অভিনয় করতে করতে হঠাৎ বুকে ব্যথা, কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এবং তার পরে সিনেমার সেটেই অজ্ঞান হয়ে যান টলিউডের অভিনেতা জীতু কমল।
বয়স চল্লিশের নীচে। পেটানো ঝরঝরে চেহারা। নিয়মিত শরীরচর্চা করেন। খাওয়াদাওয়াও যে মেপেজুপে করেন, তা বহু বার নিজে মুখেই বলতে শোনা গিয়েছে অভিনেতাকে। অর্থাৎ সুস্থ থাকার জন্য চিকিৎসকেরা যা যা করার পরামর্শ দেন, তার অনেক কিছুই মেনে চলেন জীতু। তা হলে হঠাৎ কী এমন হল যে, আচমকা অসুস্থ হয়ে পড়লেন তিনি? এতটাই যে তাঁকে নিয়ে তড়িঘড়ি হাসপাতালে ছুটতে হল!
বুধবার রাত থেকে বাইপাসের ধারের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন জীতু। শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত ছাড়া পাননি। হাসপাতাল সূত্রে খবর, বুকে অস্বস্তি নিয়ে তাঁকে আনা হয়েছিল। যখন ভর্তি করানো হয়, তখন তাঁর জ্বর-সর্দি-কাশিও ছিল। গত দু’দিনে নানা রকম পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয়েছে। কিন্তু সেই সব পরীক্ষায় কী পাওয়া গিয়েছে, তা স্পষ্ট নয় এখনও।
বিভিন্ন সূত্র থেকে অভিনেতার অসুস্থতার যে সমস্ত কারণ শোনা যাচ্ছে, তার মধ্যে একটি— ‘অতিরিক্ত শরীরচর্চার কারণে হার্টে ধাক্কা’। কেউ কেউ আবার অতিরিক্ত কাজের চাপের কথাও বলছেন। কিন্তু সত্যিই কি অতিরিক্ত শরীরচর্চা করে অসুস্থ হয়ে পড়লেন জীতুর মতো তরতাজা এক যুবক? কম বয়সেই হার্টের রোগে আক্রান্ত হলেন তিনি? যদি তা-ই হয়, তবে তো নিয়মিত শরীরচর্চা করা, নিয়ম মেনে খাবার খেয়ে নিজেকে সুস্থ ভাবা লাখো যুবক এমন ঝুঁকির মুখে পড়তে পারেন!
কারণ বুঝতে তাই চিকিৎসকদেরই দ্বারস্থ হয়েছিল আনন্দবাজার ডট কম। তাঁদের বক্তব্য শুনে বোঝা গেল, জীতুর যা হয়েছে, তার একটি নয়, অনেক রকম কারণ থাকতে পারে। অতিরিক্ত শরীরচর্চার কারণটিও নিছক এড়িয়ে যাওয়ার মতো নয়।
আরও পড়ুন:
শরীরচর্চা থেকে কখন হার্ট অ্যাটাক হতে পারে?
শরীরচর্চা করতে গিয়ে অল্প বয়সি অভিনেতার হার্ট অ্যাটাকের ঘটনা আগে ঘটেছে। মধ্য ৩০-এর বলিউডের অভিনেতা সিদ্ধার্থ শুক্লের মৃত্যুও হয়েছিল সেই ঘটনায়। আবার কৌতুক অভিনেতা রাজু শ্রীবাস্তব ৫০ পেরনোর পরে শরীরচর্চা শুরু করে হার্টের অসুখে আক্রান্ত হন। জীতুর বয়সও সিদ্ধার্থেরই মতো। চিকিৎসক সরোজ মণ্ডল বলছেন, ‘‘শরীরের উপর বা পেশির উপর অতিরিক্ত চাপ পড়লে, তা থেকে হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা পুরোপুরি উড়িয়ে দেওয়া যায় না।’’ সরোজ জানাচ্ছেন, হৃৎপিণ্ডের ধমনীতে শরীরে অতিরিক্ত চাপ পড়লে আর ধমনীতে ব্লকেজ থাকলে, সেখানে জমে থাকা প্লাকগুলি (ধমনীতে কোলেস্টেরল বা ক্যালশিাম জমে দলা পাকিয়ে যাওয়া পদার্থ) ফেটে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে বুকে ব্যথা তো বটেই, হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনাও তৈরি হতে পারে।’’
হৃদ্রোগ চিকিৎসক আফতাব খানের বক্তব্যও কিছুটা এক। তবে তিনি বলছেন, ‘‘তার মানে এই নয় যে, শরীরচর্চা করলেই তা হার্টের উপর চাপ ফেলবে। যদি কারও হার্টে আগে থেকেই কোনও সমস্যা থেকে থাকে আর তিনি যদি আচমকা অতিরিক্ত বেশি চাপ নিয়ে কোনও অ্যাগ্রেসিভ ট্রেনিং বা ভারী শরীরচর্চা করতে শুরু করেন, তা হলে এমনটা ঘটলেও ঘটতে পারে। কিন্তু যিনি নিয়মিত ভাবে এক ধরনের শরীরচর্চা করে চলেছেন, তাঁর ক্ষেত্রে এমনটা না-ও হতে পারে।"
তবে কার জন্য কতটা শরীরচর্চা নিরাপদ, তা হৃৎস্পন্দন দেখেই বোঝা যায় বলে জানাচ্ছেন হৃদরোগের চিকিৎসক কুণাল সরকার। তিনি বলছেন, ‘‘শরীরচর্চা কে কতটা করতে পারবেন, তা আগে থেকেই বুঝে নেওয়ার একটা সহজ হিসাব আছে। যিনি শরীরচর্চা করছেন তাঁর বয়স ২০০ থেকে বাদ দিতে হবে। অর্থাৎ ৫০ হলে ২০০ থেকে ৫০ বাদ দিয়ে হবে দেড়শো। সে ক্ষেত্রে শরীরচর্চা করার সময় হৃৎস্পন্দন যাতে কোনও ভাবেই ১৫০-এর বেশি না হয়, সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। তার বেশি হলেই হার্টের উপর চাপ পড়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে।’’
আরও পড়ুন:
মানসিক চাপ বা কাজের চাপও কি কারণ হতে পারে?
অতিরিক্ত মানসিক চাপ থেকে হার্ট অ্যাটাকের সমস্যা যে হতে পারে তা বহু গবেষণাতেই জানা গিয়েছে। শহরের হার্টের চিকিৎসকেরা বলছেন, কাজ থেকে বা ব্যক্তিগত জীবন থেকে মানসিক চাপ হলে তা থেকে হার্ট অ্যাটাকের সমস্যা হওয়া অস্বাভাবিক নয়। তবে সরোজ বলছেন, এই ধরনের সমস্যায় সাধারণত ভোরের দিকে হার্টের সমস্যার ঝুঁকি বাড়ে। কারণ তখন বিভিন্ন ধরনের হরমোন, যা মানসিক চাপ বেশি হলে নিঃসৃত হয়, তার ক্ষরণ বেড়ে যায়। তবে জীতুর ক্ষেত্রে ঘটনাটি সকালে নয়, ঘটেছে রাতে। একটি ছবির শুটিং করার সময়। চিকিৎসক আফতাব বলছেন, অসুস্থতা নিয়ে যদি কেউ অতিরিক্ত চাপ নিয়ে কাজ করতে থাকেন, তবে তার প্রভাব শরীরে পড়তে পারে। হার্টের উপরও পড়তে পারে।
ভাইরাল জ্বর থেকেও হতে পারে
ক্রিটিক্যাল কেয়ারের চিকিৎসক সব্যসাচী সেন শরীরচর্চার সঙ্গে হার্টের ঝুঁকির সম্ভাবনা মেনে নিয়েও বলছেন, ‘‘৪০ বছরের নীচে বুকে ব্যথা হলে সাধারণত প্রথমেই হার্ট অ্যাটাক ভাবা হয় না। অনেক সময় অ্যাসিড বা গ্যাসের সমস্যা থেকেও বুকে ব্যথা হতে পারে। আবার ভাইরাল জ্বর হলেও তার প্রভাবে বুকে ব্যথা হতে পারে। তার সঙ্গে হার্টের কোনও সম্পর্ক নেই।’’ উল্লেখ্য জীতুকে যখন হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়, তখন তাঁরও জ্বর-সর্দি-কাশির সমস্যা ছিল। সরোজ বলছেন, ‘‘ফ্লুয়োরাইটিস হলে অনেক সময় ফুসফুসের বিভিন্ন স্তরে জল জমে যায়। তার থেকেও বুকে ব্যথা হতে পারে।’’
আরও পড়ুন:
ডায়াবিটিস আর ধূমপান
তবে ভাইরাল জ্বর এবং শরীরচর্চার সমস্যা বাদ দিলেও নানা কারণে বুকে ব্যথা হতে পারে বলে জানাচ্ছেন কুণাল। তিনি বলছেন, ‘‘অভিনেতাদের ক্ষেত্রে অনেক সময় ধূমপানের প্রবণতা বেশি দেখা যায়। যেহেতু ওঁকে ব্যক্তিগত ভাবে চিনি না, তাই জানি না, ওঁর ডায়াবিটিস রয়েছে কি না। কিন্তু এই দু’টি কারণও অল্পবয়সিদের মধ্যে হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিচ্ছে।’’ তবে তিনি এ-ও জানাচ্ছেন যে, বুকে ব্যথার কারণ হার্টের সমস্যা কি না, তা বুঝতে খুব বেশি সময় লাগার কথা নয়। তা নানা রকম পরীক্ষা নিরীক্ষা করেও জানা যায়। জীতু ৩৬ ঘণ্টারও বেশি সময় রয়েছেন হাসপাতালে। চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, অনেক সময় এই ধরনের সমস্যায় রোগীকে পর্যবেক্ষণেও রাখা হয় দীর্ঘ সময় ধরে। হয়তো এ ক্ষেত্রে তা-ই হচ্ছে।