Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

মন্দির খুঁড়ে বর্গিদের সম্পদ খুঁজেছিলেন জমিদার

বর্গি এসেছিল বঙ্গে। তাদের লুটপাটে বাংলার ঘরে ঘরে ত্রাহি ত্রাহি রব উঠেছিল। জন্ম নিয়েছিল নানা লোকছড়ার। মরাঠা দস্যুদের প্রবল অত্যাচারের বর্ণনা দিলেন বিমলকুমার শীটসন্ধ্যার সময় ওই সব পাথরের গায়ে মশাল জ্বেলে বেঁধে দেওয়া হত। দূর থেকে মনে হত, মশালধারী সৈন্য গড় পাহারা দিচ্ছে।

স্মৃতি: এই মন্দিরের সঙ্গে বর্গিদের যোগ রয়েছে বলে জনশ্রুতি। —নিজস্ব চিত্র।

স্মৃতি: এই মন্দিরের সঙ্গে বর্গিদের যোগ রয়েছে বলে জনশ্রুতি। —নিজস্ব চিত্র।

শেষ আপডেট: ১৮ জানুয়ারি ২০১৯ ০০:৪৬
Share: Save:

ঝাড়গ্রামের কুলটিকরি। আর পশ্চিম মেদিনীপুরে কেশিয়াড়ি। কুলটিকরি থেকে কেশিয়াড়ি যাওয়ার পথে পড়ে কিয়ারচাঁদ। এই কিয়ারচাঁদের বিরাট এলাকায় শয়ে শয়ে লম্বা, চৌকা নানা রকম পাথর পোঁতা আছে। সাধারণ ভাবে বোঝা যায় না কী এগুলো। কিন্তু জনশ্রুতি বলছে, এই পাথরগুলোর সঙ্গে বর্গিদের যোগ রয়েছে। এলাকার বাসিন্দারা বলেন, তাঁরা বংশানুক্রমে শুনেছেন, বর্গিদের অত্যাচারে ভয় পেয়ে স্থানীয় জমিদার সারি সারি পাথর পুঁতেছিলেন। সন্ধ্যার সময় ওই সব পাথরের গায়ে মশাল জ্বেলে বেঁধে দেওয়া হত। দূর থেকে মনে হত, মশালধারী সৈন্য গড় পাহারা দিচ্ছে।

এই একটি উদাহরণ থেকেই বোঝা যায় বর্গিরা কতটা আতঙ্ক তৈরি করেছিল মেদিনীপুরে। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ থেকে ওড়িশা সংলগ্ন মেদিনীপুর বারবার বর্গি হানার শিকার হয়েছে। সম্পদহানি তো হয়েছেই। প্রাণহানির হিসেব নেই। বর্গি হল ‘বর্গীর’ শব্দের অপভ্রংশ। এরা ছিল নিম্ন শ্রেণির মারহাট্টা সৈন্য।

১৭৪২ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৭৫১ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে মরাঠারা বাংলাদেশ আক্রমণ করে নবাবের অস্তিত্বই সঙ্কটে ফেলেছিল। বর্গির অত্যাচারে মেদিনীপুর বেশি বিপদগ্রস্ত হয়েছিল। বিহার ও ওড়িশার একপ্রান্তে এর অবস্থান হওয়ার ফলে নাগপুর থেকে উত্তর পূর্বদিক হয়ে ছোটনাগপুর হয়ে দক্ষিণ বিহার আর দক্ষিণে ওড়িশা প্রবেশে বহু পথ রয়েছে। সেখান থেকে মেদিনীপুরে সহজে পৌঁছন যেত। তাছাড়া মেদিনীপুরের ধন সম্পদ বর্গিদের প্রধান লক্ষ্যবস্তু ছিল। এই সময় আলিবর্দি খাঁ ছিলেন বাংলা-বিহার-ওড়িশার নবাব। তিনি বর্গির হাত থেকে দেশকে রক্ষা করার নানা চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্য়ন্ত কিছুই করে উঠতে পারেননি। ভাগীরথীর পশ্চিম তীরে রাজমহল থেকে মেদিনীপুর ও জলেশ্বর পর্যন্ত অঞ্চলে নবাবি শাসনের পরিবর্তে বর্গিদের প্রভাব বাড়ে। বর্গিরা আচমকা ঘোড়ায় চড়ে ‘হর হর মহাদেব’ বলে গ্রামে ঢুকে পড়ত। তারপর, লুটপাঠ, অত্যাচার করে গ্রাম ধ্বংস করে পালাত। হলওয়েল, সলিমুল্লাহ, গঙ্গারাম শাস্ত্রী প্রমুখের রচনায় মরাঠাদের বীভৎসতার বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়।

‘মাঠে ঘেরিয়া বরগী দেয় তবে সাড়া।/সোনা রুপা লুঠে নেয়, আর সব ছাড়া।।/কারু হাত কাটে, কারু নাক কান।/একি চোটে কারু বধয়ে পরাণ।/ভাল ভাল স্ত্রীলোক যত ধরিয়া লইয়া যায়।/অঙ্গুষ্ঠে দড়ি বাঁধি দেয় তার গলায়।।/এক জনে ছাড়ে তবে আর জনা ধরে।/তারা ত্রাহি শব্দ করে।।’’ (মহারাষ্ট্র পুরাণে)

ভাস্কর পণ্ডিতের নেতৃত্বে বিশাল সেনাবাহিনী বাংলায় প্রবেশ করে। বর্গি সৈন্যদলে মহারাষ্টীয় হিন্দু ছাড়াও অসংখ্য মুসলমান, পিণ্ডারি, এবং তথাকথিত নিম্নবর্গীয় লুঠেরা ছিল। ওড়িশার অনেকখানি জায়গা স্থায়ীভাবে দখল করে মেদিনীপুরের দিকে এগোতে থাকে তারা। সুবর্ণরেখা নদীর ওপারে ঝড়গ্রামের জঙ্গল মহালে ছিল তাদের আস্তানা। এখনও নয়াগ্রামের জঙ্গলে দু’একটা বাতি ঘর দেখে মরাঠাদের ঘাঁটির অনুমান করা যায়। সাঁকরাইল থানার পথে কুলটিকরি হয়ে পূর্ব-দক্ষিণে আক্রমণের নিদর্শন পাওয়া যায়। ওই পথে কুলটিকরি হয়ে কেশিয়াড়ি, কেশিয়াড়ি থেকে বেলদা-নারায়ণগড়, পটাশপুর, নন্দীগ্রাম, ময়না, মহিষাদল পড়ে। পটাশপুর মরাঠাদের বেশ শক্ত ঘাঁটি ছিল। ১৮০৩ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজরা মারাঠাদের পটাশপুর থেকে তাড়ায়।

নবাব আলিবর্দি খাঁ রঘুজি ভোঁসলের দক্ষ সেনাপতি ভাস্কর পণ্ডিতের গতিবিধির সংবাদ পেয়ে পাঁচেট (পঞ্চকোট) থেকে ফিরে মেদিনীপুরের চলে আসেন। বর্গিদের চিল্কা হ্রদ পার করে দেন (ডিসেম্বর ১৭৪২ খ্রিস্টাব্দ)। কিন্তু পরে (১৭৪৪ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসের গোড়ায়) ভাস্কর পণ্ডিত মরাঠাদের নেতা হয়ে ওড়িশার পথ দিয়ে বাংলায় প্রবেশ করলেন। মেদিনীপুরবাসীর উপর আবার অত্যাচার নেমে এল। ১৭৪৪ খ্রিস্টাব্দে ৩১ মার্চ নবাব আলিবর্দি খাঁ বিশ্বাসঘাতকতা করে ভাস্কর পণ্ডিতকে হত্যা করলেন। তারপর এক বছর তিন মাস মেদিনীপুরের স্বস্তি। কিন্তু রঘুজি ভোঁসলে ভাস্কর পণ্ডিতকে খুনের প্রতিশোধ নিতে বদ্ধপরিকর। তিনি চৌদ্দ পনের হাজার সৈন্য-সহ কটক আক্রমণ করলেন। সমগ্র ওড়িশা, মেদিনীপুর ও হিজলি পর্যন্ত এলাকা তাঁর হাতে এল। আবার রক্তনদী বইল মেদিনীপুরে। বর্গিরা গ্রাম, নগর পুড়িয়ে, শস্যের ভাণ্ডারে আগুন লাগিয়ে এবং শেষে মানুষের নাক, কান ও পুরস্ত্রীর স্তন কেটে অত্যাচার শুরু করল।১৭৫১ খ্রিস্টাব্দে আলিবর্দি প্রথম রঘুজির সঙ্গে সন্ধি করে মেদিনীপুরের কিছু অংশ, যেমন জলেশ্বর, ভোগরাই, পটাশপুর, কামার্দাচৌর প্রভৃতি নিমক মহালগুলো এবং ওড়িশার রাজস্ব আদায়ের ভার ভোঁসলে মরাঠাদের উপর ছেড়ে দেন।

পলাশির যুদ্ধে মেদিনীপুরে মরাঠা সমস্যার সমাধান হয়নি। বঙ্গের সিংহাসন নিয়ে মীরকাশিমের ষড়যন্ত্রের সুযোগে মরাঠারা শ্রীভট্ট নামে এক নায়েকের অধীনে মেদিনীপুরে আবার ঢুকে পড়ে। ১৭৬১ সালের জানুয়ারি মাসে তারা দ্বিগুণ উৎসাহে মেদিনীপুর আক্রমণ করলে মেদিনীপুরের ইংরেজ কুঠির রেসিডেন্ট জনস্টোন সাহেব কলকাতার সাহায্য চান। পরে মরাঠারা আবার আক্রমণ করলে মেজর চ্যাপমান কয়েকটি যুদ্ধে তাদের পরাজিত করে। এই সময় নারায়ণগড়ের জমিদার রাজা পরীক্ষিৎ পাল বর্গি দমনে কোম্পানিকে বিশেষ সাহায্য করেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে মহিষাদলের রাজাও মরাঠাদের অত্যাচার থেকে জমিদারি রক্ষা করতে পর্তুগিজ সেনা নিয়োগ করে ছিলেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিন পর্যন্ত বর্গিদের আক্রমণ চলেছিল। মরাঠা জমিদাররা প্রায়ই মেদিনীপুরের ব্রিটিশরাজের প্রজাদের জমি লুঠ করত। অনেক সময় অপরাধীরা অপরাধ করে মরাঠাদের অধিকারে থাকা ওড়িশায় পালাত। ইংরেজ কোম্পানি অনেক চেষ্টা করেও এই অশান্তি দূর করতে পারেনি। তবে মরাঠাদের সস্তা লবণ যাতে মেদিনীপুর হয়ে অন্যত্র যেতে না পারে তার জন্য কোম্পানি কেশিয়াড়ি, লাপো, সুপার কুরুল, সীপুর, দাঁতন, আগরা চৌর, খটনগর, পটাশপুর বড়ার, কাঁথি, গোপীবল্লভপুর ও জামবনি-সহ কিছু জায়গায় নজরদারি চৌকি করেছিল।

তবে ঠাকুর-দেবতায় বর্গিদের ছিল শ্রদ্ধা। তারা কোনও দেব-মন্দির লুণ্ঠন করেনি। কথিত, বর্গভীমা মন্দিরের কোনও অংশে তারা হাত দেয়নি। ঠিক তেমনই ভাবে সাঁকরাইল থানার পিতলকাঠি (পাথরাকাটি) গ্রামের জয়চণ্ডী মন্দিরকে তারা নতুন ভাবে তৈরি করেছিল। মন্দিরের পাশে ছিল ভুঁইয়া রাজার গড়। রাজাদের প্রচুর ধন-সম্পদ ছিল। বর্গি হাঙ্গামায় তিনি নিঃস্ব হয়ে যান। বংশধারাও লোপ পায় তাঁর। এখনও ওই এলাকায় তাঁর ভাঙা-গড়ের চিহ্ন মেলে। আর আছে রানির স্নান করার কুয়ো। বেশ কিছুদিন পরে ওই এলাকার জমিদার জয়চণ্ডীর মন্দির খুঁড়ে বর্গিদের ধনসম্পদ খুঁজে দেখেছিল। মন্দিরের ভাঙা দেওয়াল নাটমন্দিরের থাম, জমিদারের লোভের সাক্ষ্য বহন করেছে।

১৭৬৯ সালে বিশাল মারাঠা বাহিনী সুবর্ণরেখা পার হয়ে বাংলার সীমায় উপস্থিত হয়ে সমগ্র মেদিনীপুরকে বিধ্বস্ত করে বর্ধমানের দিকে এগিয়ে যায়। শস্যের অভাবে, খিদের জ্বালায় মানুষ কলাগাছের তেউড় ও পশুরা খড় ও পোয়ালের অভাবে গাছের পাতা খেয়ে খিদে মিটিয়েছিল। খাবারের প্রবল অভাব দেখা দিলে তারা বাড়িঘর, পরিবার ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল। বিশেষ করে সদর রাস্তার ধারের গ্রামগুলো প্রায় মানুষ শূন্য হয়েছিল।

লেখক লোকসংস্কৃতির গবেষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Bargi বর্গি
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE