গত শতাব্দী পর্যন্ত ছেলেমেয়েদের মধ্যে তাদের উপযোগী করে লেখা মহাকাব্যের গল্প, পুরাণের কাহিনিগুলি পড়ার চল ছিল। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর রচনাগুলির পাশাপাশি অমর চিত্রকথা-ও ছিল ছোটদের জন্য জনপ্রিয় উপহার। কাহিনিগুলির মাধ্যমে শিশুমনে ধর্মীয় চিন্তা জাগরণের উদ্দেশ্য কিন্তু অভিভাবকদের ছিল না। কল্পনাশক্তিকে উস্কে দিতে নিছক গল্পের বই হিসাবেই কিনে দিতেন। বাচ্চারা রূপকথার জগৎ ভেবে বুঁদ হত।
অথচ ইদানীং সেই পুরাণকেই ইতিহাস রূপে প্রতিষ্ঠিত করার ও ছোট থেকেই ভবিষ্যতের নাগরিকদের এই নব্য ভাবধারায় শামিল করার প্রয়াস দেখা যাচ্ছে। তাই নিরপেক্ষ চোখে পুরনো দিনের গল্পগুলিকে ফিরে দেখার ও ছোটদের তার সঙ্গে আগেভাগেই সম্যক পরিচয় করিয়ে রাখা প্রয়োজন। এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটিই করেছেন লেখক। আনন্দবাজার পত্রিকা-র স্কুল সংস্করণের সাপ্তাহিক কলামে পৌরাণিক চরিত্রদের অপ্রচলিত কাহিনি ও ভারত-সংস্কৃতিতে তার পরিবর্তিত রূপ ও প্রভাব বিধৃত করেছিলেন। আকর্ষক বর্ণনার পাশাপাশি ছিল কিশোর পড়ুয়াদের উপযোগী বিশ্লেষণ। দু’বছর ধরে প্রকাশিত এমনই ৫০টি ছোট ছোট লেখা একত্রিত বইটিতে।
স্বল্প পরিসরেই শিব, বিষ্ণু, গণেশ, সরস্বতী, দুর্গা, সূর্য-বরুণের দীর্ঘ অভিযাত্রাচিত্র থেকে তথাগত-মহাবীর প্রসঙ্গের ভূয়োদর্শনের অভিজ্ঞতা মেলে। এক-একটি চরিত্রকে ধরে লেখক শুনিয়েছেন সংস্কৃতি ও সময়ভেদে পুরাণপথে দেখা তাদের নানা রূপ ও ব্যঞ্জনার কথা, বহুশ্রুত কিংবদন্তিতেও বাড়তি প্রাপ্তি আকর্ষণীয় তথ্য। যেমন, ওই যে ঐরাবতের মাথাটি গণেশের কাঁধে জোড়া, সে ছিল দুর্বাসার শাপগ্রস্ত। গণেশের লেখকসত্তা প্রসঙ্গে ধরতাই, দীর্ঘকাল ধরে গণ বা সাধারণ মানুষের কল্পনাই রূপ পেতে থেকেছে বিশাল মহাকাব্যে, এ তারই ইঙ্গিত। অবতারতত্ত্ব, বিস্তৃত বিষ্ণুপ্রসঙ্গ, জগন্নাথ ও রথের ইতিবৃত্তের পাশাপাশি মেলে ধরেছেন— কী ভাবে যুগপরিবর্তন ও রাধা চরিত্রের প্রতিপত্তি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কৃষ্ণ চরিত্রের প্রতাপ বদলায়। দেখিয়েছেন, মহাভারতের কৃষ্ণের তুলনায় বৃন্দাবনের কৃষ্ণ কত কোমল। সম্ভারটিতে অচেনা কাহিনিই বেশি। আছে রামের শিবধনুকে সাগর পারের গল্প, অস্ত্রাদির মানবরূপে আগমন, বিস্মৃত দেবতা দ্যু-র কথা, প্রহ্লাদের সঙ্গে নারায়ণের হাজার বছর ধরে যুদ্ধের অস্ত্রবর্ষা। বুদ্ধের সমসাময়িক অধুনা প্রায়-অশ্রুত গোশাল, সঞ্জয়, অজিতের মতো দার্শনিকের কথাও ছুঁয়ে গিয়েছেন। আবার মহাভারতে যে কাহিনি সামান্য উল্লেখেই ভীতি ধরিয়েছিল, তার আর একটু বিশদ দেখাও মিলল। সৌপ্তিক পর্বে পাণ্ডবশিবির-রক্ষী সেই তেজোপুরুষ আর কিছু পরে বিষাদের গান গাইতে গাইতে যে করালবদনা এসে মৃতদের টেনে নিয়ে গেল— তাদের রূপবর্ণন ও প্রকৃত স্বরূপদর্শন স্তব্ধ করে দেয়।
পুরাণকথা
অলখ মুখোপাধ্যায়
৪৫০.০০
সিগনেট প্রেস
মহাবলীরা কিন্তু এখানে ‘তিনি’, ‘করলেন’-এর বদলে ‘সে’, ‘করল’— এ ভাবে তৃতীয় পুরুষে পরিবেশিত। অর্থাৎ, লেখক বুঝিয়ে দিচ্ছেন, সবই কল্পনা। ভূমিকাতেই স্পষ্ট করেছেন, শাস্ত্র নয়, পুরাণকে আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অঙ্গ হিসাবে দেখা যায়। উপাখ্যানগুলিতে কী ভাবে সমাজচিত্র ফুটে ওঠে তার সন্ধানে পাঠককে নিয়ে চলেছেন কালপরিক্রমণে। বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে আদানপ্রদানের সাক্ষী আবেস্তা-র মধ্যে ইন্দ্র, বরুণ, মরুৎ-এর উল্লেখ।
ছাত্রদের সঙ্গে ভারতীয় দর্শনের বনিয়াদি আলাপও করিয়ে দিয়েছেন। বস্তুবাদী চার্বাক মতকে যে ব্রাহ্মণ্যবাদ ভয় পেয়েছিল, তারই প্রমাণ এক সময় যুধিষ্ঠিরের যজ্ঞের আসরে চার্বাক রাক্ষসের আবির্ভাব। অন্য দিকে, মধ্যযুগের কাব্যে পড়ছে দুর্ভিক্ষের ছায়া, আবার শস্যশ্যামলা বাংলার পটভূমি আসামাত্র দেখা দিচ্ছে ধানের বাহারি নাম, ব্যঞ্জনের স্বাদু বিবরণ। মহাদেব চরিত্রেও গৃহস্থ রং, ত্রিশূল ভেঙে শিব চাষ করে ফসল ফলাচ্ছে। পুরাণই যেন বলে দেয়, আজ যে দেবতা, কাল সে মানব কিংবা দানব! রাক্ষসপূজার কথা, হনুমানের শঠতার ইঙ্গিতও রয়েছে তার অন্দরে। অর্থাৎ পুরাণ কচি বয়সে ন্যায়-অন্যায় বোধ গড়ে তোলে; সন্দেহ, প্রশ্নও করতে বলে। তথাকথিত পূজিতের চরিত্রেও যে ধূসর দাগ থাকতে পারে, তা মেনে নিতে শেখায়।
সবচেয়ে বড় কথা, পুরাণে কিন্তু বার বার পরমতসহিষ্ণুতার কথাই আছে। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ-এ সাবিত্রীকে যম বিভিন্ন নরক সম্পর্কে অবগত করছেন। সেখানেই বলছেন, অন্যের ধর্মের প্রতি যে সহিষ্ণু নয়, নরক থেকে তার মুক্তি নেই। এই প্রকৃত ভারতাত্মা সম্পর্কেই লেখক নবীন প্রজন্মকে সজাগ করতে চেয়েছেন। সেই উদ্দেশ্যে ১৮টি পুরাণ ও ১৮টি উপপুরাণ সেচে যে রত্নরাজি হাজির করেছেন, স্কুলপড়ুয়াদের পক্ষে তার ভারবহন কঠিন হলেও হতে পারে। সে ক্ষেত্রে, ছোট ছোট লেখার সঙ্কলন হলেও বইটি একটানা শেষ না করে, অবসরে একটু-একটু করে পড়লে এর রসাস্বাদন সহজ ও উপভোগ্য হবে, সাহিত্যচেতনারও বিকাশ ঘটবে।
এ বই বড়দেরও। লেখকের অভীপ্সামতোই, ভারততত্ত্ব সম্পর্কে আগ্রহের অঙ্কুরোদ্গম হয়। তাই কিছু অংশে পাদটীকা, পুরাণগুলির ভাগ-বিভাগ শাখাপ্রশাখা-সহ সংক্ষিপ্ত পরিচয় ও বিস্তারিত গ্রন্থপঞ্জি পেলে সেই বীজ প্রয়োজনীয় রসদ সংগ্রহ করে বৃক্ষে পরিণত হতে পারে। বর্তমান রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশে, অপব্যাখ্যার ফাঁদ এড়াতে, ব্যক্তিগত স্তরে পুরাণের (পুনঃ)পঠনের গুরুত্ব বাড়ছে। কারণ, পুরাণ নিজে যেমন চলমান মানবসভ্যতার ছবি বহন করে, তেমনই একই পাঠকের কাছে বিভিন্ন বয়সে এর তাৎপর্য ও অর্থ ভিন্নতর।
নজরে
১. একটা গভীর তলাযুক্ত পাত্রে রক্তটা ঢেলে উনুন কি চুলোয় গরম করুন। ২. খুব কম লবণ দিন (রক্ত নিজে থেকেই নোনতা)। ৩. রংটা গাঢ় চকলেট-বাদামি হয়ে এলে, রেডি। এই খাবার— মরাঠিতে রাগতি বা রক্তি— তৈরিতে দুটো উপকরণই লাগে। রেসিপিও এটাই। তার পরেই লেখক বলছেন, রান্না করা রক্ত খুব ঘন, এমনকি টোফু বা পনিরের চেয়েও; রান্না হয়ে গেলেই সঙ্গে সঙ্গে খেলে অনবদ্য স্বাদ।
কী মনে হচ্ছে? নরখাদকের খাবারের রেসিপি? আজ্ঞে না। সাহু পাটোলে-র এই বইয়ে এমন অগণিত খাবার ও তার রন্ধনপ্রণালী ছড়িয়ে, যে খাবার শতশত ভারতীয় খেয়ে আসছেন যুগ যুগ, শতাব্দী ধরে। কিন্তু তা নিয়ে কোনও কথা হয় না— ও যে ‘ছোটলোক’-দের, ‘অজাত-কুজাত’-এর খাবার, অখাদ্য! ভারতের ‘দলিত’ মানুষেরা ঠিক কী কী খান, কী ভাবে, এবং কেন, এ নিয়ে বলতে গিয়ে সাহু চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন ঘরের মধ্যে মস্ত হাতিটা— খাদ্য-সংস্কৃতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি জাতপাত আর বর্ণের ‘সংস্কৃতি’— আসলে রাজনীতি। উঁচু জাতের খাবারও উঁচু, তাকে ঘিরে যত মানসম্মান, নস্ট্যালজিয়া, বিপণন, রিল আর ইনস্টা-স্টোরি, টিভি চ্যানেলের কুকিং শো। কেউ কি ভুলেও কখনও দেখেছে, দলিতদের কোনও খাবার নিয়ে কেউ লিখছেন, বলছেন, রেঁধে দেখাচ্ছেন, বানিয়ে তা বিক্রি করছেন, এমনকি আজকের বাজার-অর্থনীতির পূর্ণ সুযোগ নিয়েও?
দলিত কিচেনস অব মরাঠাওয়াড়া
সাহু পাটোলে, অনু: ভূষণ করগাওকর
৫৯৯.০০
হার্পার কলিন্স
উত্তরটা— না। অথচ দলিতরা খান নিশ্চয়ই রোজ। মাহার ও মাং, মহারাষ্ট্রের এই দুই দলিত সম্প্রদায়ের খাদ্যাভ্যাসের চুম্বকে সাহু আসলে খুলে দেন এমন একটা দরজা, যেটা আমরা সচরাচর বন্ধ রাখি, উল্টো দিক থেকে সেই খাবার আর তার রাঁধুনি দুইয়েরই ‘বদগন্ধ’ ভেসে আসে বলে। এই দুই দলিত সম্প্রদায়ের মধ্যেও আছে নানা উপভাগ, তাদের পেশা, পছন্দ, খাদ্যাভ্যাসেও নানা ফারাক। সাহু এক-একটা রেসিপির সূত্রে বুঝিয়ে দেন দলিত খাবারের সঙ্গে সাহিত্য-পুরাণ-সংস্কৃতি-রাজনীতির যোগসূত্রগুলোও। মূল বইটা মরাঠিতে লেখা, নাম অন্ন হে অপূর্ণ ব্রহ্ম। উচ্চবর্ণ অন্ন ও তার গ্রহণ প্রক্রিয়াকে পূর্ণ ব্রহ্মের স্তরে উঠিয়েছে, দলিত ও তাঁদের খাবারকেও করেছে অন্ত্যজ। ভাগ্যিস ইংরেজি অনুবাদটা হল! দলিতের খাবার ও তার পাতকে ঘিরে ভারতীয় অস্বস্তিটা মর্মে ছড়াক, তবেই না তা নিয়ে কথা হবে আরও!
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)