Advertisement
E-Paper

ইন্ডিয়ারেই কইলকেতা কয়

আমি তো বলিনি, যাব! এমন ভাঙাচুরো বাড়ি, অভাব-কষ্টে দিন কাটানো, খারাপ? কই, বলিনি তো! লিখছেন অধীর বিশ্বাস আমি তো বলিনি, যাব! এমন ভাঙাচুরো বাড়ি, অভাব-কষ্টে দিন কাটানো, খারাপ? কই, বলিনি তো! লিখছেন অধীর বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ১৪ অগস্ট ২০১৮ ১২:৫১
অলঙ্করণ: তিয়াসা দাস

অলঙ্করণ: তিয়াসা দাস

‘আরে, করে কী!’ চিৎকার করে ওঠে লোকটা। জামা খামচে টেনে আনে গেট থেকে। ‘এক্ষুনি চাকার তলায় দু-ভাগ হয়ে যেতিস যে!’
থর থর কাঁপে ছেলেটি। বুঝে উঠতে পারে না।
কলারসুদ্ধ জামা লোকটার হাতের মুঠোয়। বলল, ‘আসছিস কোথা থেকে?’
‘দাদা!’ বলেই ভ্যাক করে কেঁদে ফেলল।
‘কাঁদবি পরে, ভিতরে ঢোক, ঢোক বলছি!’ লোকটাই নয়, আরও দু’-চার জন আঁতকে উঠল।
‘আজ লেট হয়ে যেত। লাশ বের করে পুলিশ না-নিলে ট্রেন ছাড়ত না।’
‘ঠিক তা না, লাফ দিলে প্ল্যাটফর্মেই পড়ত। মাথা ফেটে ঘিলু বেরিয়ে—! যা হোক, ওকে বাঁচিয়ে দিলেন, দাদা!’
ছেলেটা, মানে, আমি কাঁদছি না আর। হু হু করে জল বেরিয়েই যাচ্ছে। আবার দেখতে যাচ্ছিলাম। ঘাড় চেপে বসিয়ে দিল অন্য লোক। ‘তোর দেখছি মরার পাখনা উঠেছে!’
ভয় লাগে খুব। বস্তার দিকে গুঁজে যাই। নতুন দেশ। স্টেশন ছাড়ার সময় ভোঁ বাজানো শব্দ শুধু।
‘কী রে, বললি নে যে!...কার সঙ্গে এসেছিস? মা-বাবা কেউ আছে সঙ্গে?’
এক এক জনের এক এক মুখ। নানান জনের নানা কথা। রেলগাড়ি এত জোরে যায়? গাছপালা দালানবাড়ি। পর পর দেখা দিয়েই চলে যাচ্ছে।
দুটো বস্তাতেই হাত আমার। নামব কনে যেন? হ্যাঁ, কইলকেতা। আর তো কিছু জানিনে! য্যানে নামব, স্যানে কি বস্তাগুলো একা নামাতি হবে? পারব?


কথাবার্তা শোনার চেয়ে এ সবই খালি ঘুরে বেড়াচ্ছে। কী করে নেব? বড় বস্তাটা বাড়ি থেকে এতটা দাদা-ই এনেছে। দাদারটাই ভারী বেশি। অনেক রাত্তিরে যখন জিনিসপত্র ভরা হচ্ছিল, বাবা বলে বলে দিচ্ছিল।...এই ভাবে ঢুকা। ঠা’সে ঠা’সে দে সব।

আরও পড়ুন: ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’র জমি অনেক দিন আগেই বলিউড তৈরি রেখেছিল

সেই লোকটা আবার। আমার দিকে তাকাচ্ছে। কেন এত তাকানো? দাঁড়িয়ে আছি বলে, যে লোকটা খামচে ধরেছিল, বলল, ব’স!
তবু...। ‘জায়গা আছে তো, ব’স!’
দুই ভাই বস্তা নিয়ে ভিতরে গেছিলাম যখন, তাড়িয়ে দিল। বলল, ভেন্ডারে যা!
প্রথম রেলগাড়ি চড়া আমাদের। ভেন্ডার কী, জানি না! বুঝতে পারিনি বলে গেটের পাশেই। লোকজন উঠছে। নামছে। কেউ কিছু বলেনি। ছোড়দা হঠাৎ বলল, খিদে পাইছে?...দাঁড়া, কিছু কিনে আনি।
‘কী কিনবি? পামরুটি?’
‘দেহি কী পাই!’ তার পর গাড়ি থেকে নামল। মুখ ফিরিয়ে বলল, বস্তার-তে হাত সরাবি নে কিন্তু!’


বেশিক্ষণ হয়নি, হঠাৎই গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে। দাদা রয়ে গেল।
এক বার ব্ল্যাক মার্কেটেদের সঙ্গে এসেছিল দাদা। এসে চিনে গেছে। বর্ডার পাস করাতে অনেক টাকা নেয় বলে, এ বার একাই এসেছে আমাকে নিয়ে। যা টাকা সরাসরি ইপিআরকে (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস) দেবে। কথা বলে দেখেছে, তাতে নাকি অনেক কম। মাথাপিছু ষাট টাকা। আয়ুব খানের পুলিশ এ সবের জন্যেই বসে থাকে নাকি। দাদা বলছিল, অনেকটা পয়সা বাঁচল। আরও বলছিল, যে ভাবে দেশ ছাড়ছে সব, যদি বর্ডারে এসে পুলিশের সঙ্গে ‘সাট’ করে যাওয়া যায়, লোক পাস করালে দেখছি বেজায় রোজগার।
বার বার চোখ রাখি। ‘আরে, তোর ওই বস্তা কে নিতে আসবে?’

আরও পড়ুন: স্বাধীনতা, তুমি একটা সুদীর্ঘ মিছিলের স্বপ্ন

না-তাকালেও কেমন লাগছিল নিজের কাছে। ছেঁড়া জামা দড়িভরা প্যান্ট। দাদা বলেছে, কাচা জামা-প্যান্ট বস্তায় দে। জল জঙ্গল ধানখেতের মধ্যি কনে দৌড় দিতি হয়, জানি নে। পলায় থাকতি হবে। ভাল জামাকাপড়ের দরকার কী।
স্টেশনে স্টেশনে ভিড় বাড়ছে। বসেই জানতে পারি, এটা বনগাঁ লোকাল। লোকাল মানে, কাছাকাছি না?
‘কোন জিলায় বাড়ি? কথা শুনে তো মনে হচ্ছে, যশোর। ঠিক তো!’
মাথা নাড়াই। জানল কী করে? কথায় কথায় এ দেশের মানুষ বুঝে ফেলে জিলার কথা?
‘চ্যানাচুর!-- মছলন্দপুরের চ্যানাচুর। দশ নয়া প্যাকেট!’
পামরুটি কিনেছে, দাদা? দুটোই খেয়ে ফেলল? আমার জন্যে রেখে দিয়েছে? কোন রেলগাড়িতে আসবে? সেটাও কি বনগাঁ লোকাল? এ দেশে এত লোক? যেন আমাদের মাগরো হাটের ভিড়!

আরও পড়ুন: স্বাধীনতা দিবসে কার্গিলকে যেমন দেখেছি

‘থাক, এখন কিছু জিজ্ঞেস করবেন না। খুব কেঁদেছে। হিক্কা উঠছে।’ আমার চুপ-থাকা দেখে পাশের যাত্রী বললেন।
বসে থাকা ছাড়া কিছু করার নেই এখন। দেশের বাড়ি চলে যাই আবার। বস্তা-গুছোনো রাত দেখি। সত্যি, বাবারা অনেক কিছু জানে। গুছোতে গুছোতে হঠাৎ উঠে পড়ল। ট্রাঙ্কের ডালা খুলে বের করল কটা জিনিস। লম্ফে কি তেল কম? কানের কাছে ঝাঁকাই। সেজদা বলল, কত্তিছিস কী?
‘এ-কটা জিনিস নিয়ে যা। তোগের মা-র এগুলোই আছে। তার হাতের এট্টা মোটে ক্যাঁথা থাকপে। উডা আমিই নিয়ে যাব।’
‘কোন ক্যাঁথা, বাবা?’
‘দেহিসনি তুই। আছে। সূচ-সুতোর গাছপালা। নাঙল চষা। নওলা মাছের ছবি-আঁকা ক্যাঁথা। তুরা খালি পুজোর ঘণ্টা কোশাকুশি, আর যে বেতের আড়িতে লক্ষ্মীপুজো করত, এগুলোই নিয়ে যা। ইন্ডিয়ায় যায়ে যদি লক্ষ্মীপুজো করি, এই আড়িতেই লক্ষ্মী সাজাব।’’
‘বাবা, মা-র কাঠপিঁড়িডা নেব?’
‘ও নিয়ে কী করবি? মানুষডাই থায়ল না যহন, উডা নিয়ে...!’

আরও পডু়ন: তিন প্রজন্মের স্বাধীনতা

‘রাহে দিতাম আমার কাছে। মনে হবে, এই তো মা! পিঁড়িতে ফুলো পা দুডো রা’খে ভাঙা চেয়ারে...!’
লম্ফের আলোও কি শীত-রাত্তিরে কাবু থাকে? চুপচাপ জ্বলেই যাচ্ছে। অল্প অল্প নড়ে। কাদামাখা চটার উপর যে ফাঁকা, সেই ফাঁকা দিয়ে ঠাণ্ডা হাওয়া হু হু করে ঘরে ঢোকে। ওম নিতে চায়। ছেঁড়াভুড়ো কাঁথামুড়ি দিয়ে বাবা বলে বলে দেয়। চোখের নীচে ভেজা দেখাচ্ছিল না? কাঁদছে? কখন থেকে? কেন কাঁদছে, বাবা?

আমি তো বলিনি, যাব! এমন ভাঙাচুরো বাড়ি, অভাব-কষ্টে দিন কাটানো, খারাপ? কই, বলিনি তো! বাবা-ই তো বলল, পাশ করলিই কালিদাস পাঠায় দিতি কইছে! যাবি তো ইন্ডিয়ায়?
‘কইলকেতা তো?’
‘হ্যাঁ। ইন্ডিয়ারেই কইলকেতা কয়।’
‘পাকিস্তানে পড়ব না আর?’
‘না। হিন্দুরা সব চ’লে যাচ্ছে। আমরাও যাব।’ গলা নামিয়ে বলল, এ সব কাউরি কয়ে বেড়াসনে যেন!’
‘এ বাড়ি আসপ না আর?’

আরও পড়ুন: তারুণ্যের দীপ্তিতে উদ্দীপ্ত হোক স্বাধীনতা

‘ছা’ড়ে গেলি আর কি আসা যায়?’ শ্বাস ফেলে বাবা বলল, ‘জানি নে, কিডা কেনবে এই বাড়ি!’
‘সুধীর কাকুরে কলি হয় না?...কাকা তো খুব বড়লোক!’
‘না, বেচার কথা কলিই কি বেচা যায়?’
‘বাবা, মুসলমান যারা, তারা থাকপে? তারা যাবে না?’
‘কী সব কচ্চিস!’ বাবার বোধ হয় রাগ হল কথা শুনে।
কিন্তু আমি ঠিকই বলেছি। হিন্দুরাই সব যাচ্ছে। মুসলমানদের এক ঘরও যায়নি। স্কুলে হাটে যে যে জায়গা যাই, কথাবার্তার সময় যেই কিছু বলতে যাই, তখনই, এই মালায়নের বাচ্চা, চুপ কর! অনেক কথা তাই বলি না।
বাবাও আজকাল বলে, হাটে চুল কাটার পর দুইজন পয়সা না দিয়ে চলে গেল। ক’লো, পরে দেব। বাবা আরও বলে, জানি, উরা আর দেবে না। চাওয়াও যাবে না।
‘তা’লি চলো, সগলি এক সঙ্গেই চলে যাই!’

অলঙ্করণ: তিয়াসা দাস

Independence Day Independence Day Celebration Partition স্বাধীনতা দিবস
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy