Advertisement
০৩ মে ২০২৪
Prosperity vs Political Grip of South India

সমৃদ্ধিতে, সাক্ষরতায় এগিয়ে দক্ষিণ ভারত! তবু জাতীয় রাজনীতিতে আরও কমবে প্রভাব

অর্থনীতির বৃদ্ধি এবং জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের যৌথ ফল হিসাবে দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে মাথাপিছু আয়ের পরিমাণও বেড়েছে। অন্য রাজ্যগুলির তুলনায় তা দুই থেকে পাঁচ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।

Southern States are more prosperous than the Northern or other states of India but they are lagging behind in national politics.

—প্রতীকী ছবি।

টি এন নাইনান
টি এন নাইনান
শেষ আপডেট: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৫:৫৬
Share: Save:

দক্ষিণ ভারতের চারটি রাজ্য— অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্নাটক, কেরল এবং তামিলনাড়ু ১৯৮৯ সালে জাতীয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ছ’ভাগের এক ভাগ সম্পন্ন করত। অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে তেলঙ্গানার জন্ম হওয়ার পরে সেই তালিকায় এখন পাঁচটি রাজ্য রয়েছে। এখন ভারতের সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ৩০ শতাংশ এই পাঁচটি থেকেই হয়ে থাকে। সে দিক থেকে দেখলে, ১৯৮৯-এর তুলনায় দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক কার্যকলাপের নিরিখে এদের কর্মকাণ্ড প্রায় দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। দক্ষিণ ভারত যে, দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় অর্থনৈতিক দিক থেকে অনেকটাই এগিয়ে রয়েছে, তা নতুন করে বলার নয়। কিন্তু এই অগ্রগতি ঠিক কতখানি, তার খতিয়ান নিতে বসলে অনেকেই আশ্চর্য বোধ করবেন।

পাশাপাশি, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারেও দক্ষিণের রাজ্যগুলি অন্যদের থেকে অনেক বেশি দক্ষতার পরিচয় রেখেছে। বিহার বা উত্তরপ্রদেশের তুলনায় এই রাজ্যগুলির জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার লক্ষণীয় ভাবে কম। এর ফলে এখানকার বাসিন্দারা অর্থনীতির সুফল অনেক বেশি মাত্রায় ভোগ করার সুযোগ পাচ্ছেন। অর্থনীতির বৃদ্ধি এবং জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের যৌথ ফল হিসাবে দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে মাথাপিছু আয়ের পরিমাণও বেড়েছে। অন্য রাজ্যগুলির তুলনায় তা দুই থেকে পাঁচ গুণ বেড়েছে। সত্যি বলতে, মহারাষ্ট্র বা গুজরাতের তুলনায় দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ এই মুহূর্তে বেশিই। কিন্তু যদি বিহার এবং কর্নাটকের মধ্যে তুলনা করা যায়, তা হলে যে কেউ বিস্মিত হবেন। কর্নাটকে মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ বিহারের পাঁচ গুণ বেশি। উত্তরপ্রদেশের তুলনায় তেলঙ্গানায় তা চার গুণ এবং অসমের তুলনায় কেরলে তা দ্বিগুণ। পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় তামিলনাড়ুতে মাথাপিছু আয় দ্বিগুণ।

আয়ের পরিমাণ বাড়ার ফলে দক্ষিণের রাজ্যগুলির আর্থ-সামাজিক চরিত্রেও পরিবর্তন লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে। অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় এখানে আয়ুষ্কাল বেশি। সাক্ষরতার হারের বৃদ্ধিও চোখে পড়ার মতো। উত্তর ভারতের তুলনায় দক্ষিণের মহিলারা গড়ে একটি করে কম সন্তানের জন্ম দেন। মহিলা-পিছু দু’টি সন্তানের জন্মদানের হারের থেকে জন্মহার কম হওয়ায় স্বভাবতই দক্ষিণের জনসংখ্যা কমছে। সেই তুলনায় গোদাবরী নদীর উত্তরের (সাধারণত নর্মদাকে উত্তর ও দক্ষিণের বিভাজনরেখা হিসেবে ধরা হলেও আমার মনে হয়, গোদাবরীকে ধরাই যুক্তিযুক্ত) রাজ্যগুলিতে জনসংখ্যার হার ক্রমাগত বেড়েই চলেছে।

এই ফারাক কিন্তু অন্য ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে। যেমন, রাজ্য সরকারের তরফে রাজস্ব বাড়ানোর ব্যাপারে তারতম্য নজরে পড়ার মতো অবস্থায় এসেছে। ঝাড়খণ্ডের জনসংখ্যা কেরলের প্রায় সমান হলেও সেখানে রাজস্বের হার কেরলের অর্ধেকেরও কম। মধ্যপ্রদেশ এবং তামিলনাড়ুর মধ্যে তুলনা আনলেও একই ছবি চোখে পড়বে। দক্ষিণের এই পাঁচটি রাজ্য থেকে যে পরিমাণ জিএসটি আদায় হয়, তা কেন্দ্রীয় আদায়ের এক চতুর্থাংশ। আবার কেন্দ্র থেকে রাজ্যে প্রদেয় অর্থের পরিমাণের দিক থেকে বিচার করলে দেখা যাবে, অন্য রাজ্যগুলির তুলনায় দক্ষিণের এই পাঁচটির প্রাপ্য এক ষষ্ঠমাংশেরও কম। এমন অবস্থা অবশ্যই কাঙ্ক্ষিত। কারণ, দরিদ্রতর রাজ্যগুলি কেন্দ্র থেকে কম অর্থ পেলে, তাদের পিছিয়ে থাকা চলতেই থাকবে। এ বিষয়ে দক্ষিণের রাজ্যগুলি কিন্তু কোনও অভিযোগ জানায়নি। ফলে কেন্দ্রীয় ভর্তুকি কম থাকলেও তাদের সঙ্গে উত্তরের রাজ্যগুলির অবস্থাগত পার্থক্য যথেষ্ট মাত্রায় থেকে গিয়েছে।

সোলার প্যানেল, বিদ্যুৎচালিত গাড়ি, মোবাইল ফোন বা অন্য বৈদ্যুতিন সামগ্রী উৎপাদনের মতো নতুন শিল্পক্ষেত্রগুলিতে বেসরকারি বিনিয়োগের পরিমাণ দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে উল্লেখযোগ্য রকমের বেশি। প্রযুক্তিগত পরিষেবার ক্ষেত্রে এই রাজ্যগুলি আগে থেকেই এগিয়ে ছিল। পশ্চিমের দু’টি রাজ্য— মহারাষ্ট্র এবং গুজরাত বাদ দিলে দেশের বাণিজ্যের সিংহভাগই দক্ষিণমুখী। ফলে, অর্থনৈতিক ভাবে পশ্চাদপদ পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলি থেকে শ্রমজীবী মানুষের এক বিপুল অংশ জীবিকার সন্ধানে পশ্চিম এবং দক্ষিণ ভারতে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন।

এই পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তী জনগণনা এবং তার সূত্রে সংসদীয় আসন পুনর্বিন্যাস (ডিলিমিটেশন)-এর বিষয়টিকেও দেখতে হবে। এই মুহূর্তে দক্ষিণের রাজ্যগুলি সংসদের মোট আসনের প্রায় এক চতুর্থাংশের ভাগীদার। কিন্তু জনসংখ্যার নিরিখে তারা মেরেকেটে দেশের এক পঞ্চমাংশ। আসন পুনর্বিন্যাসের পর এটা বদলে যাবে। লোকসভার শ’দুয়েক নতুন আসন তৈরি হলে, তার মধ্যে দক্ষিণের রাজ্যগুলি সামান্য কিছুই পাবে। পাশাপাশি, লোকসভা আরও বেশি নিয়ন্ত্রিত হবে উত্তর ভারতের সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যার রাজ্যগুলি থেকে, এবং তাদের পিছিয়ে থাকা সামাজিক-অর্থনৈতিক মাপকাঠি-সহই,যা নতুন ধরনের রাজনীতির জন্ম দিতে পারে। ভাষা-রাজনীতি এর একটা উদাহরণ।

জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সাফল্য সত্ত্বেও এ হেন বঞ্চনার বিরুদ্ধে দক্ষিণের রাজ্যগুলি ইতিমধ্যেই সরব হয়েছে। দক্ষিণ থেকে সংগৃহীত রাজস্ব উত্তর এবং পূর্ব ভারতে বিনিয়োগের কাজে লাগানোর মতো সমস্যার ব্যাপারে অবশ্য এখনও প্রতিবাদ দেখা দেয়নি। কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে যে তা দেবেই, সে কথা অনুমান করাই যায়। যে হেতু দক্ষিণের অধিকাংশ রাজ্যেই আঞ্চলিক দলগুলি ক্ষমতায় রয়েছে, সে হেতু জাতীয় স্তরের এবং উত্তরের দলগুলি দক্ষিণের এই প্রতিবাদকে উপেক্ষা করতেই পারে। কিন্তু, দল-ওয়াড়ি এই বিভাজন কিছুতেই ভৌগোলিক, অর্থনৈতিক, ভাষাগত এবং সামাজিক-রাজনৈতিক (যেমন, হিন্দুত্ব বনাম আঞ্চলিক আত্মপরিচয়) বৈষম্যগুলিকে ধামাচাপা দিতে পারে না। বরং সে ক্ষেত্রে বেশ কিছু ঝুঁকি থেকে যায়। সরকারকে হয়তো বেশি পরিমাণে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের অধিকার প্রদান বা রাজ্যসভার চরিত্রগত পরিবর্তন না করার পরামর্শ দেওয়া হবে। কিন্তু, দক্ষিণের রাজ্যগুলির সামনে উত্তরের বাজার উন্মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত কাজের কাজ কিছুই হবে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE