E-Paper

কোন ভাঙনের পথে এলে

এনআরসি আন্দোলনে উত্তাল শহরে তরুণতরুণীরা অনায়াসে গাইছেন মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে, ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে। এ জীবন পুণ্য করো দহন-দানে।’

ঈশানী দত্ত রায়

শেষ আপডেট: ০৯ মে ২০২৫ ০৬:১৯
Share
Save

কেমন আনমনে নিজের মতো ছিল শব্দটা।

কোন শব্দ?

ওই যে, ‘মধ্যদিনের বিজন বাতায়নে’ গানে, যে ‘নৈরাশা’...

যে নৈরাশা গভীর অশ্রুজলে ডুবেছিল বিস্মরণের তলে?

হ্যাঁ। অদিতি মহসিন উচ্চারণ যেই করলেন— যে নৈরাশা, আলগোছে গানটা শুনতে শুনতে হঠাৎ গেঁথে গেল শব্দটা। বাকি সব কিছু ঝাপসা করে একটাই শব্দ টেনে নিল, নৈরাশা...

কী এল? অবসাদ?

না। শব্দটা এমন, লাইনটা এমন, হয় না এমন যে কেউ বসেছিল, সব ফেলে আলগোছে উঠে গেল, একেবারে চিরদিনের মতো, সেই রকম। কথাগুলো, সুরটা। তুমি আছ, কিন্তু কোনও কিছুর সঙ্গেই আর জড়িয়ে নেই, ঠিক তেমনটা। ‘আনন্দধারা বহিছে ভুবনে’-তে আবার ‘চারি দিকে দেখো চাহি, হৃদয় প্রসারি’ যখন শুনবে, শিমুলের তুলোর মতো ফেটে বেরোবে হৃদয় ঝলক দিয়ে, আর বেরিয়ে সে মিশে যাবে বাতাসের সঙ্গে, তুমি মিশে যাচ্ছ ভুবনের সঙ্গে, তোমার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে ভুবন। তার পর ওই যে ‘কোন খেলা যে খেলব কখন’! তোমার নিঠুর খেলা খেলব গাওয়ার সময়, ওই নিঠুর খেলা উচ্চারণের সময় মনে হয় যেন আচমকা ভেঙে গেল সুচিত্রা মিত্রের কণ্ঠস্বর, কী অদ্ভুত লাগল, নিঠুর শব্দটাই যেন গেল বদলে।

আগুনের পরশমণি গানটা ছোটবেলা থেকে শুনছ, কিন্তু বছর কয়েক আগে শুনলে এনআরসি আন্দোলনে উত্তাল শহরে তরুণতরুণীরা অনায়াসে গাইছেন মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে, ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে। এ জীবন পুণ্য করো দহন-দানে।’ সেই একই জায়গায় সন্তানহারা বাবা-মাকে পাশে নিয়ে গাইছে জনতা, ‘যেখানে পড়বে সেথায় দেখবে আলো— ব্যথা মোর উঠবে জ্বলে ঊর্ধ্ব পানে।’ ব্যথাই তো জ্বলে উঠবে, যাতে একলা চলা যায়। তার আসার কথা যখন আমার কাছে পৌঁছয়, হিয়া পেতে রাখার কথাই তো বলেন তিনি। ‘আমার ব্যথায় পড়ুক তাহার চরণখানি’। কে আসবে? কে বাহির হল? সে কি প্রেমিক, প্রেমিকা, ঈশ্বর, না সে আহ্বান? না কি সে আমিই? অন্য আমি বেরিয়ে পড়ছে এ আমির আবরণ ছেড়ে, সে পথ তো বেদনার্ত হবেই। প্রতিটি পা ফেলায় জ্বলে উঠবে ব্যথা। তবেই না বাহিরে যাওয়া।

বলে যাও। থামলে কেন?

‘কোথায় আলো কোথায় ওরে আলো!’- গানটা শুনেছ? ‘নিশীথে ঘন অন্ধকারে ডাকেন তোরে প্রেমাভিসারে, দুঃখ দিয়ে রাখেন তোর মান। তোমার লাগি জাগেন ভগবান’। দুঃখ দিয়ে রাখেন তোর মান— এর অর্থ বুঝতেই জীবন চলে যাবে। প্রেম তো অনন্ত বিরহ, দুঃখ পেতেই হবে, আর যে মানুষ পথে বেরিয়েছে, বিরহ তার অনন্তসঙ্গী। শুধু কি তা-ই? যখন মনে মনে গাইছ বা শুনছ, ‘তোমার লাগি জাগেন ভগবান’, তোমার ভিতরটাকে কেউ যেন তুলে দিচ্ছে উপরে, তুমি ছড়িয়ে যাচ্ছ, অনন্ত সেই অর্কেস্ট্রা, তুমিই তুলে নিচ্ছ ছড়, দু’হাত ছড়িয়ে দিচ্ছ সুরে। তুমিই বাজছ, বাজাচ্ছ। কে এই ভগবান, তিনি কি বিশ্বাসীর ঈশ্বর, প্রেমিক, প্রেমিকা না কি পথই ঈশ্বর। গানেই তো লেখা রয়েছে— ‘সকল গান টানিছে পথপানে’।

সেই পথে এক বার নামলে শুধু চলতেই হবে। চলে যেতেই হবে। ঝড়ের রাতেই তো অভিসার। তা-ই দুঃখ, আর তা ধারণেই আনন্দ।

তোমার মনে পড়ছে? রাজা নাটকে সুদর্শনা বলছেন, “অভিমান ভাসিয়ে দিয়ে যখনই রাস্তায় বেরিয়ে পড়লুম তখনই মনে হল— সেও বেরিয়ে এসেছে, রাস্তা থেকেই তাকে পাওয়া শুরু করেছি।... তার জন্যে এত যে দুঃখ, এই দুঃখই আমাকে তারসঙ্গ দিচ্ছে।”

কিন্তু শোক, দুঃখ, অপমানে সত্যিই কি তাই হয়?

হয়। আবার হয়ও না। তোমার প্রিয়জন মারা গেলেন, জগৎসংসারের প্রতি তোমার বিতৃষ্ণা এল, তুমি সব কিছু ছুড়ে ফেলে দিলে, গান নেই, কিছু নেই, সব মিথ্যে, সব অস্থির, শুধু হাহাকার। কিন্তু এক দিন দুপুরে তুমি হঠাৎ বুঝলে ‘আমারে যে জাগতে হবে, কী জানি সে আসবে কবে’। সে আসবে না, কোনও দিনই আসবে না। কিন্তু তোমার অপেক্ষা শুরু হল, সেই অপেক্ষা, সেই হাহাকার তোমাকে বাঁচিয়ে রাখবে বাকি জীবন, সেই হাহাকারই তো সে। এমনই তো হয়। সুধা ভোলেনি। ভোলে না।

হয়তো তাই হয়। হয়তো তাই নয়। কিন্তু ‘তরঙ্গ মিলায়ে যায়, তরঙ্গ উঠে’, শুনলে সব ভাসিয়ে দিয়ে কান্না পাবে আর তা শেষ হলে তুমি কোনও দিন হয়তো বুঝবে, ‘তরঙ্গ মিলায়ে যায়’-এর পরে সেই ধু ধু চরাচর তুমি নিজে, আর সামনে গর্জন করা একটা সমুদ্র। তুমি তার পারে বসে অপেক্ষা করবে না ‘অসীম তুমি আমার’ বলে ছুটে যাবে, সে তোমার অন্তর জানে। সেই যে স্কুলের প্রার্থনাসভায় গাওয়া হত, ‘তুমি যদি থাক মনে বিকচ কমলাসনে’, সেই থেকেই মনে গেঁথে গেল— বিকচ কমলাসনে। সরস্বতী, গানটার সামনে থাকা স্কুলের দেওয়ালে টাঙানো জিশুর ছবি সব মিলে মিশে গেল বিকচ কমলাসনে। পরে শুনলাম, ‘আজো ফোটে নাই সে ফুল, শুধু বহেছে এক হাওয়া... আমার হয়নি সে গান গাওয়া’। সেই গান গাওয়া হবে না কোনও দিন, কিন্তু ‘শুধু বহেছে এক হাওয়া’ তো গাইতে পারব আর সেই বাক্য তোমাকে এমন জায়গায় নিয়ে যাবে, যেখানে উচ্চারণেই আনন্দ। বিকচ কমলাসনে যিনি থাকেন, তাঁর দিকে যাওয়াই তো গানের ব্যাকুলতা। সেই ব্যাকুলতাই ধারণ করতে হয় গোটা জীবন। বিদ্যা, জ্ঞান, সুরের সঙ্গে এক বার দেখা হওয়ার পর তাকে যখন খুঁজে ফেরে রত্নাকর, তখন যেমন বলে— ‘সবে গেছে চলে ত্যেজিয়ে আমারে, তুমিও কি তেয়াগিলে’।

জানো, এক বার শান্তিনিকেতনের খ্রিস্টোৎসবে গিয়েছিলাম, উপাসনা গৃহে ২৫ ডিসেম্বরের সন্ধ্যায়, এসরাজে প্রথম ছড়টি পড়ল, কেঁপে উঠলাম। সমবেত কণ্ঠে ধ্বনিত হল— বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহারো। এই যে অনুভব, এই যে মিশে যাওয়া! ভাবো, গ্রেগরি পেক অড্রি হেপবার্নের স্মরণ অনুষ্ঠানে পড়ছেন, অড্রির প্রিয় কবিতা, ‘আনএন্ডিং লাভ’, “তোমারেই যেন ভালোবাসিয়াছি, শত রূপে শত বার জনমে জনমে, যুগে যুগে অনিবার।” কবিতাটি কোনও দিনই আমার প্রিয় নয়। কিন্তু কত দূরে থাকা অড্রির এত ভাল লেগেছিল!

এমনই তো হয়! তুমি বলতেই না এই ঘটনাটা, যদি না অড্রির সমাধিক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে গ্রেগরির এই কবিতা পড়া তোমাকে মনে না করিয়ে দিত আউট অব আফ্রিকা-র ওই দৃশ্য, যেখানে কারেন (মেরিল স্ট্রিপ) প্রেমিকের কফিনের সামনে দাঁড়িয়ে বলছেন, “হি ওয়াজ় নট আওয়ারস, হি ওয়াজ় নট মাইন”, আর তার পর হাতে মাটি নিয়ে ছড়িয়ে দিচ্ছেন, কিছু মাটি ছিটিয়ে দিচ্ছেন নিজের মাথায়। ধু ধু প্রান্তর এক। ঠিক মৃত্যুর মতো। সে পথে একাই যেতে হয়, একাই যাওয়া যায়।

যেমন নন্দিনী গিয়েছিল? হিংস্র ক্ষমতাতন্ত্র ভেঙে দেওয়ার রক্তকরবী-তেই তো বিশু পাগল তার জন্য গায়, “চোখের জলের লাগল জোয়ার... সেই পথ-হারানোর অধীর টানে অকূলে পথ আপনি টানে, দিক ভোলাবার পাগল আমার হাসে অন্ধকারে।”

সেই পথ!

হ্যাঁ। ‘পথে এবার নামো সাথী, পথেই হবে পথ চেনা’। মনে পড়ছে না?

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Rabindranath Tagore Bengali Literature

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

ক্যানসেল করতে পারবেন আপনার সুবিধামতো

Best Value
প্রতি বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

প্ল্যানটি সিলেক্ট করে 'Subscribe Now' ক্লিক করুন।শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
প্রতি মাসে

৪২৯

১৬৯

প্ল্যানটি সিলেক্ট করে 'Subscribe Now' ক্লিক করুন।শর্তাবলী প্রযোজ্য।