অলঙ্করণ: তিয়াসা দাস
স্বাধীনতা আসে রাতের অন্ধকারে। ‘ফ্রিডম অ্যাট মিডনাইট’! আর ঠিক তখন আমি দু’চোখ ভরে একটা অশেষ মিছিলের স্বপ্ন দেখি। গুলি-বারুদের শব্দ আর নেই। যুদ্ধ শেষ। মাঠে মাঠে প্রসারিত শান্তি। শঙ্খ বাজছে, ঘণ্টা বাজছে, এয়োতীরা উলু দিচ্ছে, পুষ্পবৃষ্টি হচ্ছে। শ্রাবণের মিঠে সমীরণে পতপত করে একটা পতাকা উড়ছে। দূরে, অনেক উঁচুতে, আমি আর তার নাগাল পাই না মোটেই!
আমার ঘুম ভেঙে যায়। বাইরে তখন সঘন গহন রাত্রি। আকাশে কাস্তের ফলার মতো চাঁদ, আর তাকে ঘিরে তারাদের রং ঝিলমিল। প্রশ্ন করি নিজেই নিজের কাছে, কোনটা আমার স্বাধীনতা দিবস, ভারতের ১৫ই অগস্ট, নাকি মার্কিনদেশের ৪ঠা জুলাই! কোনটা আমার দেশ, যে দেশের মাটিতে আমার মা-বাবা আমাকে জন্ম দিয়েছিল, সেই ভারতবর্ষ, ‘ভারতবর্ষ, সূর্যের এক নাম’! নাকি আমেরিকা, যে দেশটা আমার হাতে একটা দুর্লভ কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বলেছিল, ওয়েলকাম টু ইউএসএ। ‘ইউএসএ, হোয়ার লিবারটি ইজ এ স্ট্যাচু’! স্বাধীনতা কি রক্তচোখের কাঁটাতার, নির্দয় বন্দুক আর ভারী বুটের আওয়াজে ঘেরা একটা ভূখণ্ড মাত্র! নাকি স্বাধীনতা আসলে অনুভব, একটা উপলব্ধি!
স্বাধীনতা হল একটা ব্যবস্থা, একটা প্রতিষ্ঠান, যার আড়ালে বসে ক্ষুধার্ত নেকড়ের মতো নিয়ত থাবা চাটে শাসকের শোষণযন্ত্র, যার দাঁতে লাল, নখে লাল! এই কথাগুলি বলতেন কবি তথা সাংবাদিক কৃষ্ণ ধর, যিনি আমাদের ‘মুল্যবোধভিত্তিক সাংবাদিকতা’-র দীক্ষা দিয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে উনি আমাদের সংবাদপত্রের ইতিহাস পড়াতেন। সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পাঠ দিতে গিয়ে উনি আমাদের রবি ঠাকুরের ‘কণ্ঠরোধ’ প্রবন্ধটা পড়ে শুনিয়েছিলেন। কৃষ্ণবাবু বলেছিলেন, সাংবাদিকতায় স্বাধীনতা বলে কিছু হয় না। যেই তোমরা কিছু লিখতে যাবে, তখনই খবরের ব্যবসার দোহাই দিয়ে চতুর বাজার তোমাদের কলম ধরে টান মারবে। যেই তোমরা কিছু বলতে যাবে, অমনি বিজ্ঞাপনের লোভ দেখিয়ে তোমাদের গলা টিপে ধরবে চালাক কর্পোরেট! তা হলে স্বাধীনতা কী! কোথায় স্বাধীনতা! কীসের স্বাধীনতা!
মনে আছে, একবার হাইস্কুলে স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে আমি শামসুর রাহমানের কবিতা আবৃত্তি করেছিলাম: ‘স্বাধীনতা তুমি ফসলের মাঠে কৃষকের হাসি, স্বাধীনতা তুমি মজুর যুবার রোদে ঝলসিত দক্ষ বাহুর গ্রন্থিল পেশী’। আমাকে এসে জড়িয়ে ধরেছিলেন গৌতমদা, আমাদের ফিজিক্সের টিচার। বলেছিলেন, এই কবিতা তোকে কে শেখাল? স্বাধীনতা আসলে একটা সোনার পাথরবাটি রে, একটা সাজানো-গোছানো মিথ্যা। এ কথা বলেই উনি নিজের কাঁধের ঝোলাব্যাগ থেকে একটা ‘লাল বই’ বের করে বলেছিলেন, ‘জানিস, স্বাধীনতার রজতজয়ন্তীতে এই বইটা পড়েছিলাম বলে আমাকে জেলে ভরে দিয়েছিল’! কেন, একটা স্বাধীন দেশে একটা বই পড়ার জন্যে এক জনকে জেলে যেতে হবে কেন? কারণ, তখন গৌতমদারা বলতে চেয়েছিলেন, একটা দেশের স্বাধীনতা মানে সে দেশের সব মানুষ খেতে পাবে, পরতে পাবে, মাথার ওপর ছাদ পাবে। সে দেশের সব শিশু ভোরের স্কুলে পড়তে যাবে, পড়ার শেষে কাজ পাবে! গৌতমদারা বাক-স্বাধীনতা চেয়েছিলেন! গৌতমদার কাছে ওই ‘লাল বই’-টা পড়তে চেয়েছিলাম, দেননি, বলেছিলেন, ‘পরে, এখন এটা পড়’। উনি আমাকে রবীন্দ্রনাথে ‘জীবনস্মৃতি’ পড়তে দিয়েছিলেন, যে বইটার কয়েকটা পঙক্তির নীচে লালকালির দাগ দেওয়া ছিল। আমরা বাইরে এসেছি, স্বাধীনতা পাইনি। ছিলাম খাঁচায়, এখন বসেছি দাঁড়ে, পায়ের শিকল কাটেনি। তা হলে কোনটা আমার স্বাধীনতা দিবস? কোনটা আমার দেশ?
আরও পড়ুন: ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’র জমি অনেক দিন আগেই বলিউড তৈরি রেখেছিল
আমার বাবার স্বাধীনতা দিবস কোনটা? কোনটা আমার মায়ের দেশ? স্বাধীনতা যেমন আসে মাঝরাতে, তেমনই এক বিষণ্ণ রজনীর মধ্যযামে আমার বাবাকে এক বস্ত্রে দেশত্যাগী হতে হয়েছিল, পিছনে খেলাঘরের মতো ফেলে রেখে আসতে হয়েছিল ঢাকা বিক্রমপুরের পাইকপাড়া গ্রাম। আমার মাকেও পাতের অর্ধেক ভাত ফেলে রেখে নিশীথের আঁধারে ভিটেমাটি ছাড়তে হয়েছিল, পিছনে ফেলে আসতে হয়েছিল সিলেটের সুনামগঞ্জের পুতুলখেলার স্মৃতি। আমার বাবা-মায়ের নতুন দেশ ছিল একটা শরণার্থী শিবির! উদ্বাস্তুপনার উত্তরাধিকার! বাস্তুহারা বাপ-মায়ের এক ছিন্নমূল সন্তান আমি। স্বাধীনতা বলতে আমি একটা মিছিলকে বুঝি, লম্বা স্বপ্নিল একটা মিছিল! আমার বাবাও শামসুর রাহমান আবৃত্তি করত, ‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা, হাড্ডিসার এক অনাথ কিশোরী শূন্য থালা হাতে বসে আছে পথের ধারে’। কোন স্বাধীনতার কথা বলত বাবা? আমার মা ‘ও আমার দেশের মাটি’ গাইত কোন দেশের কথা ভেবে?
আরও পডু়ন: ইন্ডিয়ারেই কইলকেতা কয়
একটা ভোরের ট্রেনের কথা খুব মনে পড়ে। সাঁকোর মতো এ পার-ও পার জুড়ে দেওয়া একটা রেলপথ। সম্পর্কের সেতু। দুই পারে তার দুই দেশ আর তাদের দুই নদী, গঙ্গা আর পদ্মা। বাবা-মায়ের সঙ্গে আমরা তিন ভাইবোন ওই ট্রেনটায় চেপে কলকাতা থেকে মালদহ ফিরতাম। ট্রেনটা যখন ফরাক্কা ব্যারেজ পেরচ্ছে, দুই নদীকে তখন রাঙিয়ে দিয়েছে হিরন্ময় কিরণমালা, ‘বঁধু, কোন আলো লাগল চোখে’! পাখির ডাকে ঘুমের থেকে জেগে আকাশের মেঘেরা এ দেশে ও দেশে উড়ে বেড়াচ্ছে। আমাদের তিন ভাইবোনকে ঘুম থেকে তুলে বাবা-মা চেঁচিয়ে উঠত, ওই দ্যাখ, ওই দ্যাখ, আমাগো দ্যাশ! মা বলত বাবাকে, হ্যাঁগো, আমরা আর ওপারে যাব না কোনও দিন? বাবা বলত, এপার-ওপার বুঝি না, আমার একটাই দেশ, ‘অপার বাংলা’! তখন এ সব কিছুই বুঝতাম না আমি। সকালের ঘুম-জড়ানো চোখে শুধু দেখতাম, মা আমাদের তিন ভাইবোনের পানে চেয়ে আছে একটা ‘মন ভাল নেই’ দৃষ্টিতে। ‘কেন চেয়ে আছ গো মা, মুখপানে’!
এখন বুঝি, আমার মতো, আমার বউ সুতপার মতো, আমার কন্যা লগ্নজিতার মতো, আমার মা-বাবারও কোনও দেশ ছিল না, কোনও স্বাধীনতা দিবস ছিল না। ছিল শুধু একটা স্বাধীন দেশের স্বপ্ন, রবিঠাকুর থাকলে যার নাম দিতেন ‘নষ্টনীড়’! স্বপ্নের এ রকম একটা পোড়ো জমিতে দাঁড়িয়েই মানুষ নিজেকে প্রশ্ন করে, কোনটা আমার দেশ? আমার স্বাধীনতা দিবস কোনটা? কেউ কি জানে, সলমন রুশদি বা তসলিমা নাসরিনের দেশ কোনটা, কিংবা মকবুল ফিদা হুসেনের স্বাধীনতা দিবস কোনটা! কোনটা জন লেননের নিজের দেশ! তাঁরা তো আসলে এমন একটা দেশ চেয়েছিলেন, যেখানে কলমটা স্বাধীন, তুলিটা মুক্ত, কণ্ঠটা অবাধ। পাননি। কে-ই বা পেয়েছে! আফ্রিকার ওই কালো ভুখা মানুষগুলো পেয়েছে? ওদের কাছে গোটা দেশটাই তো লঙ্গরখানা, সারা জীবনটাই দুর্ভিক্ষ! ‘ ক্ষুধিত পাষাণ’-এর মেহের আলির মতো ওরা তো কোনও না কোনও দিন চেঁচিয়ে উঠতেই পারে, ‘সব ঝুট হ্যায়, ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়’! আর মধ্যপ্রাচ্যের সেই দুধের শিশুটির কথা কি ভোলা যায়! নিজের দেশ ছেড়ে বাবা-মায়ের সঙ্গে ভেলায় চেপে পালাতে গিয়ে সে ডুবে গিয়েছিল মাঝসমুদ্রে। আর মরণসাগরের মারে সেই নিষ্প্রাণ শিশু মুখ থুবড়ে পড়ে ছিল বেলাভূমির বুকে! ওই বাচ্চাটার দেশ কোনটা? যে বাবা-মায়ের ছেলেমেয়েরা এ ভাবে ভেসে যায় সাগরের জলে, তাদের স্বাধীনতা দিবস কোনটা?
আরও পড়ুন: তিন প্রজন্মের স্বাধীনতা
শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপঙ্করকে মনে আছে? সীমানা দিয়ে কোনও দেশ বেঁধে রাখতে পারেনি তাঁকে। তিনি ছিলেন বিশ্ব নাগরিক। তিনি চেয়েছিলেন জ্ঞানের মুক্তি, শিক্ষার স্বাধীনতা। ‘হোয়্যার নলেজ ইজ ফ্রি; হোয়্যার দ্য ওয়ার্ল্ড হ্যাজ নট বিন ব্রোকেন আপ ইনটু ফ্র্যাগমেন্টস বাই ন্যারো ডোমেস্টিক ওয়ালস’! লিখেছিলেন রবি ঠাকুর। মনে পড়ে গেল তাঁর সমবয়সী আর এক জনের কথা, তিনি এক জন বিশ্বপর্যটক, বীর সন্ন্যাসী। তখন তিনি এক জন মামুলি পিতৃহীন কর্মহীন যুবক, ঘরে তীব্র অনটন। আর সেই তিনিই কি না শুনলেন পরম মোক্ষের ডাক। মন্দিরের মাতৃমূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে তিনি অর্থ চাইলেন না, যশ চাইলেন না, বললেন, ‘বিবেক দাও মা, বুদ্ধি দাও’! কালক্রমে তিনি হয়ে গেলেন বিবেকানন্দ, সব দেশের সীমান্ত পেরিয়ে তিনি হয়ে উঠলেন চিন্তার মুক্তিদূত। বিবেকানন্দ আসলে দেশ বলতে, স্বাধীনতা বলতে, একটা সুমধুর স্বপ্নকে বুঝতেন।
ঠিক যেমন স্বাধীনতা দিবস আমার কাছে একটা স্বপ্ন, একটা সুদীর্ঘ মিছিলের স্বপ্ন। মুক্তিসেনাদলের সেই ঐতিহাসিক লং মার্চ। আমার স্ত্রী-কন্যার হাত ধরে ‘দেশহীন’ আমি ওই মিছিলে হাঁটছি। মিছিলের পুরোভাগে আমার বাবা-মা। পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটছেন কৃষ্ণবাবু, গৌতমদা। মিছিল চলেছে ধূসর তিউনিসিয়া থেকে বিপ্লবী ফ্রান্স, বিপ্লবী ফ্রান্স থেকে স্নিগ্ধ ইতালি। কোথা থেকে যেন হেনরি বেলাফন্টের ‘জামাইকা ফেয়ারওয়েল’ গানটা ভেসে আসছে, শুনে মনে হচ্ছে যেন কুচকাওয়াজ হচ্ছে। মিছিলের সবাই মাথা উঁচু করে, বুক চিতিয়ে হাঁটছে। লক্ষ অযুত কণ্ঠে উচ্চারিত হচ্ছে পৃথিবীর সেই শ্রেষ্ঠ স্লোগান, ‘খিদে পেয়েছে, খেতে দাও’!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy