Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

বাড়ি বসেই পড়ার আনন্দ হোম স্কুলিংয়ের মাধ্যমে

একটা সময়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরও যে স্কুলে যেতে এক্কেবারে ভাল লাগত না। প্রগতিশীল জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে বালক রবির জন্য বিকল্প শিক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন গুরুজনেরা। সেই বাড়িতে পড়াশোনা বা ‘হোম স্কুলিং-এর ধারাকে আঁকড়ে ধরেছে এ শহরের কিছু পরিবার।

পড়াশোনা: অভিভাবকদের কাছে এ ভাবেই চলছে হোম স্কুলিং। নিজস্ব চিত্র

পড়াশোনা: অভিভাবকদের কাছে এ ভাবেই চলছে হোম স্কুলিং। নিজস্ব চিত্র

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০২:১০
Share: Save:

শেখাটাই আসল, স্কুলটা নয়। স্কুলের চার দেওয়ালে ঘণ্টা-বাঁধা নিয়মকানুনের মধ্যে এক জন পড়ুয়া প্রকৃত জ্ঞান অর্জন না-ও করতে পারে। তার দমবন্ধ লাগতে পারে, ক্লান্তি আসতে পারে। ফলাফলের প্রতিযোগিতায় সে হাঁপিয়ে উঠতে পারে। গ্রেডের লড়াইয়ে পিছিয়ে পড়ে চিরকালের মতো পড়াশোনায় আতঙ্ক তৈরি হতে পারে।

একটা সময়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরও যে স্কুলে যেতে এক্কেবারে ভাল লাগত না। প্রগতিশীল জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে বালক রবির জন্য বিকল্প শিক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন গুরুজনেরা। সেই বাড়িতে পড়াশোনা বা ‘হোম স্কুলিং-এর ধারাকে আঁকড়ে ধরেছে এ শহরের কিছু পরিবার। তাদের শিশুরা স্কুলে যায় না। বাড়িতেই তারা শিক্ষিত হচ্ছে। যখন যা পড়তে ইচ্ছে করছে, তা-ই তারা পড়ছে। যেমন ষষ্ঠ শ্রেণির স্তরের পড়ুয়া চাইলে দশম শ্রেণির পদার্থবিদ্যার বই পড়ে। এই ধারাকে ঘিরে তৈরি হয়েছে হোম স্কুলারদের একাধিক হোয়াটস অ্যাপ এবং ফেসবুক গ্রুপও।

সন্তানের জন্য এই পথ বেছে নেওয়া শ্রদ্ধা গর্গ, সৌরভ সরকার, অন্যা কাশ্যপ, ঈশা ভোডেলার মতো অনেকেই জানালেন, ‘হোম স্কুলিং’ ধারণাটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপে বেশ জনপ্রিয়। এমনকি মুম্বই, পুণে, বেঙ্গালুরুর মতো শহরেও অনেকেই এ ভাবে পড়াশোনা শেখাচ্ছেন সন্তানদের। কিন্তু এ শহর এখনও তেমন পরিচিত নয় এই পদ্ধতির সঙ্গে। এখানে অনেকেই ভাবেন, অসুস্থ শিশুরাই বাড়িতে বসে পড়াশোনা শেখে এবং এর কোনও ভবিষ্যৎ নেই।

অথচ, হোম স্কুলিংয়ের পরে দশম শ্রেণির স্তরে ‘ইন্টারন্যাশনাল জেনারেল সার্টিফিকেট অব সেকেন্ডারি এডুকেশন’ (আইজিসিএসই)-এর পরীক্ষা বা ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ওপেন স্কুলিং’-এর (এনআইওএস) পরীক্ষায় বসে শংসাপত্র পাওয়া যায়। চলতি বছর ১২ জানুয়ারি মহারাষ্ট্র সরকার হোমস্কুলিংয়ের আলাদা বোর্ড চালু করার কথা ঘোষণা করেছে। এই বোর্ডে বাড়িতে পড়াশোনা করেই ছাত্রেরা পঞ্চম শ্রেণি, অষ্টম শ্রেণি ও দশম শ্রেণি স্তরের পরীক্ষা দিয়ে ও শংসাপত্র পাবে।

নিউ টাউনের বাসিন্দা নির্মাণ সরকার মাত্র বছর দুই আগে খড়্গপুর আইআইটিতে ভর্তি হয়েছেন। তাঁর বাবা সৌরভ সরকার নিজেও ওই আইআইটির ছাত্র ছিলেন। জানালেন, গতানুগতিক পড়াশোনার ব্যবস্থায় আস্থা হারিয়ে পঞ্চম শ্রেণির পরে আর স্কুলে পাঠাননি ছেলেকে। সেই থেকে বাড়িতেই পড়াতেন নির্মাণকে। সারা জীবন হোম স্কুলিংয়ের পরেই নির্মাণ এখন আইআইটিতে পড়ছেন। তাঁর বোন সুহানা কখনওই স্কুলে যায়নি। বাড়িতেই তার পড়াশোনা। সৌরভের কথায়, ‘‘কেউ যদি বাড়িতেই সন্তানের জন্য স্কুলের মতো কিংবা উন্নততর শিক্ষার বন্দোবস্ত করতে পারেন, তবে কেন সন্তানকে স্কুলে পাঠাবেন?’’

তবে খেয়াল রাখা প্রয়োজন, কেমব্রিজ ইন্টারন্যাশনাল এডুকেশন-এর ‘আইজিসিএসই’ দিতে গেলে অনুমোদন লাগে। কেমব্রিজ ইন্টারন্যাশনাল এডুকেশন কর্তৃপক্ষের তরফে ই-মেলে জানানো হয়েছে, ভারতে কোনও হোমস্কুলার প্রাইভেটে পড়ে এই পরীক্ষায় বসতে চাইলে তাকে এ দেশের কোনও কেমব্রিজ স্কুলে রেজিস্ট্রেশন করাতে হবে। সব কেমব্রিজ স্কুল বাইরের পরীক্ষার্থী গ্রাহ্য করে না। কোন কোন কেমব্রিজ স্কুল করে, সেটা আগে জেনে নিতে হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া, কানাডার মতো বহু দেশে এই শংসাপত্র উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য। এ দেশের কয়েকটি কলেজও একে গ্রাহ্য করে। সমস্ত বড় আন্তর্জাতিক সংস্থা চাকরির ক্ষেত্রেও এই শংসাপত্রকে মর্যাদা দেয়। তবে ভারতে পরবর্তী উচ্চশিক্ষা ও চাকরির জন্য হোম স্কুলারদের পক্ষে তুলনায় সুবিধাজনক এনআইওএস-এর পরীক্ষা।

হোম স্কুলার সিদ্ধান্ত শ্রী ভোডেলার মা ঈশার কথায়, ‘‘আমাদের সমাজে বিকল্প শিক্ষা পদ্ধতির গ্রহণযোগ্যতা আরও বাড়াতে হবে। সবাই যে পড়াশোনা নিয়েই ভবিষ্যতে কিছু করবে, এমন না-ও হতে পারে। কেউ নাচ নিয়ে থাকতে চায়, কেউ খেলা বা আঁকা নিয়ে। তাতেই সে ছোটবেলা থেকে বেশি সময় ও মন দেবে। পাশাপাশি, ন্যূনতম পড়াশোনার জন্য হোম স্কুলিং আদর্শ।’’ সম্ভবী দাস, আদ্যা দাস, আর্শ কাশ্যপ, আইরা, সিদ্ধান্ত শ্রীদের ঘড়ির কাঁটা, স্কুল বাস, টিউশন আর সিলেবাসের সঙ্গে দৌড়তে হয় না।

তবে শিক্ষার এই নতুন ধারার উপযোগিতা নিয়ে নিশ্চিত নন শহরের অনেকেই। লেক টাউনের বাসিন্দা, পেশায় চিকিৎসক অহনা চট্টোপাধ্যায়ের মতে, স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই কর্মরত হলে এবং বাড়িতে অন্য অভিভাবক না থাকলে কোনও ভাবেই হোম স্কুলিং সম্ভব নয়। এর জন্য এক জনকে সব সময়ে বাড়িতে থাকতে হবে। এখনকার দিনে অনেকের পক্ষেই তা অসম্ভব। বালিগঞ্জের সিভিল ইঞ্জিনিয়ার বিনোদ সামন্ত আবার বলেন, ‘‘স্কুলে সমবয়সিদের সঙ্গে মেলামেশাও শৈশবের অঙ্গ। হোম স্কুলিংয়ে শিশু তার থেকে বঞ্চিত হবে।’’ গড়িয়ার গৃহবধূ রীমা শ্রীনিবাসনের আবার অন্য চিন্তা। তিনি বলেন, ‘‘পরবর্তী সময়ে উচ্চশিক্ষায়, প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় বা চাকরির ক্ষেত্রে অন্তত ভারতে হোম স্কুলারেরা কতটা গুরুত্ব পাবে, সে বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Education Student Home Schooling
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE