Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

‘পিঠে’ খেলে শহর সয়, এটাই শীতের সত্যি

দোসা বা ইডলির কথা ছেড়ে দিন! দক্ষিণ ভারতের চালের রুটি ‘আপ্পাম’-এর অবধি ফি-বছর দেখা মিলবে এ শহরে। কিন্তু সরুচাকলি নৈব নৈব চ। বহু বাঙালি জানেনই না, আপ্পাম আর সরুচাকলিতে আদতে ফারাক নেই।

ঋজু বসু
শেষ আপডেট: ২৫ জানুয়ারি ২০১৫ ০০:০১
Share: Save:

দোসা বা ইডলির কথা ছেড়ে দিন! দক্ষিণ ভারতের চালের রুটি ‘আপ্পাম’-এর অবধি ফি-বছর দেখা মিলবে এ শহরে। কিন্তু সরুচাকলি নৈব নৈব চ। বহু বাঙালি জানেনই না, আপ্পাম আর সরুচাকলিতে আদতে ফারাক নেই।

শীতের কলকাতার জন্য এমন অনেক বিস্ময় অপেক্ষা করে আছে। পৌষের শেষে কসবার রাজডাঙা মাঠের মেলায় দেখা হয়েছিল আমিনা খান, নমিতা দাসদের সঙ্গে। আমিনা বাসন্তীতে বাপের বাড়ির থেকে নতুন আলোচালের গুঁড়ি নিয়ে এসেছেন। এই চালের গোলা তপ্ত চাটুর উপরে হাত দিয়ে ছুড়ে-ছুড়ে যে পিঠে হয় তার নাম, হাতছোড়া পিঠে। অবিকল ম্যাঙ্গালোরের নির দোসার মতো। কোস্টাল বা দক্ষিণ ভারতীয় খানার রেস্তোরাঁয় যে কোনও আমিষ-নিরামিষের সঙ্গে এই ফিনফিনে রুমালের মতো দোসা দিব্যি খেতে শিখেছে বাঙালি। আমিনা হাতছোড়া পিঠে দিলেন আলুরদমের সঙ্গে।

নমিতার চিতুই বা আস্কে পিঠে ইডলির তুতো ভাই।

ভবানীপুরে বলরামের দোকানেও ক’দিন ধরে নিয়মিত সরুচাকলি ও আস্কে পিঠে হচ্ছে। আলুর তরকারি বা ডুবু-ডুবু নলেনগুড়— যা খুশি মাখিয়ে খান। ইতিহাসবিদ্ তপন রায়চৌধুরী এই আস্কে পিঠের সঙ্গে বিলেতের বিফস্টেকের তুলনা করেছিলেন। ইংরেজদের সংস্কৃতির সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য বিফ স্টেকের মতোই বঙ্গজীবনে একদা অঙ্গাঙ্গী ছিল আস্কে পিঠে। পাড়াগাঁয়ে বিশেষ করে পূর্ব বাংলার ঘরে-ঘরে ভেতো বাঙালি তিন বেলা ভাত খাবে। শীতের প্রাতঃরাশ হল, নতুন চালের পিঠে। আস্কে পিঠের সঙ্গে কই মাছের বিরান (ঝোল), ছোলার ডাল বা মাংসের ভুনাও হতে পারে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। বয়স্ক বা ছোটদের জন্যও রাতে সহজপাচ্য সরুচাকলির ডায়েট স্বীকৃত ছিল।

এ কালের শহুরে বাঙালি কিন্তু পিঠের হ্যাংওভার কাটিয়ে উঠেছে। “শহরে অনেক বিকল্প। লুচি-কচুরি থেকে শুরু করে ফাস্টফুডের দাপটে পিঠের মহিমা ফিকে।” —বললেন শোভাবাজার রাজবাড়ির গিন্নি নন্দিনী দেববৌরানি। তবে বনেদি-বাড়ির মরসুমি পিঠে চর্চায় ফাঁকি নেই। পৌষ-পার্বণে ধানের শীষের বাউনি বেঁধে মা-লক্ষ্মীকে খুশি করার পরে পাটিসাপ্টা, গোকুল পিঠে, রসবড়া, রাঙা আলুর পিঠের আয়োজন।

তবু এ মরসুমে কিছু মিষ্টির দোকান, রেস্তোরাঁ এবং বিভিন্ন মেলা প্রাঙ্গণই শহরে পিঠের ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রেখেছে। হাবড়ার ফুলতলির সুনীতা দাস এনামাদ্রি বা কৃষ্ণনগরের গৌরাঙ্গ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের পিঠে-কারিগরদের তাই শীতে ঘরে ফেরার জো নেই। জন্মসূত্রে তেলুগুভাষী, বাঙালি গিন্নি সুনীতা ও তাঁর স্বনির্ভর গোষ্ঠীর দলবল, কখনও বিধাননগরের মেলা, কখনও বা দমদমের খাদ্য-উৎসবে ঘুরছেন। শহরবাসীর চোখের সামনে ঢেঁকিতে পাড় দিয়ে ছাঁটা চালে লাইভ আস্কে পিঠে তৈরি হচ্ছে। গ্রাম থেকে শহরে আসা ঢাকী, মণ্ডপসজ্জার কারিগরের মতো নদিয়ার কোনও মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের দলও গড়িয়া থেকে টালাপার্ক সংস্কৃতি-উৎসবের আসরে ঘুরপাক খাচ্ছে।

কসবার রাজডাঙায় পিঠে-উৎসবের মেলায় মুখ্য চরিত্র কিন্তু স্থানীয় গিন্নিরাই। পৌষের শেষ থেকে ক’টা দিন বাড়িতে প্রায় অরন্ধন। মেলার মাঠ পিঠে-সম্ভারে উপচে পড়ছে। শোভা সাহা শাশুড়ির কাছে শেখা সুজি, চালগুঁড়ি, নারকোল, পাটালির লাড্ডু বা দলা পাকানো দৈলা পিঠে পেশ করছেন। রুমা মিত্রের সৃষ্টি পনিরের পুরভরা মৌলিক পুলি। কড়াইশুঁটির নোনতা পিঠে, ওড়িশার তিল-নারকোল-সুজির খাকড়া পিঠে বা যশোহরের জায়ফল জয়িত্রী সুরভিত পুরের আনদোসা পিঠেও মেলার মাঠে হাজির।

নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্য মাথায় রেখে সহজলভ্য ইডলিমেকারে পিঠে ভাপানো হচ্ছে। কিংবা ভার্মিসেলি পাস্তার প্যাকেট খুলে পরিশ্রম এড়িয়ে তৈরি হচ্ছে একেলে চসির পায়েস। বলরাম মল্লিক বা হিন্দুস্তান সুইট্সও পিঠে-চর্চায় মনোযোগী। সিক্স বালিগঞ্জ প্লেস বা ওহ্ ক্যালকাটার মতো রেস্তোরাঁও পৌষ-পার্বণের সময় থেকে ঘুরে ফিরে মেনুতে পিঠে রাখে বা পিঠে-উৎসব করে। এ সব ছোট বড় উৎসবের আধারে টিকে থেকেই পিঠে এখন বাঙালির নাগরিক শীত যাপনের থিম।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

riju basu pitha pithe puli
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE