শরীরকে সুস্থ রাখতে, মন ভাল রাখাও জরুরি। প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
স্বাস্থ্যই সম্পদ। আর সেই সম্পদকে যত্নে রাখতে শারীরচর্চা, যোগব্যায়াম, ডায়েট পরিকল্পনা ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা চলতেই থাকে। এটা খাব নাকি ওটা? ক্যালাসথেনিক্স, সাঁতার নাকি জিম, কী ভাবে নিয়ন্ত্রণে থাকবে ওজন? রোগ নিয়ন্ত্রণের নানা সতর্কতা, ওজন বাড়ানো-কমানোর জন্য খুঁটিনাটি টিপস, এ সবের পরে যে শব্দবন্ধ বারবার উঠে আসে, তা হল ‘ব্যক্তিনির্ভর’। বিশেষজ্ঞদের মতে, শারীরচর্চা, ডায়েট, জীবনযাপনের কোনও নির্দিষ্ট নিয়ম হয় না। নিজের জন্য ‘ঠিক’ কী, তা জানতে প্রত্যেককেই বিশেষজ্ঞের মতামত নেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। পুরোটাই নির্ভর করে ব্যক্তিবিশেষে দৈনন্দিন রুটিন, শরীর, স্বাস্থ্যের উপর। সম্প্রতি সে প্রসঙ্গে এবিপি ইনফোকমের এক আলোচনা সভায় অংশ নিয়েছিলেন ড. নন্দিতা শাহ, নিউট্রোজিনোমিস্ট করণ কক্কর, প্রাক্তন ক্রিকেটার এবং ফিটনেস বিশেষজ্ঞ রণদীপ মৈত্র এবং অভিনেতা যশ দাশগুপ্ত।
বক্তাদের সকলেই প্রায় সহমত, গত কুড়ি বছরে দেশ জুড়ে আমজনতার মধ্যে বেড়েছে ডায়াবিটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হার্ট অ্যাটাক সংক্রান্ত নানা শারীরিক সমস্যা। রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে মুঠো মুঠো ওষুধ খাচ্ছেন প্রায় সকলেই। কিন্তু চিকিৎসাবিদ্যার উন্নতি সত্ত্বেও কেন নির্মূল হচ্ছে না অসুস্থতা? ড. নন্দিতা শাহ বলছেন, “নিয়মিত ওষুধ খেয়ে যাওয়া কোনও সমস্যার সমাধান হতে পারে না। প্রচলিত চিকিৎসা ব্যবস্থায় ওষুধ সেবনে আমরা রোগের বাড়াবাড়ির হাত থেকে সাময়িক স্বস্তি পাই, অসুখকে নিয়ন্ত্রণে রাখি। কিন্তু আদতে গোড়া থেকে রোগটিকে দূর করা হয় না। নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা না করে, যদি রোগকে সম্পূর্ণ ভাবে শরীর থেকে বাদ দেওয়ার চেষ্টা করা হত, তবেই মানুষ সত্যিকারের সুস্থ হয়ে উঠতে পারত।”
আর তার উপায়? প্রকৃতিতেই রয়েছে সেই রসদ। ড. শাহের কথায়, প্রকৃতি ও প্রাণিজগতের সঙ্গে নিবিড় সংযোগ স্থাপন, খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাপনে সামান্য বদল মুঠো মুঠো ওষুধ ছাড়াই এনে দিতে পারে কাঙ্ক্ষিত সুস্থতা। এই উদ্দেশ্যেই তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন স্যাংচুয়ারি ফর হেলথ অ্যান্ড রিকানেকশন টু অ্যানিমালস অ্যান্ড নেচার (শরণ)। প্রাণিজ খাবার নয়, এই সংস্থার মূল মন্ত্র হল ভিগান ডায়েট। প্রাণিজ খাদ্যাভ্যাসে শরীরে অভাব হয় প্রয়োজনীয় ভিটামিন, মিনারেল ইত্যাদির। অন্যান্য নানা পুষ্টিরও অভাব হয়। আর সেই অভাব মেটাতে পারে আনাজপাতি, ফল ইত্যাদি প্রাকৃতিক খাবার।
ভাল খান, সুস্থ থাকুন
গত কয়েক বছরে বেড়েছে প্রক্রিয়াজাত খাবার খাওয়ার প্রচলন। জাঙ্ক ফুড, চিপস এখন দৈনন্দিন অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই অভ্যাসের সঙ্গেই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে কোলেস্টেরল, ফ্যাটি লিভার সংক্রান্ত নানা অসুস্থতা। করণ কক্কর বলছেন, “সুস্থ থাকতে দৈনন্দিন তালিকা থেকে অত্যধিক লবণযুক্ত ভাজাভুজি, ইনস্ট্যান্ট নুডলস জাতীয় খাবার বাদ দিন। বরং তালিকায় রাখতে হবে মরসুমি শাক, আনাজ, ফল, ফাইবার সমৃদ্ধ প্রাকৃতিক খাবার। ডায়াবিটিস সংক্রান্ত সমস্যা না থাকলে, সেই তালিকায় থাকতে পারে মরসুমি যে কোনও ফল। সব রান্না করা, ভাজা, সিদ্ধ কিংবা বেকড খাবার নয়, শরীরের চাই মোরিঙ্গার মতো জীবিত খাদ্য ও ঘরোয়া ব্যালান্সড ডায়েট।”
কিন্তু ভাল থাকতে দৈনন্দিন খাদ্যতালিকা থেকে একেবারেই কি ছেঁটে ফেলতে হবে বিরিয়ানি, পিৎজ়া, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই ইত্যাদি মুখরোচক নানা খাবার? না, তেমনটাও নয়। ডায়েট অনুসরণ করা যেমন জরুরি, তেমনই কিন্তু জোর করে নিয়ম মানাও ঠিক না। তাই নিয়মের তোয়াক্কা না করে মাঝেমধ্যে এক-আধদিন সে সব খাবার চলতেই পারে। যশ দাশগুপ্ত বললেন, “শরীরকে সুস্থ রাখতে, মন ভাল রাখাও জরুরি। তাই কখনও কখনও অস্বাস্থ্যকর কিছু খেতে ইচ্ছে করলে, তা খাওয়া যেতেই পারে।” তবে খাদ্যতালিকায় ক্যালরির হিসেব রাখা কী ভাবে সম্ভব? তার সহজ উপায়ও খুঁজে দিলেন অভিনেতা। বললেন, “আমার ডায়েট চার্টে বিরিয়ানি, মিষ্টি সবই থাকে। আমি দৈনন্দিন ক্যালরির হিসেব না কষে, সপ্তাহব্যাপী ক্যালরির হিসেব রাখি। এতে সপ্তাহে এক-দু’দিন যদি একটু মনের মতো খাবার খাওয়াও হয়, তাতে ডায়েটের বিশেষ হেরফের হয় না। সারা সপ্তাহ বেশ কিছুটা ক্যালরি ঝরিয়ে, ভারসাম্য বজায় রাখতে নিশ্চিন্তে খেতে পারি বিরিয়ানি। তখন তা কিন্তু আর ডায়েট চার্টে চিটিং নয়, বরং তার অংশ হয়ে ওঠে।”
জল, ফলের রস, লস্যি ছাড়া অন্য যে কোনও ধরনের রঙিন পানীয় বাদ দিতে হবে। নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে দৈনন্দিন চা-কফির পরিমাণও। তবে আসলে শরীরের জন্য কার্বোহাইড্রেট, তেল, চিনি সবই জরুরি। তাই কার্বোহাইড্রেট সমৃদ্ধ ডায়েট চার্ট যেমন তৈরি করা সম্ভব, তেমনই নো কার্ব ডায়েট চার্টও তৈরি হয়। সবই নির্ভর করে ‘ব্যক্তি বিশেষে’।
ভাল ভাবুন, ভাল থাকুন
সুস্থ থাকতে সামগ্রিক স্বাস্থ্যের দিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন। শুধু ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে নয়, ম্যারাথন, সাঁতার, ক্রিকেট ইত্যাদি স্পোর্টসের সঙ্গে যুক্ত একাধিক ব্যক্তি, অভিনেতা-অভিনেত্রী-সহ বিভিন্ন পেশার সঙ্গে যুক্ত মানুষদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেন রণদীপ মৈত্র। তাঁর মতে, “নানা সাময়িক কারণে কেবল আজকের জন্য নয়, ভাবনা হতে হবে সুদূরপ্রসারী। অল্প বয়সে পেশির জোর, মনের জোরে সয়ে যায় অনেক অনিয়ম। কিন্তু পঞ্চাশ, ষাট কিংবা সত্তরের কোঠায় বয়স যখন পৌঁছবে, পেশির জোর কমবে, বাথরুমে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে, সেই সময়ে সুস্থ থাকা সবচেয়ে জরুরি। আকস্মিক কোনও দুর্ঘটনার হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্যই নিয়মিত শারীরচর্চা জরুরি।”
করণ অবশ্য মনে করেন, সময় থাকতেই অভ্যাস ও জীবনযাপনেও বদল আনা দরকার। বিশেষ কিছু নয়, শুধু পর্যাপ্ত পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত শারীরচর্চা, পর্যাপ্ত ঘুম আর নিয়ন্ত্রিত চিন্তা, আবেগ ও অনুভূতি, এই চারেই হতে পারে বাজিমাত। তাঁর কথায়, “দৈনন্দিন জীবনে আমরা রোজ প্রায় ৬০ থেকে ৭০ হাজার চিন্তা করি। সেই সব চিন্তার সূত্র ধরে শরীর জুড়ে খেলা করে আলাদা ধরনের আবেগ। শরীরের প্রতিটি কোষ কান পেতে সেই আবেগ, অনুভূতিকে শোনে। আর তার ছাপ পড়ে আমাদের শরীর, কর্মক্ষমতা, সৃজনশীলতায়। তাই ভাল চিন্তা থেকে জন্ম হয় ভাল অনুভূতির।”
শরীরের নানা রোগের পিছনে দায়ী অত্যধিক পরিশ্রম, স্ট্রেস, দুর্ভাবনা। তাই হৃদযন্ত্রের সমস্যায় কেবল কার্ডিয়ো-ভাসকুলার ব্যায়ামে সমস্যা মিটবে না। নজর দিন অন্য দিকেও। অনেক সময়ে শারীরচর্চা সেরেই দৌড়তে হয় কাজে। তাতে ক্ষতি হতে পারে শরীরের। তাই রোজ সকাল-রাতে ঘুরিয়েফিরিয়ে করুন ব্যায়াম। আর মনে রাখবেন, আনন্দ যেমন শরীরকে ভাল রাখে, তেমনই হতাশা, ভয় শরীরকে খারাপ করে দেয়। তাই শরীর ভাল রাখতে মানসিক স্বাস্থ্যের দিকেও নজর রাখুন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy