মিরপুরের সেই সকালটা এখনও মনে পড়ে। ছবির মতো। ২০০৬ সালের নভেম্বর। বাংলাদেশে হালকা-হালকা শীত পড়েছে। কিন্তু বহুতল গ্রামীণ ব্যাঙ্কের উচ্চকোটির ঘরে আতিথেয়তার ওম ঘুরঘুর করছে পোষা বেড়ালের মতো।
টেবিলের উল্টোদিকে যিনি বসে আছেন, তাঁর পরনে হাতি-পা পাজামা এবং চেক চেক কুর্তা। উপরে একটা অফ হোয়াইট জহরকোট চাপানো। জন্ম ১৯৪০ সালে। এখন তিনি চুরাশি। আগামী ২৮ জুন পঁচাশিতে পদার্পণ করবেন। হিসেব করে দেখছি, মিরপুরের সেই সাক্ষাতের সময় তিনি ছিলেন ছেষট্টি। সদ্য নোবেল পেয়েছেন। তখন তাঁকে ঘিরে এক অলৌকিক বিভা। সারা দুনিয়ার সংবাদমাধ্যম ছোঁক ছোঁক করছে একান্ত সাক্ষাৎকারের জন্য।
সেই ভনভনে ভিড়ে আমিও গিয়ে সেঁধিয়েছি। এবং কিমাশ্চর্যম, একান্ত সাক্ষাৎকারের একটা সময়ও পেয়ে গিয়েছি। আসলে গিয়েছিলাম ঢাকায় ফরাসি ফুটবলার জ়িনেদিন জ়িদানের সফর কভার করতে। কিন্তু সেই গঙ্গাকে মর্ত্যে আনার ‘ভগীরথ’ তো তিনিই। জ়িদানের সফর সংক্রান্ত রোজকার ডেসপ্যাচ না-হয় কলকাতায় আনন্দবাজার পত্রিকার বার্তা বিভাগে পাঠালাম। কিন্তু নোবেলজয়ীর সাক্ষাৎকারের একটা খাপ খুলে রাখব না? হাজার হোক, অমর্ত্য সেনের পরের বাঙালি নোবেলজয়ী তো তিনিই।
আরও পড়ুন:
কেন জানি না, বাংলাদেশে মুহাম্মদ ইউনূসকে সকলেই ‘সার’ (‘স্যর’ শব্দের পূর্ববঙ্গীয় অপভ্রংশ) বলে ডাকেন। তাঁর বয়স এবং সামাজিক উচ্চতার কারণেই সম্ভবত। কিন্তু তখন ‘সার’-কে পাওয়া এক দুর্ঘট ব্যাপার। একে নোবেলজয়ী। তার উপর জ়িদানের পোঁচ। কিন্তু ওই যে বলে না, সাতশো শকুন মরে একটা রিপোর্টার হয়! খুব উঁচু থেকে লক্ষ্যবস্তুর উপরে কড়া নজর রাখে। ফাঁক পেলেই ঝপ করে এসে বসবে। তো জ়িদান সংক্রান্ত একটা অনুষ্ঠানে ধরে ফেলা গেল ইউনূসের ভাই মুহাম্মদ জাহাঙ্গিরকে। লম্বাটে চেহারা এবং কাঁধে ঝোলা ব্যাগের জাহাঙ্গির পরামর্শ দিলেন, তার পরদিন সকাল সাড়ে ৯টা থেকে মিরপুরের গ্রামীণ ব্যাঙ্কে ‘অ্যাভেলেব্ল’ থাকতে।
সেই ‘অ্যাভেলেব্ল’ হয়েই ইউনূসের সাক্ষাৎকার নেওয়া। প্রায় উনিশ বছর আগের কথা। সাক্ষাৎকারের বিস্তারিত মনে থাকার কথা নয়। তবু একটা বিষয় ভুলিনি। তাঁর গ্রামীণ ব্যাঙ্কের কাজকর্ম নিয়ে বেশ কিছু অপ্রিয় এবং চোখা প্রশ্ন করেছিলাম। কিন্তু ইউনূস এক ছটাকও রাগেননি। মুখে হাসি ধরে রেখে জবাব দিয়েছিলেন। বলা বাহুল্য, সে জবাব তাঁর সংস্থা সম্পর্কে যাবতীয় অভিযোগকে নস্যাৎ করেই দেওয়া। কিন্তু রেগে যাননি। আরও যেটা মনে পড়ে, প্রত্যেকটি জবাব দেওয়ার আগে পানের ছোপ-লাগা দাঁত বার করে একগাল হেসেছিলেন। সে প্রশ্ন তাঁর প্রিয় হোক বা অপ্রিয়।
বিজ্ঞজনেরা বলে গিয়েছেন, কথার আগে যাঁরা হাসেন এবং কোনও কথাতেই রেগে যান না, তাঁরা মহর্ষি স্তরের হন। সেটা সেই ২০০৬ সালে তাঁর সঙ্গে কথা বলতে বলতেই মনে হয়েছিল। উনিশ বছর পরে এসে মনে হচ্ছে, মহর্ষি তো বটেই। মহামহর্ষি বললেও বাড়াবাড়ি হবে না।
শেখ হাসিনা তাঁকে জেলে পাঠানোর বন্দোবস্ত প্রায় করেই ফেলেছিলেন। সেখান থেকে খেলা ঘুরিয়ে দিয়েছেন। হাসিনা উৎখাতের পর তিনিই বাংলাদেশের তদারকি সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। বকলমে প্রধানমন্ত্রীই। ভাবা যায়! কিন্তু এহ বাহ্য, তার পাশাপাশি তিনি বাংলাদেশের প্রধান ব্যবসায়ীও। ইউনূসের বিভিন্ন কাহিনি এখন বাংলাদেশের বিভিন্ন মহলে ঘুরঘুর করে। অনেকে বলেন, ইউনূস গ্রামীণের নামে ৪,০০০ কোটি টাকার একচেটিয়া ব্যবসা করিয়েছেন। বাংলাদেশ সরকারের কাছে গ্রামীণের বকেয়া ছিল ৬৬৬ কোটি টাকা। ইউনূস ক্ষমতায় এসেই সেটা প্রথমে মকুব করিয়েছেন। গত তিন-চার মাসের মধ্যে গ্রামীণের নামেই তিন-চারটি লাইসেন্স নিয়েছেন। গ্রামীণ ফোন, গ্রামীণ বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি ইত্যাদি। অর্থাৎ, তাঁর সরকারই তাঁর সংস্থাকে বিবিধ সুবিধা পাইয়ে দিয়েছে। এ যদি খেলা ঘোরানো না হয় তো কোনটা?
হাসিনার প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রথম মেয়াদে (১৯৯৬-২০০১) ইউনূস প্রথম গ্রামীণ ফোনের লাইসেন্স পেয়েছিলেন। নামমাত্র ফি দিয়ে। কারণ, সরকারকে তিনি বলেছিলেন, ওই ফোন গ্রামের মহিলাদের জন্য, গ্রামের মহিলাদের ক্ষমতায়নের জন্য। কিন্তু হাসিনার সঙ্গে ক্রমশ তাঁর সম্পর্কের অবনতি হতে শুরু করে। তার কারণ হিসেবে অনেকে আমেরিকার সঙ্গে ইউনূসের সদ্ভাবের কথা বলেন। কারণ বা ব্যাখ্যা যা-ই হোক, ঘটনা হল, হাসিনা-ইউনূস সম্পর্কে ক্রমশ এক অনপনেয় দূরত্ব তৈরি হয়। সে দূরত্ব এতটাই ছিল যে, গ্রামীণ ব্যাঙ্ক নিয়ে ইউনূসকে শো কজ় করে বাংলাদেশ সরকার। গ্রামীণ ব্যাঙ্ক বাংলাদেশ সরকারের খাতায় নথিভুক্ত। অর্থাৎ, বাংলাদেশ সরকার ব্যাঙ্কে তাদের মনোনীত চেয়ারম্যান বসানোর ক্ষমতা রাখে। কিন্তু ইউনূস ব্যাঙ্কের এগ্জ়িকিউটিভ পদ থেকে সরতে চাননি। সেই কারণে সরকার তাঁকে শো কজ় করেছিল। কিন্তু ইউনূস, ওই যাকে বলে, মহামহর্ষি। তিনি গ্রামীণ ব্যাঙ্কের এজিএম ডাকেন। ব্যাঙ্কের গ্রহীতারা সব অজগ্রামের মহিলা। তাঁদের দিয়ে প্রস্তাব পাশ করিয়ে ইউনূস শীর্ষপদে থেকে যান। শুধু তা-ই নন, উল্টে সরকারের বিরুদ্ধে আদালতে যান। যদিও আদালত বলেছিল, সরকার তাদের আইন অনুযায়ীই চলেছে। তার পর থেকেই নাকি ইউনূসের সঙ্গে আমেরিকার ঘনিষ্ঠতা আরও বাড়ে।
আমরা অবশ্য এগুলো বিশ্বাস করি না। হাজার হোক, ‘সার’ নোবেলজয়ী। গুণিজন। কিন্তু ‘সার’-এর নিন্দকেরা বলে, তাঁকে নাকি নোবেল পুরস্কারের জন্য ‘তৈরি’ করা হয়েছিল। প্রথমে পেয়েছিলেন ম্যাগসাইসাই। তার পরে আরও বিবিধ আন্তর্জাতিক পুরস্কার। সেই ভাবেই নাকি তিনি নোবেলপ্রাপ্তির গোকুলে বেড়েছিলেন।
আরও পড়ুন:
নিন্দকেরা আরও বলে, অমর্ত্য সেন নোবেল পাওয়ার পরে আমেরিকার কাছে ইউনূসের একটা ‘বাড়তি গুরুত্ব’ তৈরি হয়েছিল। ঘটনাচক্রে, তার কয়েক বছরের মধ্যেই ইউনূস নোবেল পান। মনে পড়ছে, তাঁকে প্রশ্ন করেছিলাম, কাজ করেন অর্থনীতি নিয়ে। পেলেন ‘নোবেল শান্তি পুরস্কার’। অবাক হননি? ইউনূস হেসেছিলেন (যেমন কথার আগে হাসেন)। তার পর বলেছিলেন, ‘‘গত ১৪-১৫ বছর ধরেই শুনছি নোবেল পাব। বাজারে কথাটা চালুই ছিল। কেউ বলছিল, অর্থনীতিতে পাব। কেউ বলছিল, শান্তিতে। জানি না, কারা শান্তিতে নোবেলের জন্য নমিনেট করেন আর কারা অর্থনীতিতে। আমার ধারণা, দু’দিক থেকেই মনোনীত হয়েছি। তবে শান্তি কমিটি আগে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে। হতে পারে, অর্থনীতিতে এখন যখন দেয়নি, তখন ভবিষ্যতেও কখনও দেবে না। কিন্তু দু’দিকেই আমার নমিনেশন আছে।’’
দু’দিকেই তাঁর ‘নমিনেশন’ আছে কথাটা যে ভাবে বলেছিলেন, তার ভিতর থেকে একটা আত্মবিশ্বাস (না কি আত্মম্ভরিতা?) ঠিকরে বেরোচ্ছিল। যা তাঁর পরনের হাতি-পা পাজামা আর খোপ কাটা কুর্তার সঙ্গে একটুও খাপ খায় না। তখনই মনে হয়েছিল, ইনি কঠিন লোক।
নোবেল পেয়ে তিনি যে আপ্লুত, সেটা বোঝা যাচ্ছিল। কিন্তু একই সঙ্গে তিনি এটাও বুঝিয়েছিলেন যে, তাঁর নোবেলপ্রাপ্তিতে আসলে পাদপ্রদীপের আলোয় এল বাংলাদেশ। নইলে কি আর বলতেন, ‘‘বাংলাদেশের যত লোক, বাংলা ভাষাভাষী যত লোক, তারা সব আনন্দে লাফাচ্ছে। আবার জাপান, কোরিয়া, চিনেও লোকে ঘিরে ধরল। বললে, একজন এশীয় নোবেল পেয়েছে! কাজেই নোবেল পাওয়ার আনন্দের মাত্রাটা সর্বব্যাপী। যাঁরা লেখাপড়া জানেন, তাঁরাই শুধু নন। রাস্তা দিয়ে গেলে রিকশাওয়ালা থেমে যাচ্ছে, বাসওয়ালা বাস থামিয়ে গলাগলি করছে। কেন? না বাংলাদেশে একটা নোবেল পুরস্কার এসেছে। এটা তো একটা বিরাট ঘটনা। বাংলাদেশের সকলের জীবনেই।’’ তার পরে একটু থেমে, ‘‘পুরস্কার ঘোষণার পরেই চিনে গেলাম। মনে হল, যেন একটা হেড অফ স্টেট এসেছে। সকলে আমার কথা জানতে চায়, বুঝতে চায়, পরামর্শ চায়। আগে হলে হয়তো কেউ খেয়ালই করত না। এসেছে, চলে গিয়েছে। এখন ফার্স্ট পেজ নিউজ়!’’
আরও পড়ুন:
শুনতে শুনতে আরও মনে হয়েছিল, ইউনূসের দৃষ্টি অনেক দূরে নিবদ্ধ। তিনি নিজেকে নিছক একজন নোবেলপ্রাপক বা গ্রামীণ ব্যাঙ্কের সর্বেসর্বা হিসেবে দেখেন না। তিনি চান তাঁর পরিধি আরও বিস্তৃত হোক। হেড অফ স্টেট। যাঁর কথা লোকে জানতে চায়, বুঝতে চায়। যাঁর কাছে লোকে পরামর্শ চায়।
আদতে চট্টগ্রামের মানুষ। বাবা ছিলেন ব্যবসায়ী। ইউনূসও কালক্রমে তা-ই হয়েছেন বলে বাংলাদেশের অনেকে মনে করেন। চট্টগ্রামে ‘বাইন্যা’ বলে একটা শব্দ আছে। মানে ‘বেনিয়া’। ‘ব্যবসায়ী’। চট্টগ্রামের লোকেরা বলেন, ইউনূস হলেন গিয়ে সেই ‘বাইন্যা’। মামুলি বেনিয়া নন, তিনি এক সার্থক এবং সফল বেনিয়া। একে তো ব্যবসায়ী পরিবারে জন্ম। তার পরে আবার অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনাও করেছেন। ফলে ব্যবসা সম্পর্কে পারিবারিক জ্ঞানের সঙ্গে পুঁথিগত বিদ্যাও অর্জন করেছেন। বাণিজ্যসফল ‘গ্রামীণ’ সংস্থা তাঁর সেই অর্জিত বিদ্যার ফল।
বাংলাদেশের পূবালি বাতাসে ইউনূসের নাম বরাবর ভাসন্ত থেকেছে। তবে রাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে তাঁর নাম সবচেয়ে বেশি শোনা গিয়েছিল ১/১১-এর পরে। ইউনূসের বিরোধীরা বলেন, আমেরিকা তখনই তাঁকে বাংলাদেশের সরকারের প্রধান করতে চেয়েছিল। এবং যেহেতু এই উপমহাদেশে ভারত-বাংলাদেশ পারস্পরিক ইতিহাস দীর্ঘকালীন এবং একে অপরের সঙ্গে তারা বিবিধ বিষয়ে সম্পৃক্ত (সন্দিগ্ধুরা বলে থাকেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী কে হবেন, কোন দল সরকারে থাকবে, তা নাকি নয়াদিল্লিই বরাবর ঠিক করে এসেছে। এর কোনও আনুষ্ঠানিক সমর্থন থাকার কথা নয়। কোনও প্রামাণ্য তথ্যও নেই। ফলে আমরা একে রটনার স্তরেই রাখব), তাই আমেরিকা ইউনূস সংক্রান্ত প্রস্তাবটি নাকি ভারতকে দিয়েছিল। কিন্তু ভারত তা মানতে চায়নি।
আরও পড়ুন:
২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনের পরে যখন বাংলাদেশে অরাজকতা চলছে পুরোদমে, তখন ইউনূস বিদেশে। কিন্তু সক্রিয়। ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে তাঁর নাকি (এখানেও প্রামাণ্য তথ্যের অভাবে ‘নাকি’ শব্দটা রাখলাম) দৈনন্দিন যোগাযোগ ছিল। তিনিই যে কালক্রমে বাংলাদেশের তদারকি সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হবেন, তা নাকি তখন থেকেই স্থির ছিল। বাংলাদেশের জনতার একটা অংশ অবশ্য আরও পিছিয়ে যেতে চায়। তারা বলতে চায়, সেই ১/১১-র সময় থেকেই ইউনূসকে ‘তা’ দেওয়া শুরু হয়েছিল। মাঝখানে থিতিয়ে গেলেও ২০১৯ সাল থেকে সেটা আবার জোরকদমে শুরু হয়েছিল। ওম-টোম দেওয়ার পরে সেই ডিম ফুটে প্রধান উপদেষ্টার পদে ইউনূসের জন্ম হল ২০২৪ সালের অগস্টে। হাসিনা দেশান্তরী হওয়ার পর। বাংলাদেশের এক বাসিন্দা তিতকুটে গলায় বলছিলেন, ‘‘স্যর একজন ভয়ঙ্কর ক্ষমতালিপ্সু মানুষ। শেখ হাসিনা আমেরিকার সঙ্গে বৈরী পরিস্থিতি তৈরি না-করলে স্যরকে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে হত!’’ শুনে আবার মনে হল, এই হল খেলা ঘোরানো।
বাংলাদেশের ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে ওয়াকিবহালরা জানেন (এবং বলেন), ২০০৭ সালের শুরুতে সুশীল সমাজের আবডালে এবং সেনাবাহিনীর সহায়তায় ইউনূস তাঁর রাজনৈতিক দল গঠন করতে চেয়েছিলেন। সেই চেষ্টা তখন ব্যর্থ হয়। কারণ, তিনি আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি— দু’পক্ষকেই চটিয়ে দিয়েছিলেন। কয়েকমাস পরে ইউনূস নিজেই নিজেকে সক্রিয় রাজনীতি থেকে সরিয়ে নেন।
কেননা তিনি মহামহর্ষি। গড়পড়তা লোকের থেকে তাঁর বুদ্ধি বেশি। তিনি কোনও কিছুতেই রেগে যান না এবং কথার আগে হাসেন। ফলে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, ভুল হয়ে গিয়েছে। সতেরো বছর পরে ২০২৪ সালে ইউনূসের সেই রাজনৈতিক দলই আবার নব কলেবরে ফিরে এসেছে বাংলাদেশে। কিন্তু এখন তারা পরিপক্ব। এ বার তারা ২০০৭ সালের মতো ভুল করেনি। এ বার তারা আওয়ামী লীগের বিপক্ষে। বিএনপি-র পক্ষে।
কারণ, ইউনূস বাংলাদেশের মহামহর্ষি। গড়পড়তা লোকের থেকে তাঁর বুদ্ধি বেশি। তিনি কোনও কিছুতেই রেগে যান না এবং কথার আগে হাসেন।
তাঁকে নিয়ে এই লেখা লিখতে বসার আগের দিনই ইউনূস ঘোষণা করেছেন, ২০২৬ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচন হবে। কিছু দিন আগে জাপানে গিয়ে বলেছিলেন, ভোট হবে ২০২৬ সালের জুন মাসে। কারণ, তার আগে নির্বাচনী সংস্কারের কাজ শেষ হবে না। হঠাৎ সুড়ুৎ করে পিছলে এপ্রিলে চলে এলেন।
তাঁর সেই ঘোষণার পর থেকেই বাংলাদেশে এমন একটা অনুচ্চারিত রব উঠতে শুরু করেছিল যে, ইউনূস আসলে আরও বছরদুয়েক বকলমে প্রধানমন্ত্রী থেকে যেতে চাইছেন। এমনিতে বাংলাদেশে কখনও জুন মাসের ভরা বর্ষাকালে ভোট হয় না। নদীমাতৃক দেশ। ফলে প্রতি বর্ষাকালে বড় বন্যা বাঁধা। বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিবৃত্ত বলছে, অদ্যাবধি সেখানে ১১ বার ভোট হয়েছে। তার মধ্যে মাত্র এক বার জুন মাসে। তা-ও সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে।
ইউনূস ডিসেম্বর এড়িয়ে যেতে চাইছেন। তিনি বিলক্ষণ জানেন, ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় বা তৃতীয় সপ্তাহ থেকে বাংলাদেশে রোজার মাস শুরু হয়ে যাবে। চলবে মার্চের দ্বিতীয় বা তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত। তার পরে ইদ। ইদের পরেই ম্যাট্রিক পরীক্ষা। তার পরে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা। পরীক্ষার সময় ভোট হওয়া কঠিন। কারণ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভোটকেন্দ্র করা যাবে না। ফলে মার্চের শেষ থেকে মে মাস পর্যন্ত ভোট হওয়া মুশকিল। ভোট করতে হলে করতে হবে আগামী বছরের জানুয়ারিতে। অথবা ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে। ইউনূস ঘোষণা করে বসলেন এপ্রিলের কথা।
আরও পড়ুন:
খালেদা জিয়ার দল বিএনপি চেয়েছিল, ভোট হোক ডিসেম্বরে। যেমন বাংলাদেশে হয়ে থাকে। সেটা বড়জোর জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া যেতে পারে। ইউনূস চেয়েছিলেন, কোনওমতে জানুয়ারিটা গলিয়ে দিতে। তা হলে আরও অন্তত একটা বছর নিশ্চিন্ত! সে ভোট এপ্রিলেও হবে কি না, তা-ও অবশ্য খুব নিশ্চিত নয়। যেমন এ-ও নিশ্চিত নয় যে, বিএনপি পুরোপুরি ইউনূসের বিরুদ্ধে চলে যাবে কি না। বাংলাদেশের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে অবহিতরা বলছেন, জুলাই-অগস্ট নাগাদ ইউনূস-বিএনপি সমীকরণ স্পষ্ট হয়ে যাবে। গত অগস্টে যখন তিনি বাংলাদেশ সরকারের প্রধান উপদেষ্টার পদে বসেছিলেন, একাধিক সমীক্ষা অনুযায়ী তখন তাঁর জনপ্রিয়তা ছিল ৯০ শতাংশ। তখন তিনি ‘অবিংসবাদী নেতা’। যিনি বাংলাদেশকে দুর্নীতি, মূল্যবৃদ্ধি এবং কুশাসনের গহ্বর থেকে বার করে এক কুহকের দেশে নিয়ে যেতে এসেছেন। কিন্তু ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে সেই জনপ্রিয়তা নেমে এসেছিল ৭০ শতাংশে। এখন তা দাঁড়িয়েছে ৫০ শতাংশ। ৫০ শতাংশ জনপ্রিয়তা এখনও আছে, কারণ, বিএনপি এখনও পুরোপুরি তাঁর বিরুদ্ধে যায়নি।
কিন্তু ইউনূসের জনপ্রিয়তায় ঘাটতি হল কেন? হল, কারণ ঐতিহ্যগত ভাবে আওয়ামী লীগের ভোটার হয়েও মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের অনেকে জুলাইয়ে হাসিনা-বিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন। জিনিসপত্রের লাগামছাড়া মূল্যবৃদ্ধি এবং ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থায় বিপুল ডামাডোলের ফলে তাঁরা হাসিনার বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু হাসিনা দেশ ছাড়ার পর থেকে অগস্ট, সেপ্টেম্বর, অক্টোবর এবং নভেম্বরে যে সমস্ত ঘটনা ঘটেছে, যে ভাবে মুজিবুর রহমানের মূর্তি ভাঙা হয়েছে, ৩২ নম্বর ধানমন্ডিতে আগুন লাগানো হয়েছে, তাতে তাঁরা হাহাকার শুরু করেছেন।
এখন তাঁরা বুঝতে পারছেন, ইউনূস বাংলাদেশকে এক কুহকের দেশেই নিয়ে গিয়েছেন বটে। বাংলাদেশ পর্যবসিত হয়েছে এক ছলনা আর প্রতারণার ভূমিতে। কিন্তু দেরি হয়ে গিয়েছে। বোতল থেকে দৈত্য বেরিয়ে পড়েছে।
কী লিখলাম? দৈত্য? তওবা-তওবা! কথার আগে হাসেন এবং কোনও কথাতেই রেগে যান না দেখে উনিশ বছর আগে তাঁকে মহর্ষি মনে হয়েছিল। উনিশ বছর পরে মনে হচ্ছে মহামহর্ষি। নোবেল শান্তি কমিটি ঠিকই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।