্ধকার।

নবসজ্জিত নাখোদা মসজিদের ঠিক পাশে, সাবেক সালেহজি মুসাফিরখানার উল্টো ফুটপাতে আজকের ৯২ নম্বর রবীন্দ্র সরণি! কলকাতা পুরসভার হেরিটেজ কমিটির এক পুরনো সদস্য বলছিলেন, ‘‘অগুনতি ভাড়াটে গাদাগাদি করে থাকা আখাম্বা বাড়িটায় হাত দিলেই ফ্যাসাদে পড়তে হত! ইতিহাস ঘাঁটাঘাঁটির ঝুঁকি তাই এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।’’ সে-দিনের ‘গওহর বিল্ডিং’ নামটা তবু এখনও মুখে-মুখে লেগে!

এমনিতে অবশ্য নাম পাল্টে গিয়েছে পুরনো বাড়ির। ইংরেজি-উর্দুতে লেখা ‘সেলিম মঞ্জিল’। তবু নীচেই মোরাদাবাদি বাসনের দোকানদার কিংবা বাড়ির দারোয়ান তথা পানওয়ালা জ়াকিউর রহমান বললেন, ‘গওহর বিল্ডিং’-শব্দটা! গ্রামোফোন যুগে এ দেশের প্রথম কণ্ঠস্বর ঠুংরি-সম্রাজ্ঞী গওহর জানের কথা জিজ্ঞেস করলে অবশ্য ফ্যালফ্যাল করে চাইবেন ওঁরা! তার পরে বলবেন, ‘‘ও আচ্ছা, ‘তবায়েফ’ গওহর জানের কথা বলছেন?’’

শতবর্ষ আগে ওই বাড়ির পুরোটাই ছিল গওহরের মালিকানা। সাফল্যের চুড়োয় বসে তখন তিনি ফি-সন্ধ্যায় ছয় ঘোড়ার ফিটনে ময়দানে বেড়াতে বেরোন। রেশমি পর্দা ঢাকা সেই গাড়ির আদল রথের মতো! জনৈক বাইজির এই ঠাটবাটে বিরক্ত হয়ে কোনও ইংরেজ রাজপুরুষ না কি গওহরকে ১০০০ টাকা জরিমানা করেছিলেন, গওহর সেই টাকা কড়কড়ে নগদে কার্যত তাঁর মুখে ছুড়ে মারেন।

অনাদর: নাখোদা মসজিদ লাগোয়া এই বাড়িতেই থাকতেন গওহর জান। নিজস্ব চিত্র

শোনা যায়, গওহরের পুষ্যি বেড়ালের বিয়েতে সে যুগে ১২০০ টাকা ব্যয় হয়েছিল। বেড়ালের সন্তান লাভে ২০ হাজার টাকায় গোটা শহরকে আপ্যায়ন করেছিলেন বিত্তশালী বাইজি। আজকের‘গুগল ডুডল’ ও সেই বেড়াল-বিলাসিনী নারীর গল্পই বলছে। বিক্রম সম্পতের গওহর-জীবনী‘আমার নাম গওহর জান’ সাক্ষী ডাকসাইটে সঙ্গীত শিল্পীর সেই সব সোনালি দিনগুলো চিৎপুরের এই বাড়িতে থাকার সময়েই। কিন্তু এ দিন দুপুরের গওহরের বাড়ি শুধু বিস্মরণে ডুবে।

বর্ষার দিনে নোনাধরা বাড়ির একমাত্র সিঁড়িটা তখন টইটম্বুর। মোবাইলের আলো জ্বেলে পা টিপে টিপে তিন-চারতলা ওঠা গেল। চিলতে ঘরে আধশোওয়া গামছা-লুঙ্গির কারবারি পারভেজ আলম বললেন, তিনি মায়াবতীর ভোট-যুদ্ধের ময়দান আকবরনগরের লোক! বাড়ির কাছেই রাম জন্মভূমি বাবরি মসজিদ! হালের রাজনীতির তপ্ত রঙ্গভূমির পাশে সেকেলে তবায়েফের কিস্সা পারভেজসাহেবের কাছে নেহাতই পানসে মনে হল।

নাখোদা মসজিদের এই পাড়ায় এলে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের তবু ‘গওহর বিল্ডিং’ চেনাতেই হয় ‘ক্যালকাটা ওয়াক’-এর গাইড ইফতিকার আহসানকে। ‘দ্য ডান্সিং গার্ল গওহর জান’ নাটক তৈরির সময়েও এ তল্লাটে আসতে হয়েছিল পরিচালক ঋষি মুখোপাধ্যায়-স্বাগতা মুখোপাধ্যায়দের। উত্তরপ্রদেশের আজ়মগড়, বারাণসী হয়ে মা মালকা জানের সঙ্গে মেটিয়াবুরুজে ওয়াজ়িদ আলি শাহের সভায় গওহরের গাইতে আসার অধ্যায়টি সম্প্রতি ওয়াজ়িদ আলি শাহকে নিয়ে তাঁর উপন্যাস ‘আখতারনামা’-য় ধরেছেন লেখক শামিম আহমেদ। মেটিয়াবুরুজ, চিৎপুরের ওই বাড়ি ছাড়া ফ্রি স্কুল স্ট্রিটেও ছড়িয়ে আছে গওহরের কলকাতা অধ্যায়। প্রাক্তন স্বামী আব্বাসের সঙ্গে মামলা মোকদ্দমায় সর্বস্বান্ত হয়ে চিৎপুরের বাড়িটা একদিন চোখের জলে ছাড়তে হয়েছিল ভারতের গানের রানিকে। মহীশূরের রাজার ডাকে শেষমেশ চিরতরে কলকাতাই ছাড়তে বাধ্য হন গওহর।

চিৎপুরের মহল্লা জুড়ে অনাদর ও বিস্মৃতির অন্ধকার যেন এখনও সেই ট্র্যাজেডির কথাই বলে চলেছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Gauhar Jaan
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE