Advertisement
E-Paper

দারিদ্রের মাপ

নীতি আয়োগের গবেষণাপত্র প্রকাশের সময় এবং তার ভাষার চলন দেখে অনুমান করা যায় যে, অর্থনৈতিক বিশ্লেষণের চেয়ে আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের দিকেই তাদের লক্ষ্য।

শেষ আপডেট: ১৮ জানুয়ারি ২০২৪ ০৮:৩৪

—ফাইল চিত্র।

জল আর জলপাই, আলু আর আলুবোখরা, বর আর বরকন্দাজ যে এক নয়, সুকুমার রায় না পড়লেও তা জানতে অসুবিধা থাকার কথা নয়। তেমনই, দারিদ্রের হার আর বহুমাত্রিক দারিদ্র সূচক (মাল্টিডাইমেনশনাল পভার্টি ইন্ডেক্স) যে এক বস্তু নয়, নীতি আয়োগের কর্তাদের কাছে সে খবর থাকার কথা। অনস্বীকার্য যে, মাছ আর মাছরাঙার মধ্যে যতখানি ফারাক, অর্থব্যবস্থার এই দুই সূচকের মধ্যে ব্যবধান ততখানি নয়। কিন্তু, প্রথমটি মাপে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা— বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম যেটুকু খরচ করা প্রয়োজন, সেই সামর্থ্য কত জনের নেই; বিভিন্ন পরিষেবা জনসংখ্যার কত শতংশের কাছে পৌঁছচ্ছে না, দ্বিতীয় সূচকটি তার পরিমাপ জানায়। উন্নয়নের ছবিটি বোঝার জন্য দু’টি সূচকই জরুরি, কিন্তু চালের কাজ চালতা দিয়ে সারা যায় না। বিভিন্ন ত্রৈরাশিক-ভগ্নাংশের হিসাব কষে নীতি আয়োগ জানিয়েছে যে, ২০০৫-০৬ সালের ২৯.১৭ শতাংশের তুলনায় ২০২২-২৩’এ বহুমাত্রিক দারিদ্র সূচক কমে দাঁড়িয়েছে ১১.২৮ শতাংশে। হিসাবটিতে ব্যবহার করা হয়েছে জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষা ৩ থেকে ৫-এর পরিসংখ্যান। সেই সমীক্ষার ফলাফল নিয়ে কিছু প্রশ্ন আছে, কিন্তু তার চেয়েও বড় প্রশ্ন হল, দারিদ্রের পরিমাপ করার জন্য পারিবারিক ভোগব্যয়ের হিসাব ব্যবহৃত হয়নি কেন? সহজ উত্তর, কেন্দ্রীয় সরকার সেই পরিসংখ্যান জনসমক্ষে আনতে চায় না বলে। ২০১৭-১৮ সালের জাতীয় নমুনা সমীক্ষা সংস্থার করা ভোগব্যয় সমীক্ষার ফলাফল এখনও প্রকাশিত হয়নি। অভিযোগ, তাতে প্রকৃত ভোগব্যয়ের পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে দেখা যেতেই সরকারের এ-হেন সিদ্ধান্ত। এর পর কি আর দারিদ্রের পরিমাপ নিয়ে কথা বাড়ানোর উপায় থাকে?

কিন্তু, কথা না বাড়িয়েও উপায় নেই। ভারতে দারিদ্রের পরিমাপ কী, সাম্প্রতিক কালে সে বিষয়ে বিশ্ব ব্যাঙ্ক (সুতীর্থ সিংহরায় ও রয় ভ্যান ডার উইড) এবং আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডার (সুরজিৎ ভল্লা, করণ ভাসিন ও অরবিন্দ ভিরমানি) থেকে ‘ওয়ার্কিং পেপার’ প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু উভয় পরিসংখ্যানের ক্ষেত্রেই প্রশ্ন রয়েছে— প্রথমটির ক্ষেত্রে কিছু পদ্ধতিগত প্রশ্ন, দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে সর্ব গোত্রের প্রশ্ন। অন্য এক গবেষণায় পিরিয়ডিক লেবার ফোর্স সার্ভে এবং জাতীয় নমুনা সমীক্ষা সংস্থার কর্মসংস্থান সংক্রান্ত পরিসংখ্যান ব্যবহার করে, ভারতীয় কর্মক্ষেত্রে কাঠামোগত পরিবর্তনের গতি হিসাব করে দারিদ্রের অনুপাত মাপার চেষ্টা করেছেন মৈত্রীশ ঘটক ও ঋষভ কুমার। সেই হিসাবে দেখা যাচ্ছে, ভারতে দারিদ্রের অনুপাত কম-বেশি ২০ শতাংশের কাছাকাছি। তেন্ডুলকর কমিশনের হিসাব থেকেও যে অনুমানে পৌঁছনো যায়, তা এই সংখ্যাটিরই নিকটবর্তী। অর্থাৎ, ভারতে ২০১১-১২ সাল থেকে দারিদ্র কমেনি। এবং, এই হিসাব বলছে, ভারতে বহুস্তরীয় দারিদ্র সূচক দাঁড়িয়ে আছে ১৭-২৭ শতাংশের ঘরে। নীতি আয়োগ যে হিসাব দিচ্ছে, তার চেয়ে অনেক বেশি।

নীতি আয়োগের গবেষণাপত্র প্রকাশের সময় এবং তার ভাষার চলন দেখে অনুমান করা যায় যে, অর্থনৈতিক বিশ্লেষণের চেয়ে আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের দিকেই তাদের লক্ষ্য।
দুর্ভাগ্যজনক, কারণ নীতি আয়োগ গঠনের সময় তাকে সরকারপক্ষের প্রচারযন্ত্র হিসাবে বর্ণনা করা হয়নি, বলা হয়েছিল যোজনা কমিশনের পরিবর্তে এই প্রতিষ্ঠানটি দেশের সর্বাগ্রগণ্য আর্থিক ‘থিঙ্ক ট্যাঙ্ক’ হবে। অর্থব্যবস্থার কথা বলতে গিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারকে বিভিন্ন গোত্রের চাতুর্যের সাহায্য নিতে হচ্ছে কেন? কারণগুলি স্পষ্ট— গত দশ বছরে এ দেশে মাথাপিছু আয়বৃদ্ধির হার নিম্নমুখী, কর্মসংস্থানের অবস্থা ভয়াবহ। কৃষি থেকে শিল্পক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের গতি কার্যত স্তব্ধ। ফলে, ভারতে যে আর্থিক বৃদ্ধি ঘটেছে, তার অসমতা সম্ভবত শাসকদেরও ভয় পাইয়ে দিচ্ছে। পরিসংখ্যানের মেঘজালে সত্যকে আড়াল করা যায় কি না, এখন সম্ভবত যা যাচাই করে দেখা হচ্ছে।

niti ayog Poverty
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy