Advertisement
১১ মে ২০২৪

অস্বচ্ছ

শহরের স্বার্থেই মেট্রো রেলের নূতন লাইন তৈরি করা জরুরি। এবং, যে কোনও উন্নয়নপ্রক্রিয়ায় যেমন কিছু মানুষকে স্থানচ্যুত করিতে হয়, মেট্রোর ক্ষেত্রেও তাহার ব্যতিক্রম হইবার কারণ ছিল না।

বউবাজারে বিপর্যয়। নিজস্ব চিত্র

বউবাজারে বিপর্যয়। নিজস্ব চিত্র

শেষ আপডেট: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০৪:২৫
Share: Save:

ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো আপাতত এক সুড়ঙ্গ জলে। কলিকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চের রায়ে কাজ স্থগিত হইয়াছে। কত দিনে ফের চালু হইবে, তাহা কলিকাতার সাবেক মেট্রোর চলিবার সময়ের ন্যায় অনিশ্চিত। অবশ্য, ইহাকেই সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন বলিয়া দাবি করিলে ভুল হইবে। বৌবাজার অঞ্চলে যাঁহারা আচমকা উন্নয়ন-উদ্বাস্তু হইলেন, তাঁহাদের সমস্যাই এই মুহূর্তে প্রধান বিবেচ্য। তাঁহারা আচমকা গৃহহীন হইয়াছেন। আশঙ্কা, সব জরুরি দলিল-দস্তাবেজও হারাইয়াছে, ফলে ভবিষ্যতে আরও হয়রানি তাঁহাদের অপেক্ষায় থাকিবে। এই বিপদ ঘটা অনিবার্য ছিল না। ঝুলন সাজানো আর মেট্রো রেলের নূতন লাইন তৈরি করিবার মধ্যে যে কিছু ফারাক আছে, মেট্রো কর্তৃপক্ষ তাহা জানিতেন বলিয়া আশা করা চলে। বৌবাজারের ন্যায় জনবহুল পুরাতন অঞ্চলে সুড়ঙ্গ খুঁড়িতে হইলে গোড়ায় তাহার পূর্বাপর বিচার করিয়া লওয়া বিধেয়। মাটির অবস্থা কেমন, বহু প্রাচীন বাড়িগুলি এই ধকল সহ্য করিতে পারিবে কি না, মেট্রোর কর্তারা সে বিষয়ে দৃশ্যত যথেষ্ট খোঁজখবর করেন নাই। ফলে, তাঁহাদের পায়ের নীচের মাটিও অকস্মাৎ সরিয়া গিয়াছে। এখন ক্ষতিগ্রস্তদের মাথা গুঁজিবার ঠাঁইয়ের বন্দোবস্ত, ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা— হরেক দৌড়ঝাঁপ চলিতেছে। যদিও মুখ্যমন্ত্রী এবং বিজেপি সভাপতি, উভয়েই রাজনীতিকে এই দুর্ঘটনার বাহিরে রাখিবার প্রতিশ্রুতি দিয়াছেন, তবু বঙ্গের জলহাওয়াকে ভরসা নাই। হয়তো প্রতিযোগিতামূলক ত্রাণকার্যের ফাঁক গলিয়াই রাজনীতি ঢুকিয়া পড়িবে। তাহাতে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষগুলির কতখানি লাভ হইবে বলা মুশকিল— মেট্রোর ক্ষতি বিপুল। ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো প্রকল্পটি এখনই বহু বিলম্বে চলিতেছে, অতঃপর হয়তো তাহা নির্বিকল্প সমাধিতে চলিয়া যাইবে। কলিকাতায় যেমন হইয়া থাকে। এই শহর কাজ শুরু করে, শেষ করে না।

শহরের স্বার্থেই মেট্রো রেলের নূতন লাইন তৈরি করা জরুরি। এবং, যে কোনও উন্নয়নপ্রক্রিয়ায় যেমন কিছু মানুষকে স্থানচ্যুত করিতে হয়, মেট্রোর ক্ষেত্রেও তাহার ব্যতিক্রম হইবার কারণ ছিল না। প্রয়োজন ছিল স্বচ্ছতার, যথার্থ পরিকল্পনার। মেট্রোর সুড়ঙ্গ খুঁড়িলে কোথাও মাটি বসিয়া যাইতে পারে কি না, তাহা বোঝা সাধারণ মানুষের কাজ নহে। তাহা বিশেষজ্ঞের দায়িত্ব। বিপদ ঘটিবার পর মেট্রো কর্তৃপক্ষ যে ভাবে দেশ-বিদেশের বিশেষজ্ঞদের কাজে নামাইয়াছে, পূর্বে তাহা করিয়াছিল কি? যদি করিয়া থাকে, এই বিপদের আঁচ পাওয়া সম্ভব হয় নাই কেন? আর, যদি না করিয়া থাকে, তবে তো প্রশ্নটি আরও সংক্ষিপ্ত— কেন? বিপদের সম্ভাবনাটি যদি পূর্বেই জানা থাকে, তবে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় নাই কেন? এখানেই স্বচ্ছতার অভাব। মেট্রো প্রকল্পের জন্য তাঁহাদের বাড়িগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হইবে, এবং প্রয়োজনে তাঁহাদের চিরতরে সেই বাসস্থান ছাড়িতে হইবে— এই কথাগুলি সংশ্লিষ্ট বাসিন্দাদের পূর্বে জানাইয়া রাখা জরুরি ছিল। পুলিশ ও মেট্রো কর্তৃপক্ষ সম্ভবত বলিবেন, কাজ চলাকালীন বাড়ি ছাড়িয়া হোটেলে থাকিবার নোটিস বাসিন্দাদের দেওয়া হইয়াছিল। তাঁহাদের কি আরও এক বার জল ও জলপাইয়ের ফারাক বুঝাইয়া দিতে হইবে? সত্যটি হইল, উন্নয়নের স্বার্থে কেহ স্থানচ্যুত হইতে পারেন— এই কথাটি প্রকাশ্যে বলিবার সাহসের অভাব পশ্চিমবঙ্গে প্রকট। যাঁহাদের ক্ষতি হইতে পারে, তাঁহাদের সহিত আলোচনা করিয়া, গ্রহণযোগ্য ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করিয়া তাঁহাদের সম্মতি আদায়ের প্রক্রিয়াটিতে প্রবেশ করিবার সদিচ্ছারও অভাব সমান। ফলে, অদৃষ্টের হাতে হাল ছাড়িয়া দেওয়ার অভ্যাসটি কার্যত নিয়মে পরিণত হইয়াছে। বৌবাজার তাহারই পরিণতি প্রত্যক্ষ করিল। এই বিপত্তির জন্য দায়ী কে, তাহা নির্ণয় করিয়া কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা বিধেয়। শহরের স্বার্থ লইয়া ছেলেখেলা চলিতে পারে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

East West Metro Bowbazar Landslide
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE