পাশাপাশি: পার্ক সার্কাসের প্রতিবাদস্থলে নজর কাড়ছে খুদেরাও। জমায়েতে আনাস (নীচে)। ছবি: সুমন বল্লভ ও নিজস্ব চিত্র
পাড়ার ‘যেমন খুশি সাজো’ প্রতিযোগিতায় কপালে তিলক কাটা ব্রাহ্মণ সেজেছিল সাত বছরের মহম্মদ আনাস আনসারি। ‘হিন্দু’, ‘মুসলিম’, ‘শিখ’, ‘খ্রিস্টান’ সেজে পাশাপাশি দাঁড়ানো ছেলেমেয়েরা একটি ভিডিয়োয় ‘আমরা সবাই ভারতীয়’ বলে চেঁচিয়ে উঠছে। বুধবার, মধ্যরাত পার করা পার্ক সার্কাস ময়দান আনাসের বাবার ফোনে কাড়াকাড়ি করে সেই ছবি দেখছিল।
কলকাতার ‘শাহিনবাগ’, পার্ক সার্কাস ময়দানে অবস্থানের দ্বিতীয় রাতে গার্ডেনরিচের মুদিয়ালির বাসিন্দা, সদ্য ক্লাস টু-তে ওঠা আনাসই যেন নায়ক হয়ে উঠল। একরত্তি তিন ফুটিয়া খুদে টরটরিয়ে শোনাল, এনআরসি হল ‘ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজ়েন্স’। তার চিকন গলার স্লোগানে মন্ত্রমুগ্ধ রাত জাগা প্রতিবাদী জমায়েত। আনাস বলছে, ‘পুলিশ বুলাও’, ‘ডান্ডে মারো’ বা ‘লড়কে লেঙ্গে’। ভিড়টা দুলে দুলে গাইছে ‘আজাদি’। আনাস বলছে, ‘ডাউন ডাউন’, ভিড় বলছে ‘সিএএ’, ‘এনআরসি’ বা ‘এনপিআর’! তার পিঠোপিঠি বোন মদিহাও সমানে ছোট্ট দু’হাতে হাততালি দিচ্ছে। কে বলবে, রাত তখন আড়াইটে! রাত যত বাড়ছে, পার্ক সার্কাসে প্রতিবাদের উৎসবের আমেজও তত ঘন হচ্ছে।
নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধানের ভিড়ে সুর একটাই! এত দিন যাদবপুর, কলেজ স্ট্রিট বা পাড়ায় পাড়ায় সভা-মিছিল হলেও শহরের একটা বাঁধা ধরা প্রতিবাদস্থল খুব দরকার হয়ে পড়েছিল। পার্ক সার্কাসের মাঠ এখন সেই টাটকা অক্সিজেন নেওয়ার ঠিকানা। যখন খুশি, ২৪ ঘণ্টাই যেখানে এসে পাশের সমব্যথীর হাতে হাত রাখা যাবে।
পড়ুয়াদের লেখা নাটকে সচেতনতার পাঠ
ইতিহাস, সাহিত্য, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের একঝাঁক পড়ুয়ার আলোচনায় তখন দেশের ইতিহাসের এক শতক আগের সন্ধিক্ষণ। লর্ড কার্জনের আমলের বঙ্গভঙ্গে হিন্দু-মুসলিম ঐক্য নিয়ে ‘লোকহিত’ প্রবন্ধে আক্ষেপ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। হিন্দু, মুসলিম একসঙ্গে লড়লেও মনের বাধা কাটিয়ে পুরোপুরি এক হতে পারেনি। জল খাওয়ার সময়ে হিন্দু ব্যক্তিটি তাঁর মুসলিম সহযোদ্ধাকে দাওয়া থেকে নেমে যেতে অনুরোধ করতেন। ওই রাতে ব্রাইট স্ট্রিটের বধূ তবসুম এসে অ-মুসলিম তরুণীদের একটি দলকে আপ্লুত স্বরে বলেছেন, ‘‘মোদী-শাহকে ধন্যবাদ। ওঁদের ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ ছাড়া তোদের সঙ্গে কখনও এমন ভাব হত না।’’ রিপন স্ট্রিটের গ্রহরত্নের কারবারি আব্দুল জামিল শোনাচ্ছেন, ‘‘আমার কিন্তু স্কুলে বাংলা থার্ড ল্যাঙ্গুয়েজ ছিল। এখনও মুখস্থ, আমাদের ছোট নদী চলে...!’’
শেষ রাতে মানুষের জটলা থেকে ভেসে এল, ‘আমরা করব জয়’ আর ফৈয়াজ় আহমেদ ফৈয়াজ়ের ‘হম দেখেঙ্গে’। নৌ অফিসারের পুত্র রেবন্ত লোকেশ সিয়্যাটলে দিদিকে ভিডিয়ো কল করে গর্বের কলকাতা দেখাচ্ছেন। রিপন স্ট্রিট-পার্ক সার্কাসের বিভিন্ন ক্লাবের ছেলেমেয়েরা ‘শিফট ডিউটি’র ঢঙে বিস্কুট-জল-কম্বল নিয়ে আসছিলেন। মাঠের বাইরে ধূমপান করতে যাওয়া তরুণী ছাত্রীদের চা খেতে অনুরোধ করলেন পাড়ার প্রবীণেরা। শীতের দাপাদাপি সে উত্তাপের কাছে হেরে ভূত। স্থানীয় মুসলিম মহল্লার বাসিন্দারা একসঙ্গে বসার ডাক দিলেও এ প্রতিবাদ সংশয়াতীত ভাবেই সবার প্রতিবাদ।
আবার গোটা দেশের প্রতিবাদী স্রোত যে খাতে বয়েছে, তার থেকে আলাদাও নয় পার্ক সার্কাস। স্লোগান বলছে, ‘ভারত কে মহিলাওঁ নে রাস্তা দিখায়া হ্যায়!’ নেতৃত্বে তো মেয়েরাই! স্লোগান ডাকছে, ‘চুড়ি পহেনকে’, ‘বোরখা পহেনকে’ বা ‘জিন্স পহেনকে’! ভিড় বলছে, ‘হল্লা বোল’। সংস্কৃত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী সুদেষ্ণা দত্তগুপ্ত বা হাজরা আইন কলেজে সাংবিধানিক আইন ও মানবাধিকার নিয়ে এমএলবি পাঠরত শাফকাত রহিমদের মেধাদীপ্ত তেজের বিচ্ছুরণও পার্ক সার্কাসের মাঠময়। গ্রামীণ ভারত বিষয়ক একটি ওয়েবসাইটের আধিকারিক, দু’দশক আগে যাদবপুরের প্রাক্তনী স্মিতা খাটোর শাফকাতকে জড়িয়ে ‘আমি তোর ফ্যানগার্ল’ বলে মাঝরাতে ছবি তুললেন। ভোর পাঁচটায় মাঠ ছাড়ার সময়েও সেখানে তখন নানা বয়সের ভিড়।
কিন্তু শুধু গান, স্লোগানে নাগাড়ে কত দিন উদ্যম ধরে রাখবেন প্রতিবাদীরা? ‘‘পরের দিন এসে ‘মুক্তির মন্দির সোপানতলে’ আর ‘ভারত আমার ভারতবর্ষ’ গাইব ঠিক!’’— স্কুটার বা অ্যাপ-ক্যাবে বাড়িমুখো কয়েক জনের স্বর কানে ভেসে এল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy